×

মুক্তচিন্তা

এম্পটি চেয়ার ইকোনমিতে বিশ একুশের বাজেট

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২০, ০৯:৫২ পিএম

এম্পটি চেয়ার ইকোনমিতে বিশ একুশের বাজেট

ড. এম এ মোমেন

এম্পটি চেয়ার ইকোনমিতে বিশ একুশের বাজেট
তবুও আমার কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশ- এই রাষ্ট্রীয় ঘোষণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে মোবাইল ফোনে ৩৩ শতাংশের অধিক করারোপ এবং ইন্টারনেট ডাটার মূল্য বৃদ্ধি। যখন অনলাইন ক্লাস বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিবার্য হয়ে উঠেছে, এখনই ইন্টারনেট ডাটার মূল্য দিয়ে পুরো ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের অনেক সময়ই সম্ভব হচ্ছে না এই বৃদ্ধি তাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রের ওপর অসন্তুষ্ট হবার সুযোগ করে দেবে।
শারীরিক যন্ত্রণা নিরাময় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জোনায়েদ শফিকের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ইমেজ পেয়েছি, এটি সামাজিক মাধ্যমে এ হাত থেকে ও হাতে যাচ্ছে, লাল প্রেক্ষাপটে সাদা হরফে লেখা : মন্ত্রীদের চিকিৎসা তার নিজের জেলা সদর হাসপাতালে এমপিদের চিকিৎসা তার নির্বাচনী এলাকার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং আমলাদের চিকিৎসা সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে বাধ্যতামূলক করা হলেই দেশের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যাবে... দেশের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র বদলে দেবার জন্য এই ব্যবস্থাপত্রটি যিনি প্রণয়ন করেছেন তিনি স্বাস্থ্য খাত অব্যবস্থাপনার গোড়ায় হাত দিয়েছেন। এই ব্যবস্থাপত্র প্রণেতাকে ধন্যবাদ। যদি মন্ত্রী এমপি আমলা রাজি না হন? তাতে কোনো সমস্যা নেই। তারা বাদ পড়ে যাবেন, শূণ্য পদে পুনরায় নিয়োগ করা হবে। এদেশে সুশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতি আছে, কিন্তু মন্ত্রী, এমপি ও আমলা হবার মতো শিক্ষা-ঘাটতি ও নৈতিকতা-ঘাটতি সম্পন্ন মানুষের অভাব নেই। নাগরিকগণ যদি ধরে নিতে পারতেন, না-ই থাকল নাগরিক প্রসঙ্গ, তবুও মন্ত্রী-এমপি-আমলা স্বাস্থ্যরক্ষা ও সুচিকিৎসা করার জন্য নিজ জেলা, নিজ উপজেলা এবং কর্মচারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও স্বাস্থ্য সেবায় আমূল পরিবর্তন ঘটত, আর তার ট্রিকল-ডাউন এফেক্টে তাদেরও কমবেশি উপকার হতো। আর প্রাধিকার আছে বলেই কুচকিতে চুলকানি সারাতে লটবহরসহ রাষ্ট্রের অর্থে এমনকি ইউরোপ আমেরিকার ব্যয়বহুল হাসপাতাল সফরে যারা গিয়েছেন এবং যেতে চান তারা কিছুটা হলেও লজ্জাবোধ করতেন। আমাদের সরকারের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র আমাদের করোনার চেয়েও শক্তিশালী বলে যত সম্মানিত করে থাকুন না কেন, করোনা ভাইরাস যে গোটা দেশকে এতটা নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে এখন মাংসপেশি পাম্প করেও উঠে দাঁড়ানোটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ নয়, গোটা পৃথিবীই এখন অহংকারটুকু গিলে হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। বিশ^ অর্থনীতির যারা খোঁজ রাখেন তারা জানেন অর্থনীতির বিভিন্ন খাত-উপখাতে অর্থসৃষ্টি ও মূল্য সংযোজন করার কাজটি কেবল শ্লথ হয়ে আসেনি- অধিকাংশ স্থানে তা শাটডাউন হয়ে গিয়েছিল। দু-একটি ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, বাংলাদেশের জিঞ্জিরাতেও ‘মেইড ইন ইউএসএ’ এন-৯৫ মাস্ক তৈরি ও সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের এটুকু সৃজনশীলতা তো থাকতেই পারে, আর তাদের ওপর যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের সুনজর থাকে তাহলে তো কথাই নেই। এই সরবরাহ যারা দিয়েছেন জেনেই দিয়েছেন, দাঁত কেলিয়ে নিয়ে যারা ধন্য হয়েছেন, তারা জেনেই নিয়েছেন। বাংলাদেশেও এরকম কয়েকটা অর্থকরী কাজ ছাড়া গত ২৫ মার্চ থেকে কার্যত গোটা দেশই অন্তত টাকা পয়সা সৃষ্টি করার প্রশ্নে শাটডাউন হয়ে গিয়েছিল। তারপরও যারা রাষ্ট্রের বদান্যতায় বেতন-ভাতা এবং বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় অর্থ পেয়েছেন তারা অর্থসৃষ্টি করেননি, সুবিধাভোগী হবার সুযোগে জনগণের অর্থ ভোগ করেছেন। এমন সংকটকালে অনিশ্চিত আগামীর মুখোমুখি হয়ে শাটডাউন অর্থনীতি রিস্টার্ট করতে ২০২০-২১ অর্থবছরের অতিকায় বাজেট প্রণয়নে অর্থমন্ত্রীকে হিমশিম খেতে হয়েছে তার একটি বক্তব্যই সে কথা প্রমাণ করে : টাকা কোত্থেকে আসবে আমি জানি না। যাদের বয়স অন্তত কনসাস সিক্সটি-সচেতন-ষাটের ঘরে, তারা পেছন ফিরে ১৯৭২ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থাপিত ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেটটি স্মরণ করতে পারেন। তারই উপস্থাপনায় প্রথম কোটি টাকার চার ডিজিট বাজেট আসে ১৯৭৪-৭৫ সালে : ১০৮৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। কোটি টাকার পাঁচ ডিজিটের প্রথম বাজেট পেশ করেন এম এ মুনিম, ১০,৫৬৬ কোটি টাকা। কোটি টাকার ছয় ডিজিটের প্রথম বাজেটটি ১,১৩,১৭০ কোটি টাকার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে। আমরা এখনো ছয় ডিজিটে আছি। সাত ডিজিটে পৌঁছাতে অর্ধেকের বেশি আর্থিক আকার এবার অতিক্রম করেছি। থাকুক বড় টাকার ঘাটতি, তবুও এটিই বড় অঙ্কের বাজেট বৃহত্তম বাজেট। তার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কোথাও কোথাও লেখা হয়েছে এ সময় অর্থাৎ বাজেট বছরে অর্থমন্ত্রী ৫.৪ মুদ্রাস্ফীতি ‘আশা’ করছেন। মুদ্রাস্ফীতি আশাপ্রদ কিছু প্রাপ্তি হবার কথা নয়, এটা হবে ‘আশঙ্কার’। ৫.৪ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি আশঙ্কার মুহূর্তে দেশবাসীকে হতাশ করতে না চাইলে ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঘোষণাতে ধাক্কা খাবার কিছু নেই। কিন্তু মন্ত্রীর নিজ দলীয় হিসেবে পরিচিত অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য ও সাবেক আমলা বলছেন, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব; আবার গুরুত্বপূর্ণ অপর একজন মন্ত্রী এমন জোর দিয়ে বললেন যেন ৮.২ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কোনো ব্যাপারই না, চাইলে আরো বেশিই বলা যেতো। বাজেট পেশ করা হয়েছে জ্যৈষ্ঠ মাসের আঠাশ তারিখে, ঠিক কাজটিই করা হয়েছে। তিন দিন দেরি হলেই বিশাল অঙ্কের এই বাজেট পেশ হতো আষাঢ় মাসে, আর সুযোগ বুঝে বিরোধীরা বলে বেড়াতেন আষাঢ়ে বাজেট। আষাঢ়ে গল্পস্বল্প- এমন কথা শোনা যায়, আষাঢ়ে বাজেটও হয় নাকি? বিরোধীদের কথার লাগাম থাকেনা। অবশ্য গৃহপালিত বিরোধী হলে আলাদা কথা। বাজেট আলোচনার শুরুতে মন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেয়ার রেওয়াজ আছে। ধন্যবাদ দেয়ার পর নিজ দলের মুখপাত্রগণ বাজেট পাঠ করেই হোক কি না করেই হোক, শুনেই হোক না শুনেই হোক বলে দেন- এটা হচ্ছে যুগান্তকারী বাজেট। স্মরণকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেট, প্রগতিশীল বাজেট, কল্যাণমুখী বাজেট; গরিবী হটানোর (এটি ভারতীয় বোল)- আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে বলি দারিদ্র্য বিমোচনের বাজেট, স্বপ্ন বাস্তবায়নের বাজেট (এ স্বপ্ন আমাদের হতে পারে, পূর্ব পুরুষেরও হতে পারে), এ বাজেট জনগণের জন্য শুভেচ্ছা উপহার- বাজেটের প্রশংসায় এসব কথা বলাই যায়, রাষ্ট্রীয় খাতের কবিরা বাজেট কাব্যও লিখে ফেলতে পারেন। প্রতি বছর বাজেট পেশ করার পর বিরোধীপক্ষীয় বিবৃতিদাতারা যা বলে থাকেন এবারও তার ব্যতিক্রম হবার কথা নয় : এ বাজেট ফাঁপা বুলি, অন্তঃসারশূন্য, বাজেটের লক্ষ্য বাস্তবায়নযোগ্য নয়। আজকাল অবশ্য গরিব মারার বাজেট কথাটা কেউ বলেন না, আয়-বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলাও থেমে গেছে। বাজেটের পাতা না উল্টেই বলে দেয়া যায় আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যহীন বাজেট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত বাজেট, উচ্চাভিলাষী বাজেট, সামরিক ও বেসামরিক আমলা তোষণের বাজেট, আর্থিক দুর্বৃত্তায়ন বাড়াবার বাজেট, কৃষি খাত উপেক্ষার বাজেট- এমন আরো কয়েক ডজন শব্দ-বন্ধন যোজনা করা যায়। এর একটা উপসংহার টানা যায়: সরকারী দল বলবে গণমুখী বাজেট, বিরোধী দল বলবে গণবিরোধী বাজেট। জনগণ কি ভাবেন বলার দরকার নেই। যখন বাজেট ঘোষণা করা হয় সাধারণ মানুষ লক্ষ্য করেন কোন জিনিসটার দাম কমল আর বিত্তবানের নজর থাকে কোনটার দাম বাড়ল তার উপর। বাজেট সমীক্ষকরা জানেন যা কিছুর দাম কমে তা বিত্তহীনের কাজে আসে না, আর যা কিছুর দাম বাড়ে বিত্তবান তার বাড়তিটা উসুল করে নিতে জানেন। যেমন বিশ একুশের বাজেটে স্বর্ণ, এয়ারকন্ডিশনার, স্যানিটারি ন্যাপকিন আর ডায়াপারের দাম কমেছে, এ দাম অর্ধেকে নেমে গেলেই বা বিত্তহীনের কি এসে যায়। উৎসবমুখর পরিবেশেই বাজেট পেশ করা হয়ে থাকে। বাজেট-উত্তর ডিনারের রেওয়াজ আছে। সাংবাদিক তো লেগেই থাকেন, বাজেট-উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনও বাজেট-রিচুয়ালের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠে। কথাটি পছন্দেরই হোক কি অপছন্দের- এরকম একটি সাংবাদিক সম্মেলন শেষে বাংলাদেশেরই একজন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বাজেটের টাকা বারো ভূতে খায়। বাংলা অভিধানে বারো ভূতের স্থান হয়েছে। তাতে এর মানে বলা হয়েছে ‘নানা বা বহু অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’। তার মানে অনেক অবাঞ্ছিত মানুষ এই টাকা খায়। কিন্তু সে সময় বিষয়টি আমার এতই মনে ধরে যে অভিধানের অর্থ থেকে বেরিয়ে এসে লিখেই ফেললাম : বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী বাজেটখোর এক ডজন ভূতের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। রাষ্ট্রের পরবর্তী কাজ হচ্ছে এই ভূত শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা করা। এ নিয়ে না অর্থমন্ত্রীর দপ্তর বা বারোজন ভূতের সিন্ডিকেট কোনো জায়গা থেকে কেউ প্রতিবাদ না করায় বারো ভূতের ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে মনে করা যায়। সেই বাজেট ভাষণের পর আরো বহু বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে, যথারীতি সাংবাদিক সম্মেলনও হয়েছে। কোনো মন্ত্রীই বলেননি আমরা বারো ভূত বিদায় করে দিয়েছি, আমাদের বাজেটের টাকায় ভূতের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। কসম, ভূতের হিস্যা নেই। যেহেতু দুর্ভাগ্যজনক করোনাকাল চলছে বাজেটের স্বাস্থ্য খাত এবং করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য রাখা থোক বরাদ্দের দিকেই নজর আগে পড়ার কথা। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই, এমনকি যারা এখন মুক্ত এবং কোভিড-১৯-এর পুনঃপ্রকোপের সম্ভাবনা থেকেও মুক্ত থাকবে বলে মনে করছেন, তারা ধরে নিয়েছেন বছরটা তাদের টিকে থাকার। বিলিয়নিয়ার আম্বানি কিংবা ওয়ারেন বাফেট দুজনের একই পরামর্শ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের। কেবল টিকে থাকুন। আম্বানি বলেছেন, যদি টিকে যেতে পারেন এটাই বড় লাভ। করোনা ভাইরাস প্রতিহত করার জন্য দেশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দিয়ে যারা একথা বলিয়েছেন সম্ভবত ভুয়া প্রস্তুতির লাভের টাকা পুরোটাই আদায় করে নিয়েছেন। করোনা ভাইরাস জরুরি সহায়তা প্রকল্পের আড়াই হাজার কোটি টাকার মাস্ক আর পিপিই ও অন্যান্য সামগ্রীর আকাশ-চুমো দরের খবর জাতীয় পত্রিকায় এসে গেছে। ৪ জুন, বাজেট পেশের মাত্র ছ’দিন আগে জাতীয় পত্রিকায় ফাঁস হয়ে যাওয়া এই প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হয়তো বিচলিত হয়নি- হাসপাতালের কেনাকাটার আরো যেসব কাহিনী ফাঁস হয়েছে সেগুলোও এর চেয়ে কমকিছু নয়। কিন্তু টাকা ছাড় করার মালিক হিসেবে অর্থমন্ত্রীর মন্ত্রণালয় কি এমনি তা অবমুক্ত করবে? এবার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৫.২ শতাংশ। এই টাকাটা কম না বেশি এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে- যদি আরো কমও হতো আমি তা নিয়ে কিছু না বলে একটা প্রশ্নই রাখতাম, টাকাটার সঠিক ব্যবহার হবে তো? নাকি হাসপাতালের পর্দা আর যন্ত্রপাতি আর জিঞ্জিরার মাস্ক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দের ওপর হতভাগ্য নাগরিকের চোখ না পড়লেও এর মধ্যে ভাগ্যবান ঠিকাদার ও তাদের প্যাট্রনরা পুরনো চর্চা অনুযায়ী যন্ত্রপাতির তালিকা এবং দাম ঠিক করে ফেলে থাকবেন। এই চক্রে কারা জড়িত, কিংবা আগামীতে কারা জড়িত হবেন এর প্রায় সবই ‘ওপেন সিক্রেট’। ঠিকাদার তার সুবিধামতো যন্ত্রের তালিকা করবেন, জেলার বিভাগের এবং এমনকি রাজধানীর সরকারি হাসপাতালের অধিকর্তাকে দিয়ে তাদেরই তৈরি করা অধিযাচন পত্র সই করতে বলবেন, সই না করলে মন্ত্রণালয় থেকে অনানুষ্ঠানিক হুকুম যাবে, না শুনলে আনুষ্ঠানিকভাবে তার চাকরি যাবে কিংবা দুর্গম অঞ্চলে বদলি হবেন। এই চক্রটি যদি বহাল থাকে লাখ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত হলেও আমরা তোতাপাখির মতো বলে যাব, সব ঠিক আছে, আমরা সামলে নিয়েছিÑ আমরা করোনাবিজয়ী বীরের জাতি। দেশে করোনার থাবার নিচে কত মানুষ তার পরিসংখ্যান সত্যিই আমাদের নেই। যে ক’জনকে টেস্ট করা সম্ভব হয় তার মধ্যে ক’জন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত আমরা সে হিসাবটাই দিনের পর দিন যোগ করে আসছি, বিশ্বস্বাস্থ সংস্থাকে তাই সরবরাহ করছি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আশার কথাই শুনিয়েছেন : অমানিশার অন্ধকার একদিন কেটে যাবে। এটাই মন্ত্রীসুলভ কথা! প্লেগ বিশ্বব্যাধি বারবার হানা দিলেও শেষ হয়েছে, তিন বছর ভুগিয়ে স্পেনিশ ফ্লু-ও চলে গেছে, এক সময়ের গুঁটিবসন্ত মহামারি পৃথিবীতে আর নেই। করোনা ভাইরাসও যাবে- কিন্তু আমাদের ভুয়া প্রস্তুতির কারণে কতদিন ভুগিয়ে যাবে তা বলা মুশকিল। বিদেশি বিশেষজ্ঞ এমনকি বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি বিশেষজ্ঞরাও এশীয় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যে হিসাব দিচ্ছেন তার যদি আংশিকও সত্য হয় তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে করোনাকালের সবচেয়ে খারাপ সময়টি এখনো আমাদের আসেনি। আমি এ নিবন্ধটির নাম রেখেছি ‘এম্পটি চেয়ার ইকোনমিতে বিশ একুশের বাজেট’। বাজেট পেশের দিন বিশ^খ্যাত স্থপতি লুই আই কানের সৃষ্টি অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর সংসদ ভবনে অধিকাংশ চেয়ারই শূন্য ছিল, এ কারণে নিবন্ধের নাম এম্পটি চেয়ার ইকোনমি নয়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর সোশ্যাল ডিসট্যান্স রক্ষা করার বাধ্যবাধকতায় যে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যে কোনো যানবাহন, যে কোনো ক্লাব, যে কোনো বার কিংবা রেস্তোরাঁয় বহুসংখ্যক চেয়ার খালি রাখতে হচ্ছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ব্যবসায়ের এ ধরনের পরিস্থিতিকে বলেছে ‘এম্পটি চেয়ার ইকোনমি’। যা মোটেও সম্পূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য অর্থনীতি নয়। ইউরোপের রাস্তায় খালি চেয়ার বসিয়ে রেস্তোরা মালিকরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও করা হয়েছে। বিমানের তিনটি সিট একত্র করে একটি বেড বানিয়ে একজন যাত্রীর কাছে এক টিকেটের দামে ভাড়া দেবার যে আয়োজন করেছে তাকে বলা চলে ফ্লাট বেড অর্থনীতি, এম্পটি চেয়ারের চেয়েও কম আয় এতে। এই কাজটি করেছে এয়ার এশিয়া। এখনো যেসব বিধিবিধান সচিবালয়, সংসদ, দপ্তর, যানবাহনে আরোপ করা আছে তা কত দিন থাকবে অনিশ্চিত। