×

মুক্তচিন্তা

করোনাকালের অর্থনীতি ২

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২০, ০৮:২৭ পিএম

করোনাকালের অর্থনীতি ২
V U W L- অক্ষরের ওপর ভরসা নেই করোনাভাইরাস নামের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব বিশ্ব অর্থনীতিতে এতটাই ধাক্কা দিয়েছে, উঠে দাঁড়ানোর মন্ত্র ও প্রক্রিয়া অর্থনীতিবিদদের জানা নেই। মার্চে যিনি বলেছেন পতিত অর্থনীতি ভূগর্ভ থেকে V-এর মতো উঠে আসবে এখন তিনি বলছেন না, সম্ভাবনা নেই। U V W– যে অক্ষরকেই যুক্তি দিয়ে তারা উত্থানের সমার্থক করতে চান না কেন অনিশ্চয়তার দমকা বাতাস অক্ষর এলোমেলো করে দেয়। খোদ মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের প্রেসিডেন্ট জন উইলিয়ামস বলেছেন আমার পুরো কর্মজীবন অর্থনৈতিক আরোগ্য লাভের U V W–এর কথা শুনেছি, কিন্তু আমি একটা জিনিস শিখেছি এই অক্ষরের খেলায় থাকার কোনো মানে নেই। মার্কিনিদের জাতীয় অর্থনৈতিক পর্ষদের পরিচালক ল্যারি কাডলো বলেছেন গত একশ বছরেও যে ভাইরাস কিংবা বিশ্বব্যাধি অর্থনীতিবিদরা দেখেননি সে ব্যাধিকে অর্থনৈতিক মডেলে স্থাপন করা কঠিন ব্যাপার। V এখন অর্থনীতিবিদদের কাছে আলেয়া। তারা মনে করছেন না হঠাৎ মাথা ঝাড়া দিয়ে দুয়েক কোয়ার্টারের (প্রতি তিন মাস) মধ্যে পৃথিবীর ২০১৯ সালের উৎপাদনের পর্যায়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। জেপি মর্গান গ্রুপের অর্থনীতিবিদ মাইকেল ফেরোলি সাম্প্রতিক একটি রচনায় লিখেছেন V is for VERY UNLIKELY’ তার মানে অর্থনীতির বলটি খাদে পতনের পর বাউন্স করে উঠে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাস পৃথিবীতে যা ঘটিয়েছে তা বাতির সুইচ অফ করে দেবার মতো। এটাকে অন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে কেবল কারখানা চালু করাই যথেষ্ট নয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চমকে দেবার মতো বাউন্স ঘটতেও পারে। সার্বিক অর্থনীতিতে এর বড় কোনো প্রভাব আসা করা যায় না। ব্যাংক অব আমেরিকা মেরিল লিঞ্চ-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ মিশেল মেয়ার মনে করেন প্রতিটি খাতেরই কিছু ‘রেসিডুয়াল ড্যামেজ’ অবশিষ্ট ক্ষতি রয়ে যাবে যা সহজে মেরামত করার নয়। তবুও আশাব্যাঞ্জক একটি চিত্র দেখিয়ে তিনি উপসংহার টেনেছেন ২০২২ শেষ হবার আগে পৃথিবী ২০১৯-এর আর্থিক অবস্থানে যেতে পারবে না। অতি আশাবাদী অর্থনীতিবিদরা দেখাচ্ছেন V অক্ষর- পতিত অর্থনীতি বাউন্স করে দ্রুত আগের জায়গায় এসে যাবে, অতি হতাশাবাদী দেখাচ্ছেন L অক্ষর যেখানে দীর্ঘসময় অতলেই অবস্থান, প্রবৃদ্ধি মাত্র যৎকিঞ্চিত। কিন্তু বাস্তবতা না নয়, স্থবির খাতগুলো চঞ্চল হয়ে উঠতে শুরু করেছে, ভোক্তার আস্থা ফিরছে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কোনো কোনো দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রাষ্ট্রের জন্য অর্থনীতি সচল করা বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালু নিয়ে যত বিতর্কই হোক, পশ্চিমের ক্রেতা ক্রয়ের আদেশগুলো প্রত্যাহার করে নিলে শিল্পটি যেমন মার খাবে এ খাতের উপর নির্ভরশীল শ্রমিকের সামনে খুলে যাবে অনাহারে মৃত্যুর অনিবার্য দরজা। তবে অর্থনীতিবিদ L কে তত হতাশাব্যাঞ্জক মনে করে দেখছেন, ‘L for Low Expectation- কম কিংবা সীমিত প্রত্যাশা হিসেবে। গত শতকের মহামন্দার সময় আমেরিকায় বেকারত্বের সর্বোচ্চ হার উঠেছিল শতকরা ২৫.৬। এই সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছাতে সময় লেগেছে প্রায় পাঁচ বছর। কিন্তু বিশ্লেষকরা দেখাচ্ছেন সংখ্যার বিচারে এত বেকার আমেরিকাতে কখনো ছিল না, এখন দুই কোয়ার্টারেই তা ২০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। বেকারত্ব বিমোচনই হওয়া উচিত শুধু আমেরিকাতে নয়, বাংলাদেশেও, উচ্চ প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি জরুরি বেকারদের কর্মসংস্থান। শূন্য চেয়ার অর্থনীতি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে বাধ্যবাধকতা তাতে যে কোনো বাণিজ্যিক আর্থিক কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তির মাঝখানে অন্তত একটি চেয়ার খালি রাখতে হচ্ছে। ১১ মে ফ্রান্স লকডাউন শিথিল করে সামাজিক দূরত্ব মেনে প্রতিষ্ঠান খুলতে শুরু করেছে। কেবল ফ্রান্স নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশে, জুন মাসের প্রথম দিন থেকে বাংলাদেশেও। ফিনান্সিয়াল টাইমস লিখেছে আগামী কয়েক মাসের অর্থনীতি শূন্য চেয়ার অর্থনীতি বলে মানে হচ্ছে, কারখানায় নতুন শিফট প্যাটার্ন, বাসে অর্ধেক যাত্রী, রেস্তোরাঁয় অর্ধেক চেয়ার শূন্য। মোদ্দাকথা একটি অসম্পূর্ণ অর্থনীতি মেনে নিয়ে পৃথিবী কোয়ারেন্টাইন থেকে বের হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সামাজিক দূরত্ব বিধানের প্রতিবাদ জানাতে গ্রিসের রেস্তোরাঁর মালিকরা প্রতিবাদে শত শত খালি চেয়ার লাইন করে এথেন্স স্কোয়ারে বসিয়েছে। এভাবে ব্যবসা চলতে পারে না। তারা হিসাব করে দেখিয়েছে সামাজিক দূরত্বের বিধান মানলে প্রকৃতপক্ষে একটি রেস্তোরাঁর মাত্র ৩৫ ভাগ পরিসর বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়। আবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সুপার শপে প্রবেশের যে লম্বা লাইন এবং তাতে যে মানব-ঘণ্টার অপচয় সে হিসাব করলে অর্থনীতির পঙ্গুদশা আরো স্পষ্ট। ইউরোপের আকাশপথের লো কস্ট ক্যারