×

মুক্তচিন্তা

বাজেট : স্বাস্থ্য শিক্ষা ও উন্নয়ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০, ০৮:৫০ পিএম

আজ থেকে বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এবার অধিবেশন হবে সংক্ষিপ্ততম। সাংসদরাও একযোগে বসবেন না বা বসতে পারবেন না। এমন একটি অধিবেশনকে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে অনেক দেশ সম্ভবত সংসদ অধিবেশন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত সার্টিফায়েড বাজেট ঘোষণা করবে। আমরা সে পথে যাইনি তবে যে বাজেট পেশ করা হবে তা নিয়ে আলোচনা যদি সংসদে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না হয়, বাজেট অধিবেশন কি তাতে অর্থবহ হয়? আমাদের বাজেট অধিবেশনগুলো তো এতকাল স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু তাতেও জনমতের প্রতিফলন খুব কমই ঘটেছে। সাংসদরা জনমত-জনস্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ ও উপরতলার দিকে লক্ষ রেখে মতামত প্রকাশ করেছেন। ফলে জনমত হয়েছে উপেক্ষিত। এবারে কী হবে? এবার করোনা কিন্তু সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অতীতের বাজেটগুলো বহুলাংশেই দেশের ব্যাপক মানুষের জরুরি প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে প্রণীত হয়নি। করোনার শিক্ষাকে যদি ঠিকমতো উপলব্ধি না করি যদি তাকে ঠিকমতো কাজে না লাগাই মারাত্মক ভুলই শুধু হবে না, ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে দেশটা। করোনা এক নম্বর শিক্ষা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দেশোপযোগী, সময়োপযোগী ও জনগণের প্রয়োজন উপযোগী নয়। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে প্রতি বছর অতি ক্ষুদ্র অঙ্ক, যা প্রয়োজনের এক-চতুর্থাংশও নয়। তার ওপর ঘটেছে বাধাহীন সীমাহীন দুর্নীতি। ফলে জনসংখ্যার অনুপাতে হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ চাহিদা অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়নি, ডাক্তার-নার্সের সংখ্যাও থেকেছে অপ্রতুল। স্বাস্থ্যের অপরাপর কর্মীর সংখ্যাও তাই। বেড সংখ্যা এতই অল্প, যা চাহিদার ১০ ভাগও পূরণে অক্ষম। উন্নয়ন বলতে কী বুঝব? বড় বড় বহুতলবিশিষ্ট আকাশচুম্বী চোখ ধাঁধানো দালানকোঠা? কতগুলো রাস্তা, সেতু ও বিপণিবিতান, দামি দামি গাড়ি? অন্তত সরকারের এতদিনকার উন্নয়ন মডেল দেখে তেমনটাই মনে হয়। অতীতে মানুষের চোখ এড়িয়ে গেলেও এবারকার (২০২০-২১) বাজেটের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর থাকবে প্রতিটি সচেতন নাগরিকের। করোনার অভিজ্ঞতার আলোকে যে কোনো জনবান্ধব সরকারের দায়িত্ব হলো বাজেটে এক নম্বর প্রাধান্য স্বাস্থ্য খাতকে দিয়ে ওই খাতে ব্যাপক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের হাসপাতালগুলোতে বেড সংখ্যা অন্ততপক্ষে দ্বিগুণ করা এবং সে প্রয়োজনে ওই দুটি শহরে অন্তত দুটি করে নতুন হাসপাতাল, নতুন মেডিকেল কলেজ, নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সরকারি ওষুধ প্রস্তুত কারখানা স্থাপন, সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ডাক্তার-নার্সদের সুযোগ-সুবিধা বর্তমানের তুলনায় বৃদ্ধি করা প্রভৃতি। বিস্ময়কর হলেও সত্য, চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। জানা যাচ্ছে আসন্ন বাজেটে তা নামমাত্র বাড়িয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হতে পারে। এই লোক দেখানো ৪ হাজার কোটি টাকা দিয়ে এই খাতে কী উন্নয়ন ঘটানো যাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু আমরা তো জানি, আমাদের বাজেটে মোট বরাদ্দ থাকে লাখ লাখ কোটি টাকার। সে ক্ষেত্রে বাজেটের সিংহভাগ খতিয়ে দেখলে হয়তো দেখা যাবে সামরিক খাতেই বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ। যদিও বিষয়টি সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। সামরিক খাতে উচ্চব্যয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনো দেশের এমন শত্রু তা নেই যে তারা বাংলাদেশকে আক্রমণ করবে। অপরদিকে বাংলাদেশের নীতি হলো ‘কোনো ক্রমেই বাংলাদেশ কাউকে প্রথম আক্রমণ করবে না’। পাকিস্তান? তার কোমর একাত্তরে এমনভাবে ভেঙে দেয়া হয়েছে যে আজো দেশটি উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি কিন্তু এহেন ঘৃণ্য, গণবিরোধী দেশটিকেও যখন স্বাস্থ্য খাতে আমাদের চেয়ে উন্নত বলে খবর পাই তখন আমাদের স্বাস্থ্য খাতের প্রতি সরকারি নজরের ঘাটতি উলঙ্গভবে ধরা পড়ে। কেরালা ভারতের একটি ছোট্ট প্রদেশ। তারাও তাদের উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কঠোরতা দিয়ে করোনাকে এমন সফলভাবে দমন করতে সক্ষম হয়েছে যে তা বিশ্বের নজর কেড়েছে। তুলনামূলকভাবে কেরালার চেয়ে আমাদের বাজেট অনেক বৃহদাকারের হওয়া সত্ত্বেও আমাদের এমন দুর্দশা কেন? কিউবা-ভিয়েতনাম, গ্রিস, অস্ট্রেলিয়ার কথা না-ই বা তুললাম। বস্তুত তাদের অভাবনীয় সাফল্যের মূল কারণটি হলো স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ চলে যায় সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, ভারত প্রভৃতি দেশে, কারণ প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার জন্য ওই দেশগুলোতে যায় সে কারণে। কিন্তু ওই বৈদেশিক মুদ্রাকে দেশেই রাখা সম্ভব হতো যদি আমরা স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন মতো করতাম এবং যদি আমরা আধুনিক, উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত, সহজলভ্য ও জনগণের আস্থাশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারতাম। যা হোক, অতীতের এই ভয়াবহ ত্রু টির এবার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। প্রতি জেলায় একটি করে কমপক্ষে ২ হাজার বেড সংবলিত উচ্চমানের হাসপাতাল, নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, সব উপজেলায় ২৫০ বেড হাসপাতাল নির্মাণ ও সুসজ্জিতকরণ, আইসিইউ প্রয়োজনানুরূপ সংখ্যায় সব জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে স্থাপন এবং এ ব্যাপারে আদৌ কালবিলম্ব যাতে কোনো অজুহাতেই না ঘটে, সেদিকে লক্ষ রেখে এবং সব নাগরিকের জন্য অবশ্যই বিনামূল্যে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো করতে পারলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের মানুষকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সুস্থ রাখতে পারব, রোগাক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারব এবং বিদেশে হাজারে হাজারে গিয়ে যে লাখ লাখ বিদেশি মুদ্রা সুচিকিৎসার জন্য বৈধভাবে পাচার হয় তাও রোধ করতে পারব। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে অবস্থানকারী হাজার হাজার বিদেশির চিকিৎসার মাধ্যমেও অনেক দেশি-বিদেশি মুদ্রা অর্জন করতে পারব যদি আমরা উন্নতমানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। স্বাস্থ্য বাজেট প্রণয়নে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করাও জরুরি। শিক্ষা শিক্ষা যে সর্বাধিক উন্নয়নের প্রধানতম মাধ্যম তা সারা বিশ্বে স্বীকৃত। দেশে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার না ঘটিয়ে বা জনগণকে অশিক্ষিত করে রেখে কোনো দেশই পৃথিবীতে উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। আমাদের দেশে, উদাহরণস্বরূপ, উপযুক্ত প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার টেকনিশিয়ানের অভাবহেতু বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার বিনিময়ে বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিতে হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ও পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য। নিজ দিশে ওই জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম প্রকৌশলী প্রভৃতি থাকলে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় হতো। কীভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব উপযুক্ত প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ান যারা ওই দুটি প্রকল্প বা তার চেয়েও উন্নত প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম? কীভাবে আমরা উপযুক্ত সংখ্যক হাসপাতাল নির্মাণ ও উচ্চমানের চিকিৎসক-নার্স প্রভৃতি গড়ে তুলতে পারি? সে ক্ষেত্রেও একমাত্র মাধ্যম বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের বেকারত্বও ঘোচানো সম্ভব। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করতে পারছেন একমাত্র দেশ-বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন বলে। আমরা বেকার-অশিক্ষিত তরুণ-তরুণীকে বিদেশে অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার অভাব ও অদক্ষতার কারণে বিদেশে স্বল্প বেতনের চাকরি করতে এবং যখন-তখন চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন এবং তার মাধ্যমে দেশে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধিও ঘটছে। কিন্তু আমরা যদি সব জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারি তাহলে যেমন তাদের অনেককে দেশের উন্নয়নের কাজে লাগাতে পারতাম তেমনই আবার বিদেশে উন্নত চাকরির বাজারের দুয়ারও তাদের জন্য খুলে যেত। ফলে বিদেশ থেকে তারা দেশে অনেক অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে অনেক বেশি মজবুত করে গড়ে তুলতে পারবেন। দেশের অধিকতর উন্নয়নও তার ফলে সহজতর হতে পারে। সব দিক বিবেচনা করে ২০২০-২১ সালের বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে চলমান অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দের কমপক্ষে চারগুণ করে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখছি সংসদের কাছে। একই সঙ্গে সব খাতের সব কর্মকাণ্ড যাতে প্রকৃতই দুর্নীতিমুক্ত হয় তার জন্য যাবতীয় কঠোরতা অবলম্বনেরও সুপারিশ করছি। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App