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে টোটাল লকডাউন অনিবার্য হয়ে পড়বে, পরিস্থিতি তখন এম্পটি চেয়ার ইকোনমির চেয়েও ভয়ঙ্কর খারাপ হয়ে পড়বে। চার্লস দ্য গল যখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সে সময়কার একটি সংকট -এটি ইউরোপিয়ান মুভমেন্ট ইন্টারন্যাশনালের কোনো কোনো সদস্যের অনুপস্থিতিতে সৃষ্ট সংকটের নাম দেয়া হয় এম্পটি চেয়ার ক্রাইসিস। করোনাকালের লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্বের বাস্তবতা অর্থনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে সেই এম্পটি চেয়ার মাথায় রেখেই অর্থমন্ত্রীকে বাজেট পেশ করতে হয়েছে। টাকা যোগাড়ের কষ্টটা তার জানা। কেনাকাটা ও ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় অর্থ ছাড় করার আগে অর্থ মন্ত্রণালয় তা নিয়ে ভাববে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় প্রয়োজনে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিধান সারা পৃথিবীতেই আছে। যুদ্ধ মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য যতটা হুমকি তার চেয়ে অনেক বড় হুমকি করোনা ভাইরাসের মতো বিশ^ব্যাধি। তাহলে দেশজুড়ে বিশ্বব্যাধি মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রীয় আদেশ মান্য করা থেকে শুরু করে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে বহন করা, মৃতকে যথাযথভাবে সমাহিত করার জন্য ৫৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ৩২৮টি মিউনিসিপ্যালিটিতে ৩ থেকে ৫ লাখ তরুণ-তরুণী একটি প্রশিক্ষিত করোনাযুদ্ধ ইউনিট- করোনা স্কোয়াড গঠন করার বিষয়টি কি ভেবে দেখা যায় না? সাময়িকভাবে হলেও তাদের আংশিক কর্মসংস্থানের আয়োজন যেমন নয়, তেমনি করোনা ভাইরাসবিশ্বব্যাধির বিরুদ্ধে আমাদের অসহায়ত্বও কমে আসে। আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত কিংবা আমরা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে এসে সরকার কল্যাণের প্রতিশ্রুতিটি প্রতিষ্ঠা করতে পারে- স্মরণ রাখতে হবে ১৯২০ এর বিশ্বব্যাধি সমাপ্ত হতে তিন বছর লেগেছিল। এই নিবন্ধটির শিরোনামে বিশ একুশের বাজেট বলেছি- এটি আক্ষরিক অর্থেই টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান। নয় ছয় কিংবা উনিশ বিশের ঋণাত্মক অর্থ রয়েছে, বিশ একুশ মাত্র ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে সম্ভবত এই প্রথম, বাজেটের অর্থ ব্যবহারের সততার উপর বিশ একুশের ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হবে। এটকা লুটপাট হলে বিশ একুশ আর নয় ছয়ে তেমন কোনো তফাৎ থাকবে না। বাজেট পরবর্তী ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে (কারণ এটা এম্পটি চেয়ার