×

মুক্তচিন্তা

কৃষি বাজেট বনাম খাদ্য নিরাপত্তা

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২০, ০৯:১০ পিএম

কৃষি ও কৃষকের রাজত্ব কায়েম হয়েছে, ভূমিহীন/বর্গাচাষি তাদের রায়তি স্বত্ব ফিরে পেয়েছে এবং কৃষক পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকে, যা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সর্বোপরি বাজেট হোক প্রয়োগধর্মী বিশেষত গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে এবং কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশন বিষয়টি বিবেচনায় রাখবে এই প্রত্যাশা রইল।

এবার বাজেটের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ বরাদ্দ, যা ২২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের ৩.৬ শতাংশ, যা চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৮ শতাংশ কোটি টাকার বেশি। তার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় রয়েছে ২ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা, যা মূল এডিপির ১.২৩ শতাংশ। আবার অনুন্নয়ন-উন্নয়ন মিলে কেবল কৃষি খাতে যে ব্যয় ধরা হয়েছে তা নিয়ে অনেক কৃষি অর্থনীতিবিদ আপত্তি করেছেন, বিশেষত পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে। গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় অংশ দখল করে আছে কৃষি খাত, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। তাই এই খাতের উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন জড়িত, যা বাজেট বক্তৃতায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন করোনার বাস্তবতা মেনে নিয়ে জীবনের খাদ্য নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যেই প্রস্তাবিত হয়েছে আগামী বাজেট, যেখানে কৃষিনীতি-২০১৮, ভিশন-২০১১ ও ২০৪১, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, প্রেক্ষিত পবিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে প্রণয়ন করেছে কর্মপরিকল্পনা ২০২০ বিশেষত সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যেমন সাবেক কৃষিমন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, রপ্তানিকারক সমিতি ও কৃষি ব্যবসায়ী। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যেমন হারভেস্টার, রিপার, ট্রান্সপ্লান্টার, ট্রাক্টর ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রণোদনা রাখা হয়েছে।

এই কৃষি যন্ত্রপাতি কেনায় কৃষক পাবে বিরাট ভর্তুকি যেমন হাওরের জন্য ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য অঞ্চলের জন্য ৫০ শতাংশ। চলতি বছরে শ্রমিক সংকটের কারণে যান্ত্রিকীকরণের খাতে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় করা হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা এবং আগামী বছরে সারের ভর্তুকি বাবদ ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে। চলতি বছরে কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাতে ১২০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে আগামীতে ৩০০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে এবং এক ইঞ্চি জমি যাতে পতিত না থাকে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে যে বিএডিসি/ডিএইর মাধ্যমে বাগানবাড়ি, বসতবাড়ি, শহরে কৃষি সম্প্রসারণে ৫০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে বীজ ও চারা বিতরণসহ কৃষি পরামর্শ কাজে। কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে সরকারের ১০.৬ শতাংশ বরাদ্দ, যাকে সাধুবাদ জানাই।

