×

জাতীয়

করোনা থাবা বসাবে শিশুর শৈশবেও, বাড়াবে শিশুশ্রম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২০, ০১:৪৭ পিএম

করোনা থাবা বসাবে শিশুর শৈশবেও, বাড়াবে শিশুশ্রম

করোনার কারণে বাড়ছে শিশুশ্রম/ফাইল ছবি

করোনা থাবা বসাবে শিশুর শৈশবেও, বাড়াবে শিশুশ্রম
করোনা থাবা বসাবে শিশুর শৈশবেও, বাড়াবে শিশুশ্রম

শিশুশ্রম

মা’র মৃত্যুর পর বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করলো তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র মিলন। এর পরের বছরই মিলনের অটো-রিকশা চালক বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়। সংসারের টানাপোড়ন প্রকট হলো। প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরুনোর আগেই কামরাঙ্গি চরের এক অ্যালুমিনিয়াম কারখানার শ্রমিকের খাতায় নাম লেখায়। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৫ টা পর্যন্ত কারখানার মেশিনের ছাঁচে ফেলে তৈরি করে অ্যালুমিনিয়ামের থালা-বাটি। এর মধ্যে অবশ্য দুপুরে একটু সময় মিলে আধা ঘণ্টা। নির্দিষ্ট ওই সময়ের মধ্যে খেয়ে আসতে হয় বাড়ী থেকে। দীর্ঘক্ষণ এই শ্রমের বিনিময়ে সপ্তাহ শেষে মিলনের প্রাপ্তি হাজার টাকা।

হাজী লেহাজউদ্দীন অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরির মালিক মো. মামুন জানান, তারা শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করান না। প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকদের সহকারী হিসেবে তাদের রাখা হয়েছে।

অভাবের তাড়নায় মিলনের মতো অসংখ্য শিশু প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে শ্রমে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অশিক্ষা, ক্ষুধা দারিদ্র্যের মধ্যে বেঁচে থাকার সংগ্রামে অনেক শিশু বেছে নিয়েছে শ্রমকে। এই সুযোগে কম মজুরিতে ওই সব শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমেও। ফলস্বরূপ সারাবিশ্বে আশংকাজনক হারে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, করোনা মোকাবেলায় দেশের অর্থনীতির চাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই অবস্থায় দেশে স্বল্প মজুরিতে কাজ করানোর জন্য আবারো শিশুদেরকে শ্রমে নিয়োগের প্রবণতা বাড়তে পারে। সেই ব্যাপারে সরকারকে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ এবং একইসাথে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুরা যেন শ্রমে নিয়োজিত না হয়, সেই ব্যাপারে প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে শিশুশ্রমের তথ্য দেশে কত সংখ্যক শিশু শ্রমে নিয়োজিত এর সাম্প্রতিক কোনো তথ্য নেই। দেশে এ বিষয়ে সর্বশেষ সমীক্ষা হয়েছিলো ২০১৩ সালে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) পরিচালিত শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী দেশে সাড়ে ৩৪ লক্ষ কর্মজীবী শিশু রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ১৭ লক্ষ শিশু শ্রমে নিয়োজিত। এই ১৭ লক্ষ শিশুর মধ্যে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গৃহকর্মে নিযুক্ত।

[caption id="attachment_218117" align="aligncenter" width="700"] বন্ধ হোক শিশু শ্রম। সবার জন্য পৃথিবী হোক।[/caption]

আইএলও কর্তৃক ২০০৬ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪ লক্ষ ২০ হাজার শিশু গৃহকর্মী রয়েছে এবং এদের শতকরা ৮৩ ভাগ মেয়ে শিশু। ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, কেবলমাত্র ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার শিশু গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করছে। ১৪ বছর আগে পরিচালিত উক্ত সমীক্ষার পরিসংখ্যান ব্যতীত গৃহ শিশুশ্রম সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। এমনকি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার সার্ভে ২০১৩-এ গৃহ শিশুশ্রম সম্পর্কে কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই।

বাংলাদেশে সমগ্র কর্ম শক্তির ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু শ্রমের দ্বারা অর্জিত হচ্ছে। কোনো কোনো সমীক্ষায় দেখা যায় ৬২ শতাংশ। শিশুশ্রম গ্রামীণ কৃষিতে প্রয়োগ হচ্ছে, ১ লাখ ৪৯ হাজার শিশু শ্রমিক নিকৃষ্ট ধরণের কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে গ্রামীণ কৃষিখাতে বিরাট সংখ্যক শিশুশ্রমিক বিনা বেতনে কাজ করে থাকে। গ্রাম এবং শহর উভয়স্থানে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু দিন মজুর, ১৪ শতাংশ বিক্রয় কর্মী এবং ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবহনখাতে নিয়োজিত রয়েছে। গ্রামীন শিশু শ্রমিকের মধ্যে বেশীরভাগ সংখ্যক নিয়োজিত রয়েছে কৃষি খাতে। শহুরে শিশু শ্রমিকরা যেসব অনানুষ্ঠানিক খাতের সাথে যুক্ত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে; ছোট পোষাক কারখানা, পরিবহন খাত, সেবা খাত, গৃহ শিশুশ্রম, চামড়া শিল্প ইত্যাদি।

যেখানে রয়েছে চাকুরির অনিশ্চয়তা, দুর্ব্যবহার, অনিয়মিত মজুরী, অনির্দিষ্ট মজুরি, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, এমন কি শারীরিক মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যেও শিশুদেরকে জীবিকার তাগিদে কাজ করতে হয়। উল্লেখ্য, এসব শিশু শ্রমিকদের কারোই চাকুরির সুনির্দিষ্ট কর্মবিধি নেই। যার কারণে বঞ্চনার শিকার হলেও শিশু শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য দাবী আদায় করতে ব্যর্থ হয়।

[caption id="attachment_225411" align="aligncenter" width="700"] শিশুশ্রম[/caption]

শিশুশ্রম নির্মূলের ব্যপারে সরকারের প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত যতখানি সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল কোভিড-১৯ এর কারণে তা হুমকিতে পড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) পরিচালক আবদুস সহিদ মাহমুদ। শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন ২৭২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জাতীয় নেটওয়ার্ক বিএসএএফ। আবদুস সহিদ মাহমুদ বলেন, কোভিড-১৯এর মহামারি পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও অনিশ্চয়তা শুধু শিশুদের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েই দেয়নি, তার সাথে দেশে শ্রমজিবি শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশংকাও তৈরি করেছে। দেশে কোভিড-১৯ এর মত মহামারিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশু, পথশিশু এবং শ্রমজিবি শিশুরা কতটা অসহায় এবং নিরাপত্তাহীন তা জাতির কাছে সু¯পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই সকল শিশুদের কল্যাণের স্বার্থে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মত দেন তিনি।

একই অভিমত শিশু অধিকার বিশ্লেষক আবদুল্লা আল মামুনেরও। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এবারের বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস-২০২০ এর প্রতিপাদ্য হল; কোভিড-১৯ এর এসময় শিশুশ্রম থেকে শিশুকে রক্ষার সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে। কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারের অনেক শিশু বাবা-মায়ের রোজগার কমে আসাতে সামনের দিনগুলোতে শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের অনেকেই আগে থেকে স্কুলে ভর্তি আছে, যা এখন বন্ধ।

সামনের দিনগুলোতে এই শিশুরা যেন ঝরে গিয়ে শ্রমে নিয়োজিত না হয় সেজন্য এখন থেকেই স্কুলগুলোর বিশেষ ব্যবস্থার পরিকল্পনা করতে হবে। স্কুল খোলার পরপরই অনুপস্থিত শিশুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবক ও শিশুদের বুঝিয়ে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নাহলে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও শিশুশ্রমে শিশুর আগমণ বাড়তে পারে। নতুন বাজেটে এই শিশুদের কথা মাথায় রেখে স্কুলকেন্দ্রিক বিশেষ ভাতা বা আর্থিক প্রনোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, ব্যবসায়ী সমাজ ও সচেতন ব্যক্তিদেরকে তাদের নজরদারি বাড়াতে হবে, যাতে কোন শিশুকে কোন কর্মস্থলে নিয়োগ দেয়া না হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App