×

সাহিত্য

সময়টা খুবই বেদনাদায়ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২০, ১১:০১ এএম

সময়টা খুবই বেদনাদায়ক

বীরেন সোম (চিত্র শিল্পী)

বীরেন সোম। বাঙালির উত্তাল সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তার রঙের ব্যবহার ও তুলির আঁচড় মুখর করে তোলে তার সময়কাল। সংগ্রামমুখর গণমানুষ মুক্তিযুদ্ধের সাহসিক উদ্দামতা ও শ্যামল শোভন স্বদেশভূমির শাশ্বত রূপ। তরুণ বীরেন সোম ছয় দফা আন্দোলন দেখেছেন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পাদপীঠে বসবাস করেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে আক্রান্ত ও বিপন্ন হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। এ সময়কালে তার অভিব্যক্তি ও চৈতন্য শুধু নীরবতায় অভিবাস করেনি। তিনি সক্রিয় সংগ্রামী লড়াকু ও যোদ্ধার ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার হাতে ধারণ করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধাস্ত্র রং ও তুলি, যা বিশ্বচৈতন্যকে তাড়িত, প্ররোচিত করে গণমানুষের সমর্থনে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানকালে বীরেন সোম ছিলেন তৎকালীন আর্ট কলেজের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রভ‚মি। তার সংলগ্ন আর্ট কলেজ ছিল সংগ্রামীদের ছাউনি। শুধু আশ্রয়স্থল নয়, এখানেই সে সময় প্রতিদিন জন্ম হতো সংগ্রামের নতুন নতুন ধ্বনি ও ভাষা। রং-তুলি-কালিতে কাগজের পর কাগজ চিহ্নিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত পুরো শহর। সকালের নগরবাসী চমকিত হতো, উদ্বেলিত হতো। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশনা বিভাগে একজন ডিজাইনার হিসেবে দায়িত্ব পালন তার জীবনের একটি স্মরণীয় অধ্যায়। দেশমাতৃকার মুক্তিব্রত উদযাপনে অংশ নিতে পেরেছিলেন, এ তার একান্ত অহংকার। এ ছাড়া তার এক শ্রমসাধ্য নিবেদন ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে শিল্পীদের ভ‚মিকা’ গ্রন্থটি। একটি অনালোকিত বিষয়ে প্রথম আলোকসম্পাতের এই কৃতিত্ব রাখার জন্য এ ক্ষেত্রে তাকে পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশিষ্ট এই শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধার করোনাকাল কেমন কাটছে ভোরের কাগজের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনার এই সময়টা আমার জন্য খুবই বেদনাদায়ক। মন মানসিকতা একেবারে সবকিছু ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে আমরা যারা শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, নাট্যকর্মী, সংগীতশিল্পী যারা আছেন, তাদের তো সমস্ত কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই মাঝে মাঝে কোথাও না কোথাও বসত, রিহার্সাল করত, গল্প করত, আড্ডা দিত। শিল্পকলার এই সেক্টরটায় সবার মন ভেঙে গেছে। সবচে বেশি খারাপ লাগে প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই দেখি মৃত্যু আর মৃত্যু। এই মৃত্যু সংবাদ দেখে প্রতিদিনের সকালটাই নষ্ট হয়ে যায়। এসব দেখে কাজ আর করতে পারছি না। মন না চাইলে ভেতর থেকে কোনো কিছু আঁকার প্রণোদনা আসে না। এভাবে ধীরে ধীরে মন মানসিকতা ভেঙে পড়েছে। চিন্তা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। তারপরও কিছু কিছু কাজ করার চেষ্টা করছি। ড্রয়িং ওয়ার্ক আর ছোট ছোট স্কেচ করছি। কিন্তু এতে তো মন ভরছে না। কারো সঙ্গে তো দেখা হচ্ছে না, আড্ডা হচ্ছে না। মন একেবারেই ভালো নেই। কিছু পড়া হচ্ছে কী না জানতে চাই। এই শিল্পী বলেন, আমি বই পড়ি কম। বই দেখি এবং আঁকিই বেশি। করোনা নিয়ে কোনো ছবি আঁকার কথা ভাবছেন কী না জানতে চাই এই শিল্পী বললেন, ভাবনার আকাশজুড়ে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ জমে আছে। তবে, সোমবার কসমস গ্যালারির আয়োজনে করোনা নিয়ে দিনব্যাপী একটা ভার্চুয়াল ওয়ার্কশপ করলাম। ওয়ার্কশপে ছিলাম আমি, মুহম্মদ ইউনূস, আনিসুজ্জামান, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, কনকচাঁপা চাকমা। উদ্দেশ্য করোনাবিষয়ক ছবি আঁকা। মনটা কিছুটা হলেও চাঙ্গা হলো। আমরা শিল্পীরা এক হতে চেষ্টা করলাম। পাশাপাশি বসে আঁকতে না পারলেও দূর থেকে আঁকলাম। উদ্দেশ্য তো এক। কিন্তু ওই ভয়াবহ রূপ ওভাবে ধরতে পারিনি। তবে, আমরা সিম্বলিকভাবে রঙের মধ্যে করোনার প্রতিচ্ছবি এঁকেছি, ওভাবে সরাসরি আনিনি। আমাদের আঁকা ছবিগুলো ভার্চুয়ালি প্রদর্শনী করে বিক্রি করা হবে। এর অর্থ করোনাক্রান্তদের সহায়তা দেয়া হবে। ওয়ার্কশপের মধ্য দিয়ে এই যে কাজের শুরুটা হলো আঁকার স্পৃহাটা বাড়ছে কিছুটা। আরো কাজের শক্তি এবং মনে জোর পেলাম। করোনার এই সময়টায় আপনার চেনা পৃথিবীটার কতটা বদল ঘটেছে বলে মনে করছেন? জবাবে এই শিল্পী বলেন, আমূল বদলে গেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে- ছোটবেলা থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা কিংবা কানাডা থেকে কেউ আসলে খুব লাফালাফি করতাম আর বলতাম, আহ অমুক কানাডা থেকে এসেছে, আমিও একদিন যাব। এই করোনার শক্তিটা সব ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আমি তো মরলেও কোনোদিন বিদেশে যাবো না। কেননা সব ম্যাসাকার হয়ে গেছে। সামনে আরো কত ম্যাসাকার হবে, আরো যে কতদিন এমন পরিস্থিতি থাকবে এবং আমরাও বেঁচে থাকব কী না জানি না। আপনি তো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, সেই যুদ্ধ আর এই যুদ্ধের মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পাচ্ছেন? জবাবে বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, একাত্তরে তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম একটা দেশ পাওয়ার আশায়। পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া, দেশটাকে মুক্ত করা সেটা ছিল অনেক বড় কঠিন শপথ। সেই চেতনা নিয়ে লড়েছিলাম। তখন বয়স ছিল কম। দেশের জন্য স্পিডটা বেশি ছিল। যেটা এখনো আছে। তখন আমাকে বসিয়ে দিয়ে আমি টানা পেইন্টিং করে যেতাম। কিন্তু সেই যুদ্ধ আর এই যুদ্ধের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে, অনেক তফাৎ। একাত্তরের যুদ্ধের বেনিফিট দেশের জন্য বিরাট বেনিফিট। করোনার যে বেনিফিট সেটা এখনো আবিষ্কার হয়নি। করোনার ওষুধ আবিষ্কার হতে অনেক সময় লাগবে। হাতে বন্দুক আর রাইফেল নিয়ে আর যাই হোক করোনা মোকাবিলা তো আর করতে পারছি না। দুটোর অ্যাঙ্গেল বা প্রেক্ষাপটই ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধে আমরা মুখোমুখি যুদ্ধ করেছি, আহত হয়েছি। কিন্তু এখানে যুদ্ধটা একতরফা হচ্ছে। তবে, বাঙালি লড়াকু জাতি। বাঙালি লড়ে যাচ্ছে, লড়ে যাবে। আমি আশাবাদী লড়তে লড়তেই আমরা জিতে যাব এবং ঘুরে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু এই করোনাকাল দীর্ঘায়িত হলে মুশকিল। অনেক প্রাণ যাবে। কারণ আমাদের ডাক্তারের সংখ্যা কম, হাসপাতালের সংখ্যা কম। একটা টেস্ট করতে দিলে এগার দিন পরে এর রিপোর্ট আসে। এর মধ্যে তো একের পর এক মানুষ মরেই যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমাদেরও অনেক আপনজনেরা মারা গেছেন। আমার বয়স এখন চুয়াত্তর। এটা দীর্ঘায়িত হলে আমি তো আর বাঁচব না। একটা জেনারেশনই শেষ হয়ে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App