×

মুক্তচিন্তা

বর্ণবাদের কদর্যতা সাফ করুক!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২০, ০৬:৫৯ পিএম

বর্ণবাদের কদর্যতা সাফ করুক!

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

বর্ণবাদ ততদিন থাকবে, যতদিন সাদা গাড়িগুলোর কালো চাকা থাকবে; দুর্ভাগ্য বোঝাতে কালো আর শান্তি বোঝাতে সাদার ব্যবহার যতদিন থাকবে ততদিন বর্ণবাদ থাকবে; বিয়ের পোশাক সাদা আর শবযাত্রার পোশাক কালো থাকবে ততদিন বর্ণবাদ থাকবে; কর খেলাপি বা মন্দলোককে যতদিন সাদা নয়, কালো তালিকাভুক্ত করা হবে, ততদিন বর্ণবাদ বেঁচে থাকবে।’ অতএব আমার একান্ত এবং আন্তরিক প্রত্যাশা হচ্ছে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু যেন সমাজে এবং মগজে বিদ্যমান বর্ণবাদের কদর্যতা খানিকটা হলেও সাফ করে দেয়!

১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার পর নব্বই বছর লেগেছিল আমেরিকার রাষ্ট্রযন্ত্রের আইনি পরিকাঠামো থেকে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করতে, কেননা আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় ১৮৬৫ সালে। দাসপ্রথার মূলমন্ত্র ছিল বর্ণবাদ। অথচ অফিসিয়ালি দাসপ্রথা বিলুপ্তির প্রায় দেড়শ বছর পরও ২০২০ সালে এসে জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম মৃত্যু একটি নিষ্ঠুর সত্যকে আমাদের সামনে এনে হাজির করে। একটি আধুনিক, সভ্য, উদার এবং উন্নত রাষ্ট্র দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের তলে তলে বিরাজ করছে এক কুৎসিত বর্ণবাদ। আর এ বর্ণবাদের নির্মম কুরবানি হচ্ছে জর্জ ফ্লয়েড। তাই জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু কেবল একটি দুর্ঘটনা নয় কিংবা একটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় বা কোনো একজন ব্যক্তির একটা ক্রিমিন্যাল অফেন্স বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নয়; বরঞ্চ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে মার্কিন সমাজে বিদ্যমান শত শত বছর ধরে জারি থাকা এবং সভ্যতার মুখোশে ঢাকা একটি বিকৃত এবং বীভৎস বর্ণবাদের একটি অসভ্য চেহারাকে উন্মোচিত করেছে। তাই জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে ২০১০ থেকে ২০১২ সালে সংগঠিত আরব বসন্তের আদলে যে ‘আমেরিকা স্পিং’-এর অবতাড়না হয়েছে, আমরা চাই এটা যেন একটা প্রতিফল (আউটকাম) এ পৃথিবীকে দেয়। আমরা চাই, জর্জ ফ্লয়েড যেটা ‘জীবন’ দিয়ে করতে পারেনি, সেটা তার ‘মৃত্যু’ দিয়ে করে যাক। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৫ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে। এক খাবারের দোকানের কর্মচারী ৯১১ নম্বরে কল করে অভিযোগ করেন, এক ক্রেতা সিগারেট কেনার পর তাকে ২০ ডলারের জাল নোট দিয়েছে। ওই অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ আসে এবং ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেপ্তার করে। এরপর একজন পুলিশ তাকে রাস্তায় ফেলে নিজের হাঁটুর নিচে ঘাড় দিয়ে দীর্ঘ ৮ মিনিটের বেশি সময় ধরে চেপে ধরে রাখেন। এ সময় ফ্লয়েড ‘আই ক্যান নট ব্রেথ, আই ক্যান নট ব্রেথ’ বা আমি শ্বাস নিতে পারছি না বা আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না বলে আকুতি-মিনতি করে কিন্তু পুলিশ এতে কোনো কর্ণপাত না করে তার শ্বাস বন্ধ হওয়া পর্যন্ত হাঁটু নিয়ে ঘাড় চেপে ধরে। এতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় জর্জ ফ্লয়েড। দশ মিনিটের এ ভিডিও যখন ভাইরাল হয়, তখন বিষয়টি নিয়ে চতুর্দিকে হৈচৈ পড়ে যায় এবং বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মিনেসোটাসহ আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য। এ বিক্ষোভ এখন আর শুধু আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ নেই; বরঞ্চ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবীতে। লন্ডনের ট্রাফাগাল স্কোয়ারে ও পার্লামেন্ট স্কোয়ারে গত ৫ মে বর্ণবাদবিরোধী এক বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট ও হ্যামবার্গে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের সমাবেশ ঘটে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিচার চেয়ে এবং বর্ণবাদের নিপাত চেয়ে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরার সংসদ ভবনের সামনে পদযাত্রা হয়। অস্ট্রেলিয়ার পদযাত্রায় বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভের পাশাপাশি আদিবাসীদের প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ প্রদর্শিত হয়। নরওয়েতে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ অথচ এ বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে অসংখ্য মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। ‘তোমার যন্ত্রণা, আমারও যন্ত্রণা’, ‘তোমার লড়াই, আমার লড়াই’, ‘আমিও নিশ্বাস নিতে পারছি না’, ‘বর্ণবাদ নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক’ প্রভৃতি ব্যানার এবং ফেস্টুন নিয়ে এ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে নেদারল্যান্ডস, লাইবেরিয়া, ইতালি, কানাডা, গ্রিস এবং পৃথিবীর আরো অসংখ্য দেশে। কিন্তু বিশ^ব্যাপী হাজার হাজার এবং লাখ লাখ মানুষের বর্ণবাদবিরোধী এ সভা-সমাবেশ এবং প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কিন্তু নতুন নয়। ১৯৬৮ সালে এ রকমই একটি বর্ণবাদী ঘটনার শিকার হয়ে কিং গুলিবিদ্ধ হয়ে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে। এর প্রতিবাদে এবং বর্ণবাদের নিপাত চেয়ে লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে, কিন্তু ১৯৬৮ সালের পর পৃথিবীতে বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, বর্ণবাদী আচরণ এবং বর্ণবাদের কারণে অত্যাচার-নির্যাতন কি কমেছে? কমেনি বরঞ্চ কোনো কোনো অংশে বেড়েছে। আর কমেনি বলেই আজ ২০২০ সালে এসেও হাঁটুর নিচে ঘাড় দিয়ে দম বন্ধ করে মরতে হয় জর্জ ফ্লয়েডকে। এ বছরেরই ফেব্রুয়ারিতে প্রায় একই কারণে মরতে হয়েছিল আহমেদ আবরেরিকে কিংবা ব্রেইন টেইলরকে। সুতরাং বর্ণবাদ হয়তো কাগজে-কলমে মুছে যাবে কিন্তু অনুশীলন, চর্চা এবং প্রয়োগে বর্ণবাদ সহজ থেকে যাওয়ার কথা নয়। কেননা বর্ণবাদ ঐতিহাসিকভাবে বাস করে সমাজের অভ্যন্তরে স্তরায়িত সমাজ কাঠামোয়, অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভেতরে, উৎপাদনের অসম বণ্টনে এবং ক্ষমতার অসম বিন্যাসের ভেতরে। মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রাম এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পাওয়া যাবে মানবসভ্যতার ইতিহাসে বর্ণবাদের ভয়াবহ নির্মমতার ইতিহাসকে। খোদ আমেরিকার বর্ণবাদের ইতিহাস নিষ্ঠুরতার শ্রেষ্ঠতম ইতিহাসের মধ্যে পড়ে। তাই নিজেদের সভ্য, আধুনিক, উদার এবং উন্নত প্রমাণের একটা মেকি চেষ্টা থেকে আমরা রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোয় ‘বর্ণবাদবিরোধী’ একটা সাইনবোর্ড ব্যবহার করি বটে কিন্তু অন্দরমহলে, অর্থাৎ রাষ্ট্রকাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ণবাদের বিকৃত চর্চা এবং প্রয়োগ আমরা লক্ষ করি পৃথিবীর দেশে দেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেটা এখন প্রকট চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে এবং খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই এর সবচেয়ে বড় গুনাহগার। কারণ ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী এজেন্ডায় ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন ‘হোয়াইট ন্যাশনালইজম’ বা মূলত আধুনিক সমাজের বর্ণবাদের এক বিকৃত মনোবৃত্তি ছাড়া কিছুই নয়। এবং মানুষ এ হোয়াইট ন্যাশনালইজমের প্রতি সমর্থন দিয়েছিল বলেই ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ফলে সাদা কর্তৃক কালো নির্যাতিত হবে ট্রাম্পের সা¤্রাজ্যে এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা সাদাত্বকে রাষ্ট্রের কাঠামোয় চাষ করার জন্যই ট্রাম্পকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই, যদিও মানুষ হিসেবে একটা বড় সংখ্যক মার্কিন নাগরিক যে উদার, মানবিক এবং বর্ণবৈষম্যের বিরোধী সেটাও অনস্বীকার্য। তাই তো আশার কথা এই যে, মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের বাইরেও আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যেও শামিল হচ্ছে, জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিচার দাবি করছে এবং পৃথিবী থেকে বর্ণবাদ নির্মূলের কোরাসে গলা মিলাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়াজ উঠছে। ফ্লয়েডের মৃত্যু পৃথিবীতে বর্ণবাদবিরোধী মানুষের আকাক্সক্ষাকে, বর্ণবাদবিরোধী মানুষের মনোবৃত্তিকে এবং বৈষম্যবিরোধী মানুষের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর একটা মওকা তৈরি করে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এ আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ তখনই সার্থকতা পাবে যদি এ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র কাঠামোর আইনি পরিকাঠামোর ভেতর থেকে বর্ণবাদ দূরীকরণের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত শাসকশ্রণির মন ও মানস থেকে মানুষের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি বর্ণবাদ দূরীভ‚ত হয়। কেননা বর্ণবাদ বাস করে মানুষের চিন্তায়, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে, মানুষের মজ্জায় এবং মানুষের মানসিকতায়। জিম্বাবুয়ের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের কয়েকটি বাক্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে বেশ কিছুদিন থেকে, যদিও এটা মুগাবের বক্তব্য কিনা তার কোনো অথেনটিক সূত্র নেই। তথাপি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বাক্যগুলো এ প্রবন্ধের ইতিটানার জন্য আমি যুক্তিযুক্ত মনে করছি কেননা, ‘বর্ণবাদ ততদিন থাকবে, যতদিন সাদা গাড়িগুলোর কালো চাকা থাকবে; দুর্ভাগ্য বোঝাতে কালো আর শান্তি বোঝাতে সাদার ব্যবহার যতদিন থাকবে ততদিন বর্ণবাদ থাকবে; বিয়ের পোশাক সাদা আর শবযাত্রার পোশাক কালো থাকবে ততদিন বর্ণবাদ থাকবে; কর খেলাপি বা মন্দলোককে যতদিন সাদা নয়, কালো তালিকাভুক্ত করা হবে, ততদিন বর্ণবাদ বেঁচে থাকবে।’ অতএব আমার একান্ত এবং আন্তরিক প্রত্যাশা হচ্ছে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু যেন সমাজে এবং মগজে বিদ্যমান বর্ণবাদের কদর্যতা খানিকটা হলেও সাফ করে দেয়! অন্যথায় সভ্য হওয়ার মেকি ‘মর্যাদা’ নিয়েও বর্ণবাদের কদর্যতা নিয়েই আমাদের সমাজে বাস করতে হবে। জর্জ ফ্লয়েড মরতে মরতে বলেছিল, ‘আই ক্যান নট ব্রেথ’; একদিন আমাদেরও বেঁচে থেকেও বলতে হবে ‘উই ক্যান নট ব্রেথ’ প্রোপারলি!

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App