×

মুক্তচিন্তা

বিএসইসির নতুন কমিটির এজেন্ডা কী?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০, ০৮:৪৭ পিএম

বিএসইসির নতুন কমিটির এজেন্ডা কী?
করোনাক্রান্ত সংকট এবং জাতীয় ছুটির ভেতরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। চেয়ারম্যান এবং দুজন সদস্যকে সরিয়ে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গরজ বড় বালাই। অনেকদিন ধরে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে প্রচণ্ড মন্দাভাব বিরাজ করছিল। এ নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছিল বিনিয়োগকারীদের ভেতর। সেজন্য নতুন কমিটি আখ্যায়িত করা হলো। অন্যথায় কমিটি একই, চেয়ারম্যান সদস্যের পরিবর্তন। এ নিয়ে কিছু বলার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় খোলাসা করা প্রয়োজন এবং তা যুক্তিপূর্ণ বটে, সেটা হলো স্টক এক্সচেঞ্জ তথা পুঁজিবাজার দেশের শিল্পায়ন, অবকাঠামো গড়ে তোলা, এমনকি পরিষেবার জন্য মূলধন সরবরাহ করা। আইপিওর মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারী/সঞ্চয়কারীরা শেয়ার/বন্ড/ডিবেঞ্জারের জন্য আবেদন করে থাকেন। উদ্যোক্তারা যে টাকা পান, তার বিপরীতে সুদ দিতে হয় না। অবশ্য আবেদনকারীরা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হিসেবে লাভ-লোকসানের ভাগিদার। সবচেয়ে বড় কথা জনগণের কাছে রক্ষিত/সঞ্চিত অর্থ রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করা হয়। ব্যাংক শুধু চলতি মূলধন সরবরাহ করবে। উদ্দেশ্য মহৎ এতে তো কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু আসলে ঘটছে তো উল্টোটা। সব কাজকর্মে ঋণ দিয়ে আসছে বাণিজ্যিক ব্যাংক। এতে করে লাখো-কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে। কেননা ব্যাংক ঋণ নেয়া হয় পরিশোধ না করার জন্য। প্রকল্পের প্রয়োজন যাচাই করে ঋণ দেয়া হয় না, অন্য কিছু এর পেছনে কাজ করে। যারা বছরে গুটিকয়েক কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করে থাকে। ফলে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কত হবে। শেয়ার লেনদেন করতে হলে বিও অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। বর্তমানে বোধহয় ২৫ থেকে ২৮ লাখ বিও অ্যাকাউন্ট। এতে আবার ক্রস অ্যাকাউন্ট হোল্ডার রয়েছে। তাহলে শেয়ারবাজার এত জমজমাট হবে কীভাবে? এখন পর্যন্ত কেউ বলেনি যে মার্কেটের যে সাইজ তাতে দৈনিক কত লেনদেন হতে পারে? তবে সবাই ’৯৬ এবং ২০০৯-১০ সালের মার্কেটের সঙ্গে তুলনা করতে চাই। দুবারই চক্রান্ত করে শেয়ার মার্কেট অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে পরে পতন ঘটে। একটি চিংড়ি রপ্তানিকারী কোম্পানির ১০০ টাকার শেয়ার যদি ২৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয় তাহলে সেটাকে উন্মাদনা ছাড়া আর কিছু বলা যায়। ফল হয়েছে এই যে, কিছু নিরীহ বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে বিদায় নিয়েছেন শেয়ার মার্কেট থেকে। দুবারই লক্ষ করা গেছে যে, এক শ্রেণির শেয়ার মার্কেট বিশেষজ্ঞ বাজারকে শান্ত করার পরামর্শ না দিয়ে আরো অর্থ জোগানের আহ্বান জানিয়েছেন, যেন আকাশ হলো মূল্য বৃদ্ধির সীমারেখা। একে বলা যায় Financialisation মানসিকতা। এর উপযুক্ত বাংলা আমার জানা নেই। আবহমান কাল ধরে এটাই চলে এসেছে অর্থ বিনিয়োগ করে ভোগের জন্য/পরিষেবার জন্য সম্পদ সৃষ্টি উৎপাদন করা হয়। আর Financialisation হলো আর্থিক কৌশল প্রয়োগ করে সম্পদ বাড়ানো। এই সম্পদ রাষ্ট্রের বা সাধারণ মানুষের কল্যাণে আসে না। পুঞ্জীভূত হয় কয়েক ব্যক্তির হাতে। আর সেজন্য Financialisationকে বলা হয় Finance Cause। পুঁজিবাজারের দুটি বিভাজন। একটি হলো প্রাথমিক মার্কেট বা আইপিও। অপরটি হলো স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়। আগেই বলেছি যে, আইপিওর মাধ্যমে যে টাকা আসে, তা তো সরাসরি সম্পদ উৎপাদনে বিয়োজিত হয়। স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যক্তিপর্যায়ে লেনদেন হয়। সে অর্থ তিনি আরো বিনিয়োগ করবেন, নাকি অন্যত্র নেবেন যে পানামা, কুয়ালালামপুর, নাকি কাণ্ডার বেগমপাড়ায়, তা কেউ বলতে পারে না। তবে প্রাইমারি মার্কেট সক্রিয় থাকতে স্টক মার্কেটকেও সক্রিয় হতে হবে। বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটকে সক্রিয় করার জন্য ঋণ প্রদানের ভ‚তটি ঘাড়ে চেপেছে। যে প্রতিষ্ঠান পুঁজি সরবরাহ করবে, তাকে যদি হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ দেয়া হয়, তাহলে তো জিরো সাম গেম বলা চলে। শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিয়ে থাকেন মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে। সেখানে নিয়মকানুন কড়া। খেলাপি হওয়ার সুযোগ কম। এভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্টাইলে শেয়ার কেনার ঋণ দেয়া যায় না। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে শেয়ার কিনলে ঋণের ফাঁদ থেকে কখনো কেউ বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমাদের পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হলে প্রাথমিক মার্কেটের পরিধি বাড়াতে হবে। বারবার বলা সত্ত্বেও সরকারের কাছে যে শেয়ার রয়েছে, তা মার্কেটে আসছে না। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংককে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হলো। কিন্তু একটি শেয়ারও বাজারে ছাড়া হয়নি। আইপিওতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করার জন্য সরকারের তরফ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। প্রয়োজন বোধে আরো বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে করোনা বিশ্বের অর্থনীতির আরো কত বিপর্যয় ঘটবে, তা বলা যাচ্ছে না। অতএব নিজেদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের কথা মাথায় রাখতে হবে। একটি অভিযোগ করা হয় যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কারো কারো অডিট রিপোর্ট ঠিকমতো করা হয় না, এখন তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিএসইসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। পরিস্থিতি যাই হোক কয়েকটি বিষয়ে বিএসইসিকে দৃঢ় অবস্থানে থাকতে হবে। প্রথমত কোনো সময় শেয়ারের মূল্য গগনচুম্বী হতে দেয়া যাবে না। শেয়ারে যারা বিনিয়োগ করতে আসেন তারা নিজ দায়িত্বে আসেন, তাদের বাধ্য করা হয় না। শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন থাকবে। সেখানে কাউকে উদ্ধার করার জন্য সরকারি তহবিল থেকে অর্থ প্রদান করা ঠিক হবে না। সেটা হবে ক্ষমতার অপব্যবহার। শেয়ার ব্যবসায়ে যদি দুর্নীতি, অনিয়ম হয়ে থাকে সেটা দেখার এবং ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার বিএসইসির আছে। বিএসইসির আর একটি কর্তব্য হলো যেনতেন অজুহাতে আইপিওতে প্রিমিয়ামের অনুমতি না দেয়া। কিছু কিছু উদ্যোক্তা আছেন যারা সাধারণ বিনিয়োগকারীর কথা মোটেই ভাবেন না। এখন কতদিন জানি না, তবে ছিল যে প্রসপেক্টাস প্রকাশের ৩ সপ্তাহ আগে স্টক এক্সচেঞ্জে অনুলিপি দেয়া। আর স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্ব বিনিয়োগকারীর স্বার্থে তা খুঁটিয়ে দেখা। যদি স্টক এক্সচেঞ্জের কোনো আপত্তি থাকে, তাহলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা। একতরফাভাবে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। কেন জানি না আইপিওর মাধ্যমে মূলধন জোগাড়ের কালচারটা তেমনভাবে গড়ে উঠছে না। নতুন চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা বিষয়টিতে অধিক মনোনিবেশ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান দীর্ঘ সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। বস্তুত তিনিই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ারবাজারের দরজা খুলে দেন। তবে তার দলের লোকের কথাবার্তায় অস্থির হতেন না। শান্ত থেকেছেন, তার সময় কোনো শেয়ার স্ক্যাম হয়নি। দুর্ভাগ্য দুটি ভয়াবহ শেয়ার কেলেঙ্কারি আওয়ামী লীগের শাসনামলে হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী এমএমএ মুহিত রহস্যটি অনুধাবন করতে পেরেছেন। যে কারণে তিনি এক মহান কীর্তি করেছেন। সংকীর্ণ সদস্য ক্লাবের বৈশিষ্ট্যের ঢাকা এবং চট্টগ্রামের স্টক এক্সচেঞ্জদ্বয়কে ডি-মিউচুয়ালাইজেশন করা হয়। নইলে অন্তত আরো একটি বড় শেয়ার কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। এখন শেয়ারবাজারে বুল বিয়ারের আগমন। নির্গমন ঘটবে। মাঝে মাঝে অস্থিরতা দেখা দেবে। তবে ভয়াবহ শেয়ার কেলেঙ্কারি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, যদি না বিএসইসি কিংবা ডিএসই অতিমাত্রায় উদাসীন না হয় এবং কান কথা না শোনে। সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App