×

মুক্তচিন্তা

যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশটি কি খুলে পড়ছে!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২০, ০৬:৫০ পিএম

যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশটি কি খুলে পড়ছে!

শাহীন রেজা নূর

যুক্তরাষ্ট্রের এই নাজুক অবস্থার মাধ্যমে এটিই প্রকট হয়ে উঠল যে, ছল-চাতুরি, হম্বিতম্বি আর যত্রতত্র শক্তি প্রয়োগের বুলি কপচিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার দিন বুঝি আমেরিকার জন্য ফুরিয়ে আসছে। তবে এ কথাও ঠিক যে, ক্ষমতাবানরাও এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন, সুতরাং আগামীতে তারাও আরো নানা প্রকারের ভানুমতির খেল দেখাতে যে তৎপর হবে এতে সন্দেহ কী!

বর্তমান মার্কিন নেতৃত্বের দিকে- বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বোল-চালের দিকে তাকালে ‘Fools rush in where Angels fear to tread’ এই ইংরেজি আপ্তবাক্যটি মনে পড়ে যায়! সেখানকার ঘটমান বর্তমান কি বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ আমেরিকার রুক্ষ-কঠিন পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার পরিচয় বহন করছে? এ প্রশ্ন এ কারণেই সঙ্গত যে, বিগত কয়েক দশকজুড়ে আমেরিকার যে চেহারাটি বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে তাতে এ ধারণা অমূলক নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে তার কর্তৃত্ব ও সামর্থ্য হারাচ্ছে। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বিশ্বকে দমিয়ে রাখার দিন বুঝিবা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতি টানতে চলেছে। এ অবধি যে আলামত দেখা যায় তাতে আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের উদগাতা কার্ল মার্কস ধারণা করেছিলেন যে, বিশ্বে সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা প্রথমে আমেরিকাতেই উড়বে। যদিও তার সে ধারণা সত্য হয়নি, তবে বর্তমানের সামগ্রিক পরিস্থিতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে হয়তো এ কথা মনে করা অসঙ্গত হবে না যে, সেদিন সুদূর নয় যেদিন মার্কিন মুল্লুকের গোটা অর্থনৈতিক চিত্রটিই অন্যরূপ ধারণ করবে। অর্থাৎ গুটিকয় মানুষের হাতে আর তা হয়তো বন্দি থাকবে না, সাধারণ কর্মজীবী মানুষের ভাগ এতে প্রতিষ্ঠিত হবে একদিন। যুক্তরাষ্ট্রে এক যাচ্ছেতাই লেজে-গোবরে অবস্থা বিরাজ করছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সব কিছুকেই জটিল করে তুলেছেন। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার ইত্যকার নানা কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে যে আমেরিকা এতকাল বিশ্বব্যাপী সর্দারি ও মাতব্বরি করে আসছে সেই মহাপরাক্রমশালী আমেরিকার আজ এ কি দশা! দুনিয়াব্যাপী মোড়লিপনা করা যে রাষ্ট্রের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল এবং ডাণ্ডাবাজি আর হুমকি-ধমকি ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে যে রাষ্ট্রটি সবার ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে আসছে তার আজ এমনি বেহাল অবস্থা যেসবের কাছে দেশটি এখন হাস্যাস্পদ ও ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে করোনা ভাইরাসের মতো এক ভয়ঙ্কর অণুজীব দেশটিকে নাকাল করে তুলেছে, অন্যদিকে আবার এক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে হত্যার অভিযোগে সেখানকার পুলিশ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে চলছে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ। বর্ণবাদের অবসানের দাবিতে গোটা যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। আর এর প্রবল ঢেউ এসে আঘাত করছে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার দেশে দেশে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবিমৃষ্যকারিতা, বেশুমার অসত্য ভাষণ, সব পরিস্থিতিকে হালকা করে দেখার মানসিকতা, প্রতিপক্ষের প্রতি অহেতুক ও উসকানিমূলক বিদ্রুপবাণ নিক্ষেপ, শ্বেতাঙ্গদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে হাস্যকর ও বালকসুলভ মন্তব্য, ধনশালীদের তথা বিগ বিজনেসকে সব রকম প্রণোদনা প্রদান আর আপামর খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য সামাজিক নেটওয়ার্কের আওতা হ্রাসসহ নানা রকম বুজরুকিপূর্ণ কাণ্ড-কারখানায় আমেরিকার এক বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন দারুণভাবে ক্ষুব্ধ আর সেটিই পরিষ্কারভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে সেখানকার বর্তমান অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে। প্রথমত, করোনা ভাইরাসকে ঘিরে ট্রাম্প সাহেব যে নাটক করে চলেছেন তাতে এমনিতেই মানুষ যারপরনাই বিরক্ত হয়ে উঠছিল আর এর ওপর যখন গোদের ওপর বিষফোঁড়ারূপে পুলিশের হাতে মিনিয়াপোলিসের এক কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনা ঘটে তখন মানুষের ধূমায়িত রোষ আর কোনো বাধা মানেনি। মহাসমুদ্রের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ঢেউয়ের আছাড়ি-বিছাড়িতে এখন গোটা মার্কিন মুল্লুক নাস্তানাবুদ হওয়ার জোগাড়। আগামী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ট্রাম্প কত ধরনের যে ক‚ট-কৌশল প্রয়োগ করে চলেছেন তার ইয়ত্তা নেই! তার নিজের দলের মধ্যে এবং তার অনেক নিজস্ব এবং বিশিষ্ট কর্মকর্তার মধ্যেও তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ সঞ্চারিত হতে দেখা যাচ্ছে। দেশব্যাপী ক্ষোভ-বিক্ষোভ এমন আকার ধারণ করেছে যে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করে ও হাজার হাজার ন্যাশনাল গার্ড নামিয়েও তা প্রশমিত করা যাচ্ছে না। বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউসহ সব রকমের কঠোর আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, গুলিবর্ষণ ইত্যাদি ঘটনাও ঘটে চলেছে দেদার। যা হোক, ট্রাম্প সাহেব বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে চেয়ে প্রবল সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। শুধু কি তাই, সার্কাসের ক্লাউনের মতো নানা হাস্য-রসাত্মক উক্তি করে আর ঢালাওভাবে তার সমালোচকদের বিরুদ্ধে বেশুমার অভিযোগের পাহাড় রচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকেই বিপন্ন করে তুলেছেন। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের আন্দোলনের চেহারা ও চরিত্রকেও হার মানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান লুটতরাজ ও অরাজকতা। অভিযোগ আছে যে, শেতাঙ্গদের মধ্যে কেউ কেউ উসকানি জুগিয়ে পরিস্থিতি অন্য খাতে প্রবাহিত করার চক্রান্ত করে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরের ও বাইরের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি অভিযোগ তুলেছেন যে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে দ্বিধাবিভক্ত করে ছেড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের সব স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার মুখে চুনকালি লেপন করে ট্রাম্প দেশটির সব অর্জন, গৌরব ও চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। ইতোমধ্যে চারজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট যথা- ওবামা, বুশ, ক্লিনটন ও কার্টার কঠোর সমালোচনা করেছেন ট্রাম্পের।

