×

মুক্তচিন্তা

সীমিত পরিসরের মৌসুমে বিস্তৃত বাজেট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২০, ০৬:০৮ পিএম

বাজেটে সরকারকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হয়েছে বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থান তৈরিতে। স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতও এর মধ্যে। এতে আগামীতে বাড়বে কৃষি খাতের ভর্তুকি। নতুন অর্থবছরে সরকারের পরিচালনা ব্যয় সংকোচনের মধ্যে রাখার তাগিদ আসছে করোনার শুরু থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও বলা হয়েছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে।

করোনা মহামারির জেরে অফিস-আদালত, দোকানপাট-মার্কেট, মসজিদ-মন্দির, গণপরিবহনসহ বিভিন্ন কিছুতেই ‘সীমিত পরিসর’। শত শতের পর মৃত্যু হাজার ছাড়িয়েছে। ঝুঁকিতে বিশাল জনগোষ্ঠী। কর্মহীন অনেকে। বেড়ে গেছে বেকারত্ব। উচ্চাসন থেকে তলানিতে নেমেছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। রাজস্ব আয়ে ধস। রেমিট্যান্স কমছে। রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে খরা। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় ভাটা পড়েছে অভ্যন্তরীণ চাহিদায়। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় সীমিত পরিসরে খুলতে খুলতে কিছু কিছু ক্ষেত্র আর সীমিত নেই। উদাম হয়ে গেছে অনেক কিছু। এ রকম সময়েই যথানিয়মে এলো আমাদের জাতীয় বাজেট। এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ বাজেট। চলার এ ধারা সামাজিক-পারিবারিক জীবনের জন্যও প্রযোজ্য। জীবন চলার পথে বাধা আসতেই পারে। তাই বলে সব থেমে যায় না। যেখানে বাধা আসে শতকষ্টের মাঝেও সেখান থেকেই শুরু করতে হয়। মৃত্যু বাড়ছে কি কমছে- সেই প্রশ্নের মধ্যেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ক্রমেই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। নতুন করে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন করা হচ্ছে। পরিস্থিতি কতটা নাজুক হতে পারে, সেটা ধারণা করা মুশকিল। প্রবৃদ্ধি কত হলো, আগামীতে কত হবে- এসব বিতর্কের চেয়ে মানুষের জীবন রক্ষাই এখন প্রধান লক্ষ্য। অর্থনীতির চলমান সংকট থেকে উত্তরণে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নেয়া সময়ের দাবি। টিকে থাকাই আমাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। করোনার এই কঠিন সময় সরকারসহ সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সবচেয়ে কমসংখ্যক সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে ঘোষণা হলো এ বাজেট। সীমিতের থিওরিতে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস পরেছেন সবাই। অধিবেশনে বসেছেন স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে একটি করে আসন ফাঁকা রেখে। বাজেট অধিবেশনে সাংবাদিক কিংবা বিশিষ্টজনদের উপস্থিত থাকার রেওয়াজেও ছেদ পড়ল এবার। আবার এমন বিশেষ পরিস্থিতিতে বাজেট দেয়াও আরেক অভিজ্ঞতা। চারদিকে সীমিত আওয়াজ দিলেও জীবন-জীবিকার প্রশ্নে পদক্ষেপ সীমিত করার উপায় নেই। বিশেষ করে বাজেটের প্রশ্নে। একদিকে খাদ্য, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যয় বাড়ানোকে সীমিত জায়গায় আনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে যাওয়ার দশায় পড়লেও তা হতে দেয়া যায় না। তাহলে জীবনের সঙ্গে জীবিকাও বরবাদ হবে। নেমে আসবে ভয়ানক মানবিক বিপর্যয়। কোনো সরকারই তা হতে দিতে পারে না। করোনার ধাক্কায় স্থবির হয়ে যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতিকে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতেই হচ্ছে। এর বিপরীতে আয় কমে যাওয়া বিশালসংখ্যক করদাতা এবং ভোক্তার ওপর করের চাপ কমানোর চাপও রয়েছে। বহুমুখী এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেই বিশাল বাজেট দিতে হয়েছে সরকার। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বিতীয় বাজেট এটি। ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে এবারের বাজেট বর্তমান অর্থমন্ত্রীরও দ্বিতীয় বাজেট। কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আর সীমিত পর্যায়ে নেই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বেড়েছে নিজস্ব অর্থের ব্যবহারে সক্ষমতা। সারা বিশ্বকে থমকে দেয়া করোনা জীবনের সঙ্গে জীবিকাকেও বিস্তৃতভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। কঠিন এই সময়ে ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতির ট্রেনকে লাইনে আনার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমার ছক করতে গিয়ে আগামী বছরেও উচ্চতর জিডিপির প্রবৃদ্ধির টার্গেট ধরতে হয়েছে। এখানে আবেগ কিংবা উচ্চাভিলাষ আপেক্ষিক। এর বাস্তবতা এড়ানো যায় না। আবার লেপ্টেও যাওয়া যায় না আবেগ-অনুভ‚তিতে। তাই আগামী বছরও ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা করছে সরকার। সামনে আরো কঠিন দিনের বার্তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দেশের মানুষের ভোগ কমে যাওয়া এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম নজিরবিহীনভাবে পড়ে যাওয়ায় ধরেই নেয়া যায়, সামনে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে। এজন্য আগামী বছর মূল্যস্ফীতির চাপ ৫ দশমিক ৪ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখতে চায় সরকার। মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা দেয়ার কমিটমেন্টও রয়েছে। অর্থনীতি তেমন না বোঝা মানুষও জানে, কঠিন চাপে দেশের অর্থনীতি। স্বস্তির চেয়ে এখন অস্বস্তিই বেশি। একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়া বাকি সব সূচকই নিম্নমুখী। আয় কম। ব্যয় বেশি। ব্যাংক থেকে ধার বেড়েছে। পরিস্থিতির কারণে এবার হয়তো উন্নয়নের চাপ কম এসেছে সারাদেশের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে। কিন্তু করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্য, খাদ্য ও সামাজিক সুরক্ষাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় বেড়ে গেছে। তার সঙ্গে রয়েছে বেতন-ভাতা, ভর্তুকিসহ অন্যান্য সাধারণ ব্যয়; কিন্তু বাড়েনি আয়। আবার রাজস্ব আয় বাড়ানোর সুযোগ সীমিত। কিন্তু সব ক্ষেত্রে বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনায় সীমিত থাকার সুযোগ নেই। আনুষ্ঠানিকতার নামে পাশ কাটানোরও রাস্তা নেই। তা আয়ের পথ সঙ্কুচিত হলেও। ব্যয় মাত্রা ছাড়ানো হলেও। ঋণের ঝড়ের মধ্যেও। করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি মানুষের জীবিকা নিয়ে বিস্তৃত কর্মযজ্ঞে যেতে হচ্ছে সরকারকে। বড় আকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি নিতে হয়েছে বিনিয়োগ বাড়ানোর টার্গেট। এরই মধ্যে আগামী বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির আকার ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছে। ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার এ বাজেট ঠিক করতে গিয়ে সরকার সব চেয়ে বেশি কষ্ট পোহাবে অর্থায়ন নিয়ে। এ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা টানার খবর অনেকেরই জানা। টার্গেট থেকে তারা অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা কম আদায় করবে। অর্থাৎ বাজেটের বিশাল আকারের ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বরাবরের মতো ব্যাংক খাতের ওপর ভর করতে হবে। আগামী অর্থবছর সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার টার্গেট ঠিক করেছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেবে ৮৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য ঋণ নেয়া হবে আরো ৫ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরে বৈদেশিক ঋণের টার্গেট ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। চলতি বছর সরকার ১১ মাসে ব্যাংক ঋণ নিয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। অথচ চলতি বাজেটে ঋণ নেয়ার টার্গেট ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে করোনা ভাইরাসকে ঘিরে সামনের দিনগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণ আসবে বলে নিজস্ব কিছু আশা-ভরসা রয়েছে সরকারের ভেতরে। এবারের বাজেটে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাজেটের অর্থায়ন। করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে এ বছর প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অথচ গত বছর সেটা হয়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ফলে এবারের বাজেটে রাজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। সেই আশায় একদিকে কালো টাকা সাদা করার আরো সুযোগ বাড়ানোর আগাম সংবাদ দিতে হয়েছে। অন্যদিকে বাড়াতে হয়েছে করের খাত, ক্ষেত্রসহ ফাঁকফোকর। আবার মানুষের আয়ও কমে গেছে। ফলে রাজস্ব সীমিত হয়ে পড়বে নিশ্চিত বলা যায়। সেটা ঠেক দিতে গিয়ে করজালের বিস্তৃতি বাড়ানো ছাড়া গতি নেই সরকারের। নতুন করদাতা শিকার করতে গিয়ে কোন পরিস্থিতি হবে- সেটা নানা শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। পর্যাপ্ত না হলেও বাজেটে সরকারকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হয়েছে বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থান তৈরিতে। স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতও এর মধ্যে। এতে আগামীতে বাড়বে কৃষি খাতের ভর্তুকি। নতুন অর্থবছরে সরকারের পরিচালনা ব্যয় সংকোচনের মধ্যে রাখার তাগিদ আসছে করোনার শুরু থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও বলা হয়েছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে। হুকুম মানা হলে সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণ কমাতে হবে। অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সভা-সেমিনারের নামে লুটপাট কমাতে হবে। কাজটি কঠিন।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App