সরকারের এ মহতী উদ্যোগের বাস্তব প্রয়োগ এবং এর মাধ্যমে সার্বিক কর্মসূচির সুফল আনয়নে আরো বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের কৃষি প্রশাসনকে কৃষকের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তাদের হাতে কৃষি সেবা পৌঁছানোর নিরপেক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথমত, কৃষকের জন্য ১০ টাকা মূল্যের ব্যাংক হিসাবসহ কৃষি কার্ডে মাধ্যমে সাহায্য-সহযোগিতার বর্তমান অবস্থা আরো জোরদারকরণ; দ্বিতীয়ত, দরিদ্র কৃষক কর্তৃক কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে ইউসিসিএকে কেন্দ্র করে প্রতিটি গ্রাম সমবায়ের আওতায় কৃষি পণ্যের সমষ্টিগত বিপণন ব্যবস্থা ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ গড়ে তোলা যায়; তৃতীয়ত, চাষাবাদ, পশু পালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভাবিত নতুন প্রজাতি সম্পর্কে ধারণা এবং গ্রহণের লক্ষ্যে মনমানসিকতা পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন জাতি গঠনমূলক বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত কৃষিভিত্তিক প্রশিক্ষণগুলোকে সমন্বিত করে যতদূর সম্ভব কৃষকের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়; চতুর্থত, হর্টিকালচার, পশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, বনায়ন, মৌমাছির চাষ ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বীকৃত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে সফলভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রত্যেক কৃষি কর্মীকে সেবা প্রদানের স্বার্থে কৃষি ভর্তুকির অংশ থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ একটি করে কিড বক্স সরবরাহ করা যেতে পারে; পঞ্চমত, কৃষি উপকরণের সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে সরকারি সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি সহযোগী সুস্থ প্রতিযোগিতার আবহ গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দেয়ার জন্য চাষিবান্ধব একটি প্রশাসনিক উদ্যোগ কৃষি ভর্তুকির অর্থে গ্রহণ করা যায় সরকার ঘোষিত কৃষি সেবা কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার, এনজিও, সিভিও, এসএসও, সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদসহ সবাইকে একযোগে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। তবেই বাজেটে প্রস্তাবিত ভর্তুকি এর জন্য প্রণীত লক্ষ্য অর্জন অনেকাংশে সহজতর হবে, যা পরবর্তীতে সফল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে; ষষ্ঠত, কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে তেমন কোনো বরাদ্দ প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখ নেই এবং বর্তমানে জলবায়ু সহিষ্ণু উফশী জাতের শস্য বর্তমানে ১০৯টি জাত রয়েছে, যার সংখ্যা প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে আরো বাড়াতে হবে। বর্তমানে নার্স সিস্টেমের আওতায় যেসব গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর কাজের সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) এবং বর্তমানে এই জায়গাটিতে অনেক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। একাধারে সরকারি বরাদ্দ কম অপরদিকে দাতা সংস্থার অনুদান সহায়তাও কমে যাওয়ায় গবেষণা তার জৌলুস হারিয়েছে। সরকার আগামী বছরের জন্য ৫০০ কোটি টাকার রি-ফাইন্যন্স স্কিম চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে, যা প্রশংসনীয়। একইভাবে সরকার কৃষি গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক অনুদান দিতে পারে বিশেষত প্রায়োগিক গবেষণায়; সপ্তমত, কোভিড ১৯-এর ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি বেশ সংকটে পড়েছে। তাই সরকার বর্তমান বছরে ৭ লাখ ৯৮ হাজার টন আমন ধান, ৮ লাখ টন বোরো ধান এবং ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল বোরো মৌসুমে সংগ্রহ করার টার্গেট নিয়েছে, এতে খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশে সুসংহত হবে; অষ্টমত, সরকার কৃষকদের জন্য পেনশন ভাতা চালু করতে পারে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এ ব্যাপারে ভারতের কেরালা রাজ্যের সফল উদাহরণ রয়েছে। ১৯৫৭ সালে কৃষি সংস্কারকে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রাধান্য দিয়ে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৫৯ সালে ভূমি সংস্কারের অধ্যাদেশ জারি করে ভূমি অধ্যাদেশ আইন পাস করে।

এর ফলে তৃণমূল জনগণের সামাজিক/রাজনৈতিক অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের কৃষি সংস্কার কর্মসূচিতে সম্পৃক্তকরণের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ সরকারের একটি যুগান্তকারী ঘটনা বলে বিবেচিত হয়েছে। ফলে কৃষি ও কৃষকের রাজত্ব কায়েম হয়েছে, ভূমিহীন/বর্গাচাষি তাদের রায়তি স্বত্ব ফিরে পেয়েছে এবং কৃষক পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকে, যা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সর্বোপরি বাজেট হোক প্রয়োগধর্মী বিশেষত গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে এবং কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশন বিষয়টি বিবেচনায় রাখবে এই প্রত্যাশা রইল।

ড. মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App