×

অর্থনীতি

সংকট উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২০, ০৯:৩২ এএম

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতি প্রায় তছনছ হয়ে পড়েছে। কমে গেছে সরকারের আয়, বেড়েছে খরচ। এ দুরবস্থার মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শিরোনামে যে বাজেট তিনি উপস্থাপন করবেন তার আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। বাজেটে ঘাটতি সাধারণত ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। করোনার প্রভাবে প্রথমবারের মতো তা ৬ শতাংশ স্পর্শ করছে। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এদিকে করোনা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১০ খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে।

করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে এবারের বাজেট বক্তব্যেও অর্থমন্ত্রী ভিন্নতা রাখছেন। তিনি বাজেট বক্তৃতায় মানুষের জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবেন। বাজেট বক্তব্যের খসড়া অনুযায়ী জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী সুরা আল-বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য শেষ করবেন। বাজেট বক্তৃতায় তিনি আরো বলবেন, ‘করোনা ভাইরাসের এ মহামারিতে এবারের সময়টা একেবারেই ভিন্ন। এটা গতানুগতিক বাজেট নয়। এটা একটা আপৎকালীন বাজেট’।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ৪৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বাড়ছে। আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব আয় (অনুদানসহ) ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর অনুদান ছাড়া রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। সে হিসাবে রাজস্ব আয় বাড়ছে ১৯০ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে করবহির্ভূত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ছাড়া প্রাপ্তির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩ কোটি টাকা। আগামী বছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, বাজেটের যে আকারের কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। বাজেটের আকার নির্ভর করে রাজস্ব আদায়ের ওপর। আর আমাদের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির অবস্থা খুবই নাজুক। শুধু শুধু বিশাল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে লাভ নেই। এটা অর্জন করা যাবে না। তাছাড়া এত বড় বাজেট ব্যয় করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আছে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অনেক মন্ত্রণালয় ব্যয় করতে পারে না। তিনি বলেন, বাজেটে যে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তা পুরোপুরি অবাস্তব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, বড়জোর ৪ থেকে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। ঘাটতি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বড় ঘাটতি হতেই পারে। তবে আগামী বাজেটে সুশাসন, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, করোনাকে মাথায় রেখে আগামী বাজেটটি করা উচিত ৬ মাসের জন্য, যাকে বলা হবে করোনা বাজেট। মানুষের জীবন, জীবিকা ও পুনর্বাসনকে কেন্দ্র করেই ৬ মাসের সেই বাজেট করা উচিত। তিনি বলেন, বরাদ্দের দিক থেকে স্বাস্থ্য খাত ৫ নম্বরে। এ খাতে আমাদের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি গবেষণাও বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। ভবিষ্যতে রাজস্ব খাতকে সংস্কারের জন্য যে কার্যক্রম নেয়া হবে তা এ বাজেটেই থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর কথা বলা হলেও আগামী অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে আবর্তক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আবর্তক ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ধরা হয়েছে ৫৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। আর এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় করা হবে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। এডিপি ইতোমধ্যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আয় এবং ব্যয়ের বিশাল পার্থক্যের কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির (অনুদানসহ) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ৪৪ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বাড়ছে। ঘাটতি বাজেট পূরণ করা হয় অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে। আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৩২ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা।

অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে আগামী বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য ঋণ ৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়াসহ প্রণোদনার সুদ ব্যয়ের কারণে সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা করা হয়। নতুন বাজেটে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৬ হাজার চার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে ২১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। ফলে সংশোধিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আদায় করা সম্ভব হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর ১১ মাসের প্রাথমিক হিসাবে এই ঘাটতি ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এসব কারণ বিবেচনায় এনে রাজস্ব আয়ে ২৯ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। এতে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্য ২৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। ফলে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ৮ হাজার ১২৮ কোটি টাকা ঘাটতি বাড়ানো হয়েছে। এতে অনুদান ছাড়া সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। করোনার আঘাতে অর্থনীতির লণ্ডভণ্ড অবস্থায় সরকার তা কমিয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

গুরুত্বের শীর্ষে ১০ মন্ত্রণালয় : নতুন বাজেটের সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রায় অর্ধেকই রাখা হচ্ছে ১০ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৬ হাজার ১০৩ কোটি ১০ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৪ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ। করোনাকালীন সময়ে বাজেট ঘোষণা দেয়ার জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকায় তা দেয়া হয়নি। তবে চলতি বছরের তুলনায় ৫ হাজার ৭৭৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৫ হাজার ৭২৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

এদিক দিয়ে শীর্ষ বরাদ্দের পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে স্থাস্থ্যসেবা বিভাগ। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অনুক‚লে নিয়মিত বরাদ্দ রাখার পরও আরো ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বাজেটে। যা করোনা ভাইরাসের যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে খরচ করা যাবে। এদিকে শীর্ষ বরাদ্দের ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ে আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৪ হাজার ৪১ কোটি টাকা। শীর্ষ বরাদ্দের সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ বিভাগে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সম্ভাব্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ২৬ হাজার ৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।

এছাড়া শীর্ষ বরাদ্দের ৮ম তালিকায় আছে জননিরাপত্তা বিভাগ। আসন্ন বাজেটে এ বিভাগের সম্ভাব্য বরাদ্দের পরিমাণ ২২ হাজার ৬৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। চলতি বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ২১ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। শীর্ষ বরাদ্দের ৯ম অবস্থানে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ে নতুন বাজেটে সম্ভাব্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১৭ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে ১৬ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। এদিকে বরাদ্দের শীর্ষে দশম অবস্থানে রয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। আগামী অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App