ইকোনমির যুগ) অর্থমন্ত্রী বলেছেন যারা তাদের টাকা দেশে রাখতে চান না তারা একেবারেই বিদেশে চলে যান। দেশের অর্থ কারা পাচার করছেন, কীভাবে করছেন, ভুয়া আমদানি, ভুয়া রপ্তানি, ভুয়া বিনিয়োগ, পাচার করার টাকা আবার দেশে এনে এক্সপোর্ট ইনসেনটিভ প্রাপ্তি- এসব সরকারের অজ্ঞাত নয়। যারা এসব ঘটাতে সাহায্য করছেন, মন্ত্রী যদি তাদের আগে ধরার উদ্যোগ নিতেন পাচারের সংকট অনেকটা কমে আসত। বাজেট নিয়ে জুনিয়র জর্জ বুশকে (যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩তম প্রেসিডেন্ট) জড়িয়ে বলা হয়- তিনি কেমন করে বুঝলেন যে এটা বাজেট? তার জবাব, পাতা উল্টে দেখেছেন ভেতরে অনেক নম্বর, একেবারে ঠাসা। সুতরাং এটাই বাজেট। সঙ্গত কারণে সংখ্যায় ঠাসা কোনো গ্রন্থ সুখপাঠ্য কিছু নয়। কিন্তু এর একটি লিখিত অংশও থাকে তাতে নিজেদের ঢাক পেটানো বহু কিছু বিদেশি বাজেটেও থাকে। কিন্তু এ বাজেটে বর্তমান অবস্থাটি কি এবং এখান থেকে বাজেট নাগরিককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তার বিবরণ কোথায় কে জানে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর অর্থনীতিও বন্দিদশায় পড়েছে, শাটডাউনও হয়ে গেছে করোনা আমাদের অর্থনীতিকে কতটা অবদমন করেছে- কতটা অবদমনের পরও প্রবৃদ্ধি এত প্রশংসনীয় অবস্থানে রয়ে গেছে তার ব্যাখ্যা কোনো মাধ্যমেই দেখিনি। মধ্য আয়ের দেশে গ্র্যাজুয়েশনের গাণিতিক সুসংবাদ দিয়ে আমরা নিজেদের এত বেশি প্রশংসা করে ফেলেছি যে মিডল ইনকাম ট্র্যাপ বলেও একটা সাধারণ ফাঁদ আছে সেটাও মাথায়ই নেইনি। নাকি সেই অহংকারটি ধরে রাখতে ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলছি? তাহলে এ বাজেটে পৃথিবী মনে করবে বাংলাদেশে কোনো চেয়ারই এম্পটি ছিল না। অর্থনীতিতে করোনাঘাত তেমন লাগেনি। আমি করোকালে স্বাস্থ্য নিয়ে থাকতে চেয়েছি, রাজস্ব আয়ের দিক, ঘাটতি মেটানোর সম্ভাবনায় দিক, সংকট আরো ঘনণীভূত হলে তা সামলানোর পথ- কৃষিতে বণ্টন দৈন্যতা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টর শিক্ষাকে টেনে তোলার দিক নির্দেশনা- এসব নিয়ে গুণীজন বলবেন। তবুও আমার কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশ- এই রাষ্ট্রীয় ঘোষণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে মোবাইল ফোনে ৩৩ শতাংশের অধিক করারোপ এবং ইন্টারনেট ডাটার মূল্য বৃদ্ধি। যখন অনলাইন ক্লাস বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিবার্য হয়ে উঠেছে, এখনই ইন্টারনেট ডাটার মূল্য দিয়ে পুরো ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের অনেক সময়ই সম্ভব হচ্ছে না- এই বৃদ্ধি তাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রের ওপর অসন্তুষ্ট হবার সুযোগ করে দেবে। অর্থমন্ত্রী তো আমলা নন, রাজনীতিবিদ। এমনিতেই দুর্যোগ, যাদের পরামর্শে শিক্ষার্থীদের ওপর এই খড়গটি নামিয়েছেন তার পরিণতি কতটা খারাপ হতে পারে তিনি নিশ্চয়ই তা পরিমাপ করতে পারবেন। ড. এম এ মোমেন : সাবেক চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App