×

অর্থনীতি

অর্থনীতি সচলে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০, ০৯:৩৩ এএম

অর্থনীতি সচলে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ

প্রতীকী ছবি

জরিমানা ছাড়াই উৎপাদনশীল শিল্প ও আবাসনে বিনিয়োগ পুঁজিবাজারের জন্য শিথিল হতে পারে বিনিয়োগ নীতিমালা ঢালাওভাবে এ সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না : বিশেষজ্ঞরা

করোনার কারণে অর্থনীতির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আসছে বাজেটে উৎপাদনশীল শিল্প, পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে কোনো ধরনের জরিমানা ছাড়াই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ প্রসারিত করা হচ্ছে। সরকার মনে করছে, এ সুযোগ দেয়া হলে কালো টাকার কিছু অংশ অর্থনীতির মূল স্রোতে আসবে এবং বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এ সুযোগ ঢালাওভাবে দেয়া ঠিক হবে না। এতে দেশ থেকে অর্থপাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন।

সূত্র বলছে, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির চাকা সচল করতে ও মানুষের কর্মসংস্থানের নিরাপত্তায় প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ। মূলত এই বিনিয়োগ চাঙা করতে বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ স¤প্রসারণের উদ্যোগ নিতে চায় সরকার। আগামী ২ থেকে ৫ বছর এই সুযোগ দিয়ে বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা দেয়া হবে। এতে অপ্রদর্শিত টাকা অর্থনীতির মূল স্রোতে আসবে এবং বিনিয়োগ বাড়বে; অর্থনীতিও চাঙা হবে বলে মনে করছে সরকার। জানা গেছে, বর্তমানে শিল্প ও ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নির্ধারিত বা প্রযোজ্য হারের সঙ্গে অতিরিক্ত কর দিয়ে ওই অর্থ বিনিয়োগ করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে তিনটি উপায়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে অপ্রদর্শিত আয় থেকে বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিলে ওই বিনিয়োগে অর্থের উৎস সম্পর্কে আয়কর প্রশাসন প্রশ্ন করবে না। ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ সুযোগ দিয়ে রেখেছে সরকার। আবাসন খাতে ফ্ল্যাটে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ফ্ল্যাটের আয়তনের ওপর এলাকাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর

দিলে কোনো প্রশ্ন করা হয় না। এই সুযোগটি আগে থেকেই আছে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত কর নির্ধারণ করায় এর সুফল পাওয়া যায় না। যে কারণে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে করহার আগের চেয়ে গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমানো হয়। তারপরও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ আসেনি এসব খাতে। মূলত শর্ত কঠিন হওয়ায় বিনিয়োগ হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। করোনার কারণে অর্থনীতি এখন বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। সরকারের হাতে টাকা দরকার। অথচ কাক্সিক্ষত রাজস্ব আয় হচ্ছে না। আবার সরকারকে বিনিয়োগও করতে হবে। অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে হবে। তাই সহজ শর্তে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সরকারের ভেতরেও এ নিয়ে আলোচনা আছে। এ জন্যই সরকার বিষয়টি নিয়ে ভাবছে বলে জানা যায়। তবে আন্তর্জাতিক মানিলন্ডারিং সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় খুব সহজ শর্তে এ সুযোগ দিতে পারবে না। জরিমানা থাকবে। তবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হয়তো জরিমানা নাও থাকতে পারে। আরো কিছু শর্ত হয়তো শিথিল হতে পারে। অন্য খাত, বিশেষ করে আবাসন, হাইটেক পার্ক ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের শর্ত খুব একটা পরিবর্তন নাও  হতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে শর্ত কঠিন হওয়ায়, জরিমানা আরোপ করায় তেমন সাড়া নেই। এভাবে চালু করলেও তেমন সাড়া পড়বে না। এবারো সুযোগটি দেয়া হতে পারে। তবে সব খাতে সমান শর্ত নাও থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, ঢালাওভাবে এ সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, কালো টাকার সুযোগ অবারিত করেও কোনো সুফল আসেনি। এটা করা হলে সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হবে। এ সুযোগ নিয়ে বিনিয়োগ না করে অনেকেই টাকা দেশের বাইরে পাচার করে দেবে। সে জন্য অর্থ পাচার রোধে কঠোর আইন করার পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি, যার প্রভাবে তারল্য সংকটে পুঁজিবাজার। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ইচ্ছা থাকলেও পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় সক্রিয় হতে পারছে না। তাদের মতে, বিগত সময়ের চেয়ে শেয়ারের দাম এখন অনেক কম। আগামী বাজেটে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখলে পুঁজিবাজারে তারল্যের জোগান বাড়বে। এ ক্ষেত্রে বন্ড বা শেয়ারে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত লক-ইন রাখার শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। স¤প্রতি করোনা সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থা তুলে ধরে স্বল্পসুদে ঋণ সহায়তা, অগ্রিম আয়কর না দেয়া ও পুঁজিবাজারে কালো টাকার বিনিয়োগ চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন (ডিবিএ)। জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রকিবুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, এখন অর্থনীতির জন্য অপ্রদর্শিত টাকা খুবই প্রয়োজন। পুঁজিবাজারেও এ টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। দীর্ঘদিন থেকে মন্দাবস্থা চলছে। কালো টাকার বিনিয়োগ বাড়লে গতিশীলতা আসবে। এই মুহূর্তে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া ভালো সিদ্ধান্ত হবে।

এদিকে আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাবও চায় সহজ শর্তে আবাসন খাতে কালো টাকার বিনিয়োগ। সংগঠনের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামীন বলেন, এখন এমন এক পরিস্থিতি যখন অর্থনীতি রীতিমতো স্থবির। এ অবস্থা উত্তরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ানো। অলস অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আনতে হবে। এ জন্য কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। সরকারের কোনো সংস্থাও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে না। বিশেষ কর ছাড়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য এ সুযোগ দেয়া হলে সরকারের ওপর চাপ কমবে। শিল্প-কারখানা, আবাসন, হাসপাতাল, টেক্সটাইল, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন খাতে যেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, সেখানে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কর ছাড় এবং কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে প্রশ্ন না করার বিধান থাকতে হবে। নইলে সুযোগ দিলেও তেমন কাজে আসবে না।

এনবিআরের আয়কর বিভাগ থেকে জানা গেছে, ১৯৭৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে অপদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়। তবে বেশির ভাগ সময়েই নানা শর্তের কারণে অবৈধ টাকার মালিকরা তাতে সাড়া দেননি। ১৯৭৫ সালে সেনা শাসন আমলে সাদা হয় দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১৫০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সাদা হয় ৯৫০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বৈধ হয় ৮২৭ কোটি টাকা। ২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সাদা হয় ৯ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বৈধ হয় এক হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। আর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বৈধ হয় ৮৫৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App