এ কথা অস্বীকার করা যাবে না নিশ্চয়ই যে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের কপালে বর্ণবাদের কলঙ্ক তিলক এঁটে দিয়েছেন। বহু মার্কিন সাবেক ও বর্তমান ক‚টনীতিক ট্রাম্পের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি-কৌশলে দারুণভাবে বিব্রত বোধ করেছেন এবং বলেছেন যে, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার প্রশ্নে ‘আমরা দেশে দেশে যে নসিহত করে ফিরি তা যে লোক দেখানো ও কেবলই নিজ স্বার্থ উদ্ধারের পাঁয়তারা বিশেষ এমনটাই মনে করা স্বাভাবিক এখন’। যুক্তরাষ্ট্র তার মোড়লিপনা বজায় রাখতে দেশে দেশে রাজনৈতিক নেতাদের নির্মমভাবে হত্যা ও সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে উৎখাতের জন্য সেখানে অরাজকতা সৃষ্টির এমন কোনো জঘন্য ও গণবিরোধী ভ‚মিকা নেই যাতে কিনা শামিল হয়নি বা হয় না। এর ভ‚রি ভ‚রি প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বিগত সাত-আট দশকের ইতিহাসের পাতায় পাতায়। চিলিতে আলেন্দে, ঘানায় নক্রুমা, তুরস্কে মেন্দেরেজ, ইরাকে বাদশাহ ফয়সাল, ফিলিপাইনে একিউনো, কংগোতে প্যাট্রিস লুমুম্বা, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ন, আফগানিস্তানে জহির শাহ, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু, আর্জেন্টিনায় পেরোন, নিকারাগুয়ায় চে গুয়েভারা এমন অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হতভাগ্যের মধ্যে গুটিকয় মাত্র! ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার গাদ্দাফিকে উৎখাত, হত্যা ও তাদের সাজানো বাগানরূপী দেশ দুটিকে কি জঘন্য মিথ্যাচার ও বর্বরোচিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হলো তা তো আমরা জগৎবাসী প্রত্যক্ষ করলাম। ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভ‚মি থেকে কী নির্মম-নৃশংসতায় উচ্ছেদ করা হয়েছে তাও কারো দৃষ্টি এড়ায়নি! একাত্তরে আমাদের ওপর হানাদার পাকিস্তানিদের পৈশাচিক নির্মমতাকে যুক্তরাষ্ট্র ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলে অভিহিত করে কি কায়দায় হানাদারদের মদদ জুগিয়েছিল নিজ হীন স্বার্থে তাও কারো অবিদিত নয়। কথায় বলে ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’, এবার যুক্তরাষ্ট্রের এই নাজুক অবস্থার মাধ্যমে এটিই প্রকট হয়ে উঠল যে, ছল-চাতুরি, হম্বিতম্বি আর যত্রতত্র শক্তি প্রয়োগের বুলি কপচিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার দিন বুঝি আমেরিকার জন্য ফুরিয়ে আসছে। তবে এ কথাও ঠিক যে, ক্ষমতাবানরাও এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন, সুতরাং আগামীতে তারাও আরো নানা প্রকারের ভানুমতির খেল দেখাতে যে তৎপর হবে এতে সন্দেহ কী! অবিশ্যি, করোনা ভাইরাসের এই দোর্দণ্ড প্রতাপ থেকে সেখানকার সব মহলের মানুষ কিছু শিক্ষা পেলে হয়তো বা পরিস্থিতির খানিক গুণগত পরিবর্তন হলেও হতে পারে! আগামী দিনগুলোতে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে নিশ্চয়ই!

শাহীন রেজা নূর : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App