×

পুরনো খবর

মনপুরায় ফেলে রেখে মন, আমি ফিরি নগরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২০, ০৬:১৪ পিএম

মনপুরায় ফেলে রেখে মন, আমি ফিরি নগরে

সৌন্দর্যে ভিজতে ভিজতে মনপুরায় যেতে হয়। ছবি: ইউশা রহমান।

মনপুরায় ফেলে রেখে মন, আমি ফিরি নগরে

দিগন্তের ওপারে আকাশ

মনপুরায় ফেলে রেখে মন, আমি ফিরি নগরে

এপারে মনপুরা, ওপারে শুধুই শূন্যতা

মনপুরায় ফেলে রেখে মন, আমি ফিরি নগরে

ওপারে কে যে নিয়ে যাবে

মনপুরায় ফেলে রেখে মন, আমি ফিরি নগরে

প্রাণের উচ্ছাসও আছে

মনপুরায় ফেলে রেখে মন, আমি ফিরি নগরে

আছে শূন্যতার হাহাকারও

সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ার ঘণ্টাখানেক আগেই ভারী বর্ষণ হয়েছে। বর্ষণশেষে মৃত বুড়িগঙ্গাও যেন তীব্র স্রোতে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠলো। সামনে হয়তো নদীর প্রমত্ত রূপই দেখতে হবে। দক্ষিণে লঞ্চ যতদূর অগ্রসর হতে থাকবে এ অগাধ জলরাশির প্রসারতা ততই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বৃদ্ধি পেতে পেতে যে স্থানে গিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে প্রণয় হবে তার কিছুটা আগেই আমার গন্তব্য। মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত মনপুরা দ্বীপ। শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক’ এর কথা পেয়েছিলাম। বর্ষণমুখর এ দিনে কি মেঘনার সেই অকূলতা চোখে পড়বে? নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীকেন্দ্রিক অসংখ্য স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা প্রায় সকলেরই আছে। নদী তো বাঙালির অস্তিত্বেই মিশে আছে। নদীতে লঞ্চযোগে যাত্রা মানে নদীর দু’ধারে জনজীবন দেখতে দেখতে যাওয়া। এ যেন কালের নৌকার চেপে এককাল থেকে অন্যকালে অতিক্রম করা। মনে হয়, দু’পাশের জনপদগুলোর বিচিত্র সুখ-দুঃখের গল্পগুলো চোখে ধরা পড়ছে। কাজ শেষে ক্লান্ত কৃষকের নদীতে গোছলের প্রশান্তি নিজেও অনুভব করি। নদীর পাড়ে কলসী নিয়ে পানি তুলতে আসা নারীর চোখের কোণে জলের কারণগুলো যেন আমার জানা। [caption id="attachment_225433" align="aligncenter" width="945"] দিগন্তের ওপারে আকাশ। ছবি: সংগ্রহ।[/caption] লঞ্চ নিজস্ব গতিতে বিভিন্ন এলাকা অতিক্রম করে যাচ্ছে। এই অতিক্রমে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারনের পন্থা। একে একে নদীর নাম পরিবর্তন হতে থাকে, সাথে জলরাশি বাড়তেই থাকে। কখনো লঞ্চের বাইরে নীরবতা, ভেতরটা মানুষের আড্ডা-গল্পে জমজমাট। আবার কখনো তা হয়ে যায় বিপরীত। ভেতরে গভীর ঘুমে মানুষ, বাইরে নদীর সশব্দ ঢেউয়ের লীলা। কখনো রাতের আঁধারে বিশাল মেঘনার বুকে লঞ্চ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। দুচোখে কূলের সন্ধান যেনো মেলেই না। নদী এভাবেই ধীরে ধীরে সমুদ্রের বিশালতায় গিয়ে মিশে যায়। বিশালতায় সমর্পণ করা হয়তো জগতেরই নিয়তি। রাত অনেক হয়েছে। লঞ্চ প্রবহমাণ মেঘনার বুক চিরে অগ্রসর হচ্ছে। তখন ঝড়-বৃষ্টি নেই। তবে প্রমত্ত হতে মেঘনার বোধ হয় ঝড়-বৃষ্টি লাগে না। কবি শামসুর রাহমানের ‘শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক’ উপমাটির কথা আবার মনে পড়ে যায়। এ উপমা স্বাধীনতার বর্ণনা দিতে ব্যবহার করেছেন। স্বাধীনতার স্বাদ মেঘনার তীব্র স্রোতের মতোই আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রবেশ করুক এই কামনা করি। [caption id="attachment_225434" align="aligncenter" width="1280"] এপারে মনপুরা, ওপারে শুধুই শূন্যতা। ছবি: সংগ্রহ।[/caption] নদীকে বুঝতে গেলে শুধু চোখ দিয়ে নয়, মন দিয়েও তাকাতে হয়। নদীর বুকে জীবনের প্রতিচ্ছবিও যেন ভেসে ওঠে। আবার জলরাশির দিকে মন দিয়ে তাকালে বোঝা যায় নদীর এক নিজস্ব ভাষা আছে, শব্দ আছে। স্রোতের শব্দ শুনে মনে হয় মেঘনা বাক স্বাধীনতার পুরোটাই ভোগ করছে। নদীশাসনের মতো ভয়াবহ কাজ যেন জগতের কোনো নদীর বাক স্বাধীনতা হরণ না করে সে প্রত্যাশা করি। নদীগুলো কালের সাক্ষী হয়ে বয়ে চলুক নিরন্তর। রাতের আঁধারে চারিদিকে শুধু উত্তাল ঢেউয়ের শব্দ। এ ঢেউয়ে দুলতে থাকে জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। নৌকার বুকে টিমটিম করে জলে বাতি। জেলেরা রাত জেগে মাছ ধরেন, আহার করেন নৌকায়। এ যাত্রায় নদীনির্ভর মানুষের অর্থনৈতিক জীবন কেমন তার খানিকটা চোখে পড়বেই। জীবনে সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকতে হয় এ জেলেদের। বিভিন্ন পেশার মানুষের পদচারণায় বরাবরই মুখর থাকে লঞ্চ। যাত্রাপথে লঞ্চ কয়েকটি ঘাটে বিরতি নেয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন ভেতরের মুখগুলোর বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। কিছু পুরোনো মুখ চলে যায়, নতুন মুখ আসে। আবার মুড়ি-চানাচুর বিক্রেতা, বিভিন্ন মিঠাই বিক্রেতার আনাগোনা চলতেই থাকে। লঞ্চে রয়েছে খাবার ব্যবস্থা। আছে একাধিক চায়ের দোকান। [caption id="attachment_225435" align="aligncenter" width="800"] ওপারে কে যে নিয়ে যাবে। ছবি: সংগ্রহ।[/caption] এ ভ্রমণে আনন্দের অর্ধেক লঞ্চে, বাকি অর্ধেক মনপুরায়। ভোরের আলো ফোটার আগেই লঞ্চের সহকারী জানিয়ে দিলো মনপুরার পৌঁছার আভাস। তখন সূর্যের রাজকীয় আবির্ভাবের দৃশ্য ছিলো উপভোগ করার মতোই। সূর্যোদয়ের পরপরেই লঞ্চ মনপুরায় ঘাটে থামে। মনপুরায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের হিরণ্ময়ী বর্ণনা দেয়ার সামর্থ্য হয়নি। সেটা কবি-সাহিত্যিকরা দেবেন।
ইট-পাথরে আটকে থাকা জীবন থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির স্পর্শ পেতেই এ ভ্রমণ। মনপুরায় কাছে গিয়ে দেখা যায় স্থানীয়দের নদীনির্ভর ও কৃষিনির্ভর জীবনের চিত্র। এখানে উপভোগ করার মতো মনোরম বেশ কিছু জায়গাও আছে। অন্তত নদীর পাড়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইলে এর জুড়ি নেই। পর্যটক হিসেবে সবকিছুই যে অনুকূলে ছিলো তা বলার সুযোগ নেই। তবে জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী করেছে অনেকটাই।
এখানে বিভিন্ন জায়গায় আলাপ হয়েছিলো বিভিন্ন বয়সী ব্যক্তিদের সঙ্গে। অনেকে নিজ নিজ জীবনের গল্প শোনালেন। সুদূর অতীতকাল থেকেই এখানকার জীবন সংগ্রামের। প্রত্যেকের জীবনেই যেন আছে লড়াই-সংগ্রামের গল্প। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় সম্মুখীন হতে হয় প্রায়ই। আছে নদী ভাঙনের গল্প, মাঝপথে নৌকা ডুবে যাওয়ার গল্প, আছে তীব্র ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। বাঘ, হরিণ বা সাপের গল্পের জুড়ি এখানে নেই। একসময় দেখা যেতো কিনা জানা নেই, তবে এখন বাঘের বিচরণ নেই দ্বীপটিতে। কয়েকটি হরিণ আজও বিচরণ করে বলে জানালেন তারা। যাই হোক, নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তা। [caption id="attachment_225438" align="aligncenter" width="672"] আছে শূন্যতার হাহাকারও। ছবি: সংগ্রহ।[/caption] এ অঞ্চলের মানুষ নদীকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশে অভ্যস্ত। সময়ের বিবর্তনে মনপুরায় প্রবেশ করেছে নগরায়নের প্রভাব। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজও বিলীন হয়ে যায়নি। এখানে পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ যাতে স্থানীয়রা ও সরকারি-বেসরিকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নেয় সে আশা করি। ভ্রমণে স্বল্প সময়ে একটি সংস্কৃতির বাইরের অংশই দেখা যায়, ভেতরে প্রবেশ করা যায় না। এ অঞ্চলের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও এ সময়ে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। তবে পুরো যাত্রায় যে অভিজ্ঞতা পেয়েছি তা নিজেকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে। লেখক: তরুণ গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App