×

মুক্তচিন্তা

এই সময়ের জীবন, জীবিকা এবং মানবিকতা

Icon

nakib

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২০, ০৯:৩৮ পিএম

জীবন এবং জীবিকা মানব জীবনে এটিই সর্বাধিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যময় বিষয়। প্রত্যেক মানুষের জীবন তার কাছে সবচেয়ে প্রধান ও প্রাধান্যযুক্ত। আর জীবিকাবিহীন মানুষ তো জীবন বাঁচাতে পারে না। তাই জীবন যেমন জীবিকাও তেমনি প্রতিটি মানুষের কাছে সর্বাধিক প্রাধান্যযুক্ত এবং মূল্যবান। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের আগমনে ও বিস্তারে মানুষের জীবন-জীবিকা এখন চরম সংকটের মুখে। মরণঘাতী ব্যাধিটিতে আক্রান্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। অপরদিকে ঘাতক ব্যাধি থেকে বাঁচতে গৃহে অন্তরীণ হয়ে মানুষ প্রাণে বাঁচলেও জীবিকাবিহীন অবস্থায় অনাহারে মরার দশায় পড়েছে। কোনটি তারা বেছে নেবে, এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে দোটানার কবলে মানুষ। তাদের সামনে কোনো সম্ভাবনা তারা দেখছে না।

করোনা ভাইরাস তো কমেনি, বরং ক্রমাগত প্রমত্ত শক্তিমত্তায় মহামারি আকার ধারণ করেছে। আমাদের মতো সংখ্যাধিক্য দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের অবস্থা দাঁড়িয়েছে সর্বাধিক ভয়াবহ। শ্যাম রাখি, না কুল রাখি অবস্থা। জীবন বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদে জীবিকাহীন অবস্থায় তাদের পরিবার সমেত অনাহারে মরার দশা। অপরদিকে জীবিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে যে কোনো পেশার খোঁজে তারা লকডাউন উপেক্ষা করে পথে নেমেছে, নিজ এবং পরিবারের খাদ্য সংস্থানের অভিপ্রায়ে। এ দেশের মানুষদের অতীতে এমন ক্রান্তিকালের মুখোমুখি হতে হয়নি। সরকারের পক্ষেও বর্তমান অবস্থাকে সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দরিদ্র মানুষের আয়-রোজগারের স্বার্থে একমাত্র সীমিত পরিসরে লকডাউন পরিস্থিতি শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন আক্রান্তের এবং মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। লকডাউন শিথিলের কারণে পথে-ঘাটে লোক বেরিয়ে পড়ায় রোগ বিস্তারের সহায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর পরিণতিতে করোনা ভাইরাস মহামারি রূপ ধারণের সুযোগ পেয়েছে। যার পরিণতিতে দেশে আক্রান্তের এবং মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে নিকটজনরা পর্যন্ত মানবিকতা পরিত্যাগ করে রোগীর থেকে পালিয়ে যায়। কেউ কাছে পর্যন্ত ঘেঁষে না। আক্রান্তকে আপদ বলেই বিবেচনা করে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা-ভরসা নেই। সেটা এমনি এমনি জন্মেনি। চিকিৎসাসেবা যারা ক্রয় বা খরিদ করতে পারে তাদের ক্ষেত্রে সেবা প্রাপ্তি কিছুটা ঘটে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সরকারি হাসপাতালে অনেকটা চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করে। তাই দেশের শাসকশ্রেণি থেকে ব্যবসায়ী এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ পর্যন্ত বিদেশে ছোটে চিকিৎসাসেবা নিতে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা কি পরিমাণে নাজুক তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক সময়ের করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা নিয়ে। ডাক্তার-নার্স থেকে যারা চিকিৎসাসেবা দেবেন তারা পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর পাশে ঘেঁষছে না, ছোঁয়াচে এই রোগের ভয়ে। অপরদিকে সরকারও ডাক্তার-নার্সদের নিরাপত্তা দিতে না পারায় ইতোমধ্যে ডাক্তার-নার্সরা আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুবরণও করেছে। তবে আক্রান্ত রোগীদের মানবিক কারণেও চিকিৎসা প্রদান করছে না হাসপাতালগুলো।

জনমনে ধারণা জন্মেছে হাসপাতালে চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় না থেকে গৃহে থেকেই মৃত্যুবরণ করা শ্রেয়। করোনায় আক্রান্ত কিনা সেটা একমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা সম্ভব। এই করোনা পরীক্ষা নিয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। প্রতিদিন পরীক্ষা করতে যাওয়া হাজার মানুষ মাঝভোরে লাইন দিয়ে শেষে জানতে পারে, তিনশ মানুষের পরীক্ষা করা সম্ভব, এর বেশি নয়। অগত্যা সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে পরদিন যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফিরে আসে। পরীক্ষার জন্য লাইনে ঠেলাঠেলিতেও রোগ বিস্তারের পথ সুগম হচ্ছে। সামগ্রিক বিবেচনায় মানুষ দিক-দিশাহীন হয়ে পড়েছে বলেই সচেতনতা লোপ পেয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে আস্থার আলো দেখতে না পেয়ে, মানুষের আত্মসচেতনতা, মানবিকতা দেখতে না পেয়ে, আক্রান্তরা বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে।

করোনা থেকে নিরাময়ের কোনো প্রতিষেধক এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয়নি। এই ব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে গৃহে অন্তরীণ থাকাই একমাত্র উপায় বলে জোর প্রচারণা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সেই নির্দেশনা দিয়েছে। আমাদের মোট জনসমষ্টির সিংহভাগ মানুষের দীর্ঘমেয়াদে জীবিকাবিহীন অবস্থায় গৃহে অন্তরীণ থাকা সম্ভব নয়। গৃহে খাদ্যহীন অবস্থায় না খেয়ে মরা ছাড়া তাদের সামনে তো বিকল্প উপায়ও নেই। তাই পরিবারকে অনাহারি অবস্থা থেকে বাঁচাতেই পেশাহারা মানুষ জীবিকার জন্য নানা পেশায় যুক্ত হতে পথে বেরিয়ে পড়ছে। তাদের যদি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হতো, তবেই সরকারি নির্দেশনা তারা পালন করতে পারত। বাংলায় প্রবচন রয়েছে ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোসাই’, বিষয়টি দাঁড়িয়েছে অনেকটা তেমনই। সরকার লকডাউন ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু দিন আনে দিন খায় মানুষের জন্য বাস্তবিকভাবে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ত্রাণ বিতরণের নামে সরকারি দলের নেতাকর্মী, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ত্রাণ লুণ্ঠনের চটকদার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচিত প্রায় ৫০-৬০ জনের বহিষ্কারের সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে।

অধিক উৎপাদন, অধিক মুনাফার ফাঁদে বিশ্বের পরিবেশ-প্রকৃতি বিপন্ন এখন। পুঁজিবাদী অপতৎপরতার কারণেই বিশ্ব এখন মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদ কেবলই মুনাফা বোঝে। তার বাইরে কিছু বোঝে না। করোনা ভাইরাসের আগমন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ওই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দৌরাত্ম্যেই সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাধিটি প্রাকৃতিক নয়, মনুষ্য সৃষ্টি। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব থাকবে কি থাকবে না, সে প্রশ্নটিও সামনে চলে এসেছে। যে সমাজতান্ত্রিক চীন একসময় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল, সে চীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ধারণ করে বিশ্বে করোনা ভাইরাস বিস্তারে যদি ভূমিকা রেখে থাকে, তাহলে অবাক বিস্ময়ের কিছু নেই। পুঁজিবাদ মুনাফাবাজ যেমন তেমনি অমানবিক একটি ব্যবস্থাও। পুঁজিবাদের অমানবিকতা এখন তার সব স্তর অতিক্রম করে চূড়ান্তে পৌঁছেছে। পুঁজিবাদী তৎপরতাকে রুখতে পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন কেবল জরুরি নয়, অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

করোনা ভাইরাসে আমাদের জীবন ও জীবিকা আজ চরম সংকটের কবলে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন প্রতিষেধকের। সেটা আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেন বিশ্বে মানুষের অস্তিত্ব থাকবে বলেও ধারণা করা যাচ্ছে না। লকডাউন সাময়িক টোটকা মাত্র। স্থায়ী কোনো উপায় নয়। করোনা থেকে বাঁচতে অনাহারি মানুষকে গৃহে অবরুদ্ধ রাখা সম্ভব হবে না। যদি তাদের খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায়। জাগতিক এই রোগ প্রতিকারের কোনো উপায় না পেয়ে মানুষ আস্থা খুঁজছে ধর্মের কাছে। সুযোগের মওকায় মোল্লা-পুরোহিতেরা বলে চলেছে, ‘মানুষের ঈশ্বরপ্রীতি হারানোতে এবং ইমান নষ্ট হওয়ার কারণেই ঈশ্বরের গজব পড়েছে’। জাগতিক বিষয়কে কি ধৃষ্টতায় পারলৌকিক বিষয়ে ঠেলে দিচ্ছে ফতোয়াবাজ মোল্লা-পুরোহিতেরা। ধর্মের মানবিকতাকে পর্যন্ত অমানবিক বাক্যবাণে মানুষের অনাস্থার সুযোগ হাতাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রেও সরকার নীরব-নির্লিপ্ত। যেন সরকারের কোনো দায় নেই। নেই কোনো দায়িত্ব দেশের জনগণের জন্য।

এমন একটি অমানবিক পরিস্থিতি আমরা অতিক্রম করছি যে, আমরা কে বাঁচব, কে বাঁচব না এই মরণব্যাধি থেকে, সেটাও অনির্ধারিত। বিদ্যমান অব্যবস্থা নিরসন ব্যতীত আমাদের সামনে কোনো দিশা নেই। তাই ব্যবস্থা বদলেই আমরা মানবিক সমাজ, রাষ্ট্র পাব। আর ওই ব্যবস্থা যেমন আমাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তেমনি দেবে মুক্তিও।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App