×

মুক্তচিন্তা

মানুষ সামাজিক জীব কথাটা ভুলেই যাচ্ছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২০, ০৬:১২ পিএম

এতদিন জানতাম মানুষের পাশে দাঁড়াতে গেলে পথে নামতে হয়, এবার জানলাম মানুষের পাশে দাঁড়াতে গেলে ঘরে থাকতে হয়। মানুষ যে সামাজিক জীব এ কথাটাই ভুলিয়ে দিয়েছে করোনা নামক মহামারি। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে সমাজ আর শরীরের মধ্যে একটা অদৃশ্য আত্মিক বন্ধন আছে সেখানে সামাজিক দূরত্বের ব্যাখ্যা একটা ভিন্ন মাত্রিকে হওয়ার দাবি রাখে। সমাজ বলতে আজো আমাদের দেশে যে অবয়বটা বেঁচে আছে তা পাশ্চাত্য সমাজ থেকে ভিন্ন। আজো হাজার মাইল দূরে চাকরি করা স্বামীর জন্য যখন আকুল পরানে পথ চেয়ে থাকে স্ত্রী তখন শারীরিক দূরত্বে হাজার মাইল কিন্তু সামাজিক নৈকট্যে কত পাশে! আবার একই বৈঠকখানায় মনিব আর ঝি একসঙ্গে বসে টিভি দেখলেও শারীরিক অবস্থানে পাশাপাশি কিন্তু সামাজিক দূরত্বে বহুদূর! আজো এদেশে বিয়ের চিঠিতে লিখতে হয় পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণজনিত ত্রুটি মার্জনা করবেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে সশরীরে আসতে না পারা এদেশে আজো ত্রুটির পর্যায়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সামাজিক সম্পর্ক শিথিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সামাজিক মাধ্যমের বন্ধু আর ছেলেবেলার কাদামাখা শরীরে মাঠে জাপটে ধরা বন্ধু আজো আমাদের কাছে এক নয়। এদেশে আজো এক গামছায় তিনজন গা মুছে, এক বিছানায় পুরো পরিবার ঘুমায়, এক থালে তিন সন্তান ভাত খায়। এখানে তফাৎ যাও বলত সম্পর্ক ভাঙার নামান্তর। যেসব দেশ থেকে সামাজিক দূরত্বের নিদান এসেছে তাদের সমাজ বলতে কী বোঝায় তা আমি স্পষ্ট নই। তবে তারা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখে শুনেছি। তার কারণ শুধু মানসিকতা নয়, এই মানসিকতাকে ফলিত প্রয়োগে নেয়ার পরিসরও বটে। আমাদের দেশে লোকাল ট্রেনে-বাসে যেভাবে মানুষ চলে সেসব দেশে তা কল্পনাও করা যায় না। এর মানে এই নয় যে খাসলত দোষে আমরা বাসে বাঁদরঝুলা হয়ে যাই। আমাদের জনসংখ্যা অনুপাতে পরিকাঠামো নেই, ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ নেই, সুযোগ থাকলেও সামর্থ্য নেই। তাই সংক্রমণের ভয় বেশি দীর্ঘ হলে আমরা প্রবল সমস্যায় পড়ব। শারীরিক ব্যাধির সঙ্গে সামাজিক সমস্যাও বাড়বে। কঠিন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন হাসপাতালের ভোগদশা কাটিয়ে ছাড়া পেলে সে আর্থিক ও মানসিকভাবে যেভাবে ভেঙে পড়ে, আগের মতো সুস্থ সবল উচ্ছল হতে সময় লাগে, করোনা-পরবর্তী কালও আমাদের জন্য তেমনি হবে। করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টরে অর্থনীতি আসবে এক নম্বরে। ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবার লাল সুতো বেরুবে। পর্যটন, পরিবহন থেকে পাইকার কেউ ছাড়ান পাবে না। তারপরই আসবে আমাদের মতো দেশগুলোর ভেঙে যাওয়া সামাজিক আর মানসিক স্বাস্থ্যের কথা। সামাজিক দূরত্ব রাখতে গিয়ে আমরা যেভাবে সমাজ বিচ্ছিন্ন হচ্ছি তার জোরণ আবার হবে তো? সহপাঠীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছেলেপুলেরা আবার প্রাণচঞ্চল হতে পারবে তো? পড়াশোনায় মন বসাতে পারবে তো? রোগের ভয়ে, শাস্তির ভয়ে আমরা চলছি। কিন্তু যেই আইন শিথিল হবে আমরা আবার এলোমেলো হয়ে যাব। তখন আমি বা আমার মতো যারা নিয়ম মেনে হাটে বাজারে, অফিসে আদালতে দাঁড়াবে তাদের টপকে অন্যরা আগে চলে যাবে। ঘর থেকে বেরিয়ে রোজ কত লোকের সঙ্গে ঝগড়া করব, নীতিবাক্য কপচাব, মন কষাকষি করব। রোজ রোজ কার এসব ভালো লাগবে। বরং নির্ভেজাল, ন্যায়পরায়ণ মানুষের জন্য এ এক উটকো ঝামেলার কারণ হবে। বিশৃঙ্খল লোকই যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন ধরতেই হবে যে এই বিশৃঙ্খলতার সঙ্গে আমরাও প্রযুক্ত। আর এই বিশৃঙ্খল ‘গণ’কে নিয়েই গণতন্ত্র। প্লেটোর মতে-‘পযধৎসরহম ভড়ৎস ড়ভ মড়াবৎহসবহঃ ভঁষষ ড়ভ াধৎরবঃু ধহফ ফরংড়ৎফবৎ.’ তবু এই বিশৃঙ্খল-সুশৃঙ্খল, ভদ্র-কপট, মন্দ-ভালো নিয়েই আমাদের দিনলিপি। এরাই আমাদের যাপন কথার কুশীলব, জীবনের ছন্দ, মনের সায়। এদেরই কেউ রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়া মানুষ দেখলে ভিড় করে, পরাপর ভেদ না করে হাসপাতাল নিয়ে যায়। প্রতিবেশীর দোকানে আগুন লাগলে জীবন বাজি রেখে বালতি দিয়ে জল এনে আগুন নিভাতে চায়। গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে পালা করে রাত জাগে। করোনা দীর্ঘায়িত হলে এই দয়া, এই সৌহার্দ, এই আপনাপন তছনছ হয়ে যাবে। যদিও সময়ের নিয়মেই একদিন সব আবার ঠিক হবে। দেশ নিজের ছন্দে ফিরবে, অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরবে। আনন্দে আলিঙ্গনে, কলহে কলকোলাহলে সমাজ আবার মুখরিত হবে কিন্তু এও জানি তা কত কষ্টসাধ্যই না হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত রণভ‚মিতে সবুজায়ন যতটা কঠিন, করোনা-পরবর্তী সময় তার থেকে কিছুটা কম হবে বলে তো মনে হয় না!

কলাম লেখক,ভারত থেকে।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App