×

অর্থনীতি

বাজেট বাস্তবায়নই অনিশ্চিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২০, ০৯:৩৪ এএম

করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতি খুবই নাজুক। তার চেয়েও বেশি নাজুক স্বাস্থ্য খাত। এমন পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যদিও আগে থেকেই দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলে আসছেন, এবারের বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত, মহামারির ফলে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, সেসব মোকাবিলা করা এবং অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিধারায় ফিরিয়ে আনা। এবারের বাজেট ঘোষণায় তার কতখানি প্রতিফলন ঘটেছে- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাস্তবায়ন নয়- জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণই অর্থমন্ত্রীর প্রধান লক্ষ্য।

রাজস্ব ও জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। এ ছাড়া বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর হয়েছে- একথা ঠিক। কিন্তু তার একটা বড় অংশই চলে যাবে পেনশন ভাতার দিকে। সুতরাং প্রকৃত অর্থে বরাদ্দ কতখানি বাড়লো- সেটাও দেখার বিষয়। কারণ অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় নিজেই বলেছেন, ১৪ লাখ মানুষ কর্মহীন হবে। এমন পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে একটা বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছে এবং সামনের দিনগুলোতে আরো বড়সংখ্যক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কীভাবে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় আনা যাবে- সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কতটুকু সংগতিপূর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরো বেশি বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছে তারা। সেই সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা খুব বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছে সানেম।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি ও রাজস্ব খাতে যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। তিনি বলেন, বাজেটের আকার বাড়লে বেশি কাজ হবে এটা মনে করা হলেও এবার টাকার অভাবে অনেক কাজ আটকে যাবে। কাজ করা সম্ভব হবে না। তিনি আরো বলেন, বাজেটে কিছু খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও টাকার জোগান কীভাবে হবে তার স্পষ্ট ধারণা মিলছে না। এত প্রকল্প কীভাবে নেয়া হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এবারের বাজেটে অনেক অসংগতি রয়েছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মাজেদ মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অর্থ যথার্থভাবে ব্যবহার করে করোনা দমন করতে হবে। তিনি বলেন, কর্মসংস্থানে আরো সৃজনশীলতা বা কাজের বিনিময়ে খাদ্যের নীতি নিতে হবে। করোনার কারণে এবারের পরিস্থিতি একদমই ভিন্ন। দেশ দুর্যোগমুক্ত না হলে বাজেটের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেও অভিমত তার। জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার (১১ জুন) ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শিরোনামে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

ঘোষিত বাজেটে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট আইনের আওতায় নতুন বাজেটে আগাম কর ১ শতাংশ কমানো হয়েছে। যা আগে ৫ শতাংশ ছিল। সে হিসেবে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানি করার ক্ষেত্রে অগ্রিম করের পরিমাণ ৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া অগ্রিম কর সমন্বয় করার জন্য দুই কর মেয়াদের পরিবর্তে চার কর মেয়াদে সমন্বয় করা হবে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ৩৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে এ স্তরের করহার আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩২ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। টানা পাঁচ বছর পর ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি করহার কমানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে সর্বনিম্ন করহার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ৫ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক হিসাবে থাকলে বর্তমানে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ হয়। সেটাকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার টাকার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে ১০ লাখ টাকার বেশি কিন্তু ১ কোটি টাকার কম হলে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ এখন থেকে ৩ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হবে। এ ছাড়া ১ কোটি টাকার বেশি কিন্তু ৫ কোটি টাকার কম থাকলে ১২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাজেটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক লেনদেন হয় এমন প্রতিষ্ঠানকে ৪ শতাংশ টার্নওভার কর দিতে হয়। এ টার্নওভার কর ১ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। সারচার্জের ক্ষেত্রে যাদের ২০ কোটি টাকার ওপরে সম্পদ আছে তাদের করহার বর্তমানের চেয়ে ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন তিনি। নতুন বাজেটে এই কর বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে যারা সার্জিক্যাল মাস্ক ও পিপিই তৈরি করবে তাদের ভ্যাট মওকুফ করা হচ্ছে। করোনা প্রতিরোধে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম আমদানি সহজলভ্য করতে শুল্ক ছাড় দেয়া হয়েছে। অবশ্য অর্থপাচার রোধে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করলে এবং কর ফাঁকি দিলে বড় অঙ্কের জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে নতুন বাজেটে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App