×

জাতীয়

করোনাকালে রাজনীতিকদের জনসম্পৃক্ততা প্রশ্নবিদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০, ০৯:৫৬ এএম

করোনাকালে রাজনীতিকদের জনসম্পৃক্ততা প্রশ্নবিদ্ধ

প্রতীকী ছবি

রাজাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়ার অজস্র প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিজের কিংবা দলের জন্য ভোট প্রার্থনা করতে জনগণের দোরগোড়ায় ঘুরে বেড়ান রাজনীতিকরা। তবে দেশের এই ক্রান্তিকালে ঘরে বন্দি বেকার, দুস্থ, অসহায় মানুষের পাশে নেই তারা। জীবন-জীবিকার তাড়নায় জনপ্রতিনিধিদের দরজার কড়া নাড়ছে কর্মহীন মানুষ। কিন্তু সাড়া নেই কারোর। ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে নিজেরাও গৃহবন্দি, বন্দি তাদের অনুসারীরাও। অবশ্য থেমে নেই তাদের ‘বাকযুদ্ধ।’ ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদেনি’ নীতিতে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদরা করোনা সংকটেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান কথার লড়াইয়ে। জাতীয় দুর্যোগে জনসম্পৃক্ততাহীন এই রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের বাক্যবিলাসকে ভবিষ্যৎ রাজনীতির ক্ষেত্রে অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা ভাইরাস সংক্রমিত দেশগুলোর বৈশ্বিক তালিকায় ২০ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৬৩ হাজার ২৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে, আর মৃত্যু হয়েছে ৮৪৬ জনের। এদিকে দুইমাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি থাকার পর গত ৩০ মে থেকে শর্ত সাপেক্ষে খুলে দেয়া হয় অফিস, গণপরিবহন ও দোকানপাটসহ প্রায় সবকিছুই। কিন্তু সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আবার কোনো কোনো এলাকাকে রেড জোন চিহ্নিত করে লকডাউন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে রোগটি বিস্তারের উচ্চ ঝুঁকি থাকলেও এসব বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার মতো কর্মসূচি পর্যন্ত নেই অধিকাংশ দলের। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার জনগণের পাশে। কিন্তু জনগণের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনীতি করা রাজনীতিবিদরাই দুঃসময়ে লাপাত্তা। দুয়েক জন কোয়ারেন্টাইনে থেকে কথামালার রাজনীতি করছেন, যা কার্যত জনগণের কোনো কাজে আসছে না। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী একাই সবদিক সামলাচ্ছেন। পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী সব মাঠে। কিন্তু যাদের থাকার কথা ছিল সেই রাজনীতিবিদদের কেউই মাঠে নেই। মাঠে বলতে হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকেও যে পরিমাণ দায়িত্ব তাদের পালন করার কথা; কাউকে তেমন দায়িত্ব পালন করতে দেখছি না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ ভোরের কাগজকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করার পরই লকডাউনে কর্মহীন বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবার, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত কিট আনা, চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মাস্ক, পিপিই রেডি রাখাসহ সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা উচিত ছিল। কিন্তু সরকার বিস্ময়কর মাত্রায় নির্লিপ্ত ছিল। কারণ সরকার তোয়াজ পছন্দ করে। নিজেরা আত্মতুষ্টিতে ভোগে এবং কোনো সমস্যাকে সমস্যাই মনে করে না। তিনি বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যেভাবে সক্রিয় থাকার কথা ছিল সেভাবে কোথাও নেই। দেশজুড়ে তাদের যে সাংগঠনিক ভিত্তি তারা একাই জনগণের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারত। দলের কর্মকাণ্ডে যত নেতাকর্মী দেখা যায়, বর্তমানে মানুষের বিপদে কিন্তু তারা নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এমপি এবং নিজ দলের জনগণের ওপর আস্থা নেই বলেই কি সচিবদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে? অন্যদিকে বিএনপিও কোথাও নেই। নেই ত্রাণ কাজে, নেই মানুষের পাশে। বরং ছোট ছোট বাম রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এই দুর্যোগে মাঠে রয়েছে। মাঠে নেই তারকা রাজনীতিবিদরাও : আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতি আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, তরুণ নেতা ও ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রবীণ রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুসসহ অনেকেই সাধ্যমতো জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির আগমুহ‚র্ত পর্যন্ত মানুষের পাশে ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। মৃত্যু পর্যন্ত জনগণের সেবা করেছেন মকবুল হোসেন। এরকম কয়েকজন মাঠে থাকলেও করোনায় নীরব অনেক তারকা রাজনীতিবিদ। ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ ঐক্যফন্ট্রের নেতা ড. কামাল হোসেন, নেতা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদৌজা চৌধুরী- কেউই মাঠে নেই। জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, করোনাকালে রাজনীতিবিদদের জনবিচ্ছিন্নতা আরো স্পষ্ট হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু জনপ্রতিনিধি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। কিন্তু এর মানে এই নয়, সব রাজনীতিবিদই দুর্নীতিবাজ। দুর্যোগে রাজনীতিবিদদের যেভাবে জনগণের পাশে থাকার কথা ছিল, তারা তা নেই। তবে করোনায় রাজনীতিবিদদের জনসম্পৃক্ততা প্রশ্নবিদ্ধ- এমন দাবি মানতে রাজি নন রাজনীতিবিদরা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দরিদ্রদের জন্য কাজ করছে। করোনা পরিস্থিতিতে হতদরিদ্র ঘরবন্দি মানুষদের কাছে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকেই ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। চাল, ডাল, আলু, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্কসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণ করছেন। তবে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে প্রচার করার কিছু নেই, এটি দায়িত্ব। করোনা সংকটে ওয়ার্কার্স পার্টির জনগণ সচেতনতা তৈরির কথা তুলে ধরে পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা সচেতনতার জন্য সারাদেশে বিভিন্ন ইউনিট স্বেচ্ছাসেবকবাহিনীরা কাজ করছে। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। থেমে নেই তর্কযুদ্ধ : করোনার ছোবলে রাজনীতি আপাতত মাঠ থেকে ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ চলে যাওয়ায় দিনে দিনে তা হয়ে উঠছে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ নির্ভর। দেশে চলছে তর্কযুদ্ধের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা মোকাবিলার কোনো প্রস্তুতি নেয়নি বাংলাদেশ। সময় পেয়েছিল প্রচুর। কিন্তু খামাকা কালবিলম্ব করেছে। প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকারের একাগ্রতা, মনোযোগের চ‚ড়ান্তভাবে অভাব ছিল। এই ‘কেনো’র কোনো উত্তরও নেই! তবে সিপিবি ১৭ মার্চ থেকেই মাঠে রয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচীর নেতাকর্মীরা মাঠে রয়েছেন। চাল, ডাল, তেল, সাবান বিতরণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মাবলি সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এছাড়া নয় সদস্যবিশিষ্ট কন্ট্রোল রুম চালু রয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, অবিচার-অনাচার আর দুর্নীতিকেই নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে সরকার। দুর্নীতি হয়ে গেছে তাদের মজ্জাগত। এই ভয়াল করোনা মহামারির মধ্যেও দুর্নীতি চলছে প্রায় প্রকাশ্যে। এমন মহাদুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তেও সরকারের দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতির চিন্তায় মগ্ন। স্বাস্থ্য খাতকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেছে। সেখানে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। ক্ষমতাসীন দলের হোমরা-চোমরারা দুর্নীতিতে ভাগ বসাতে ব্যস্ত। এই মহামারির মহাদুর্দিনেও সাগরচুরির মহা-উল্লাসে মেতে উঠেছে তারা। তবে বিভেদের ভাইরাসে জাতিকে বিভ্রান্ত না করে দল, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি করোনা মোকাবিলার আহŸান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, রাজনীতি করার সময় এখন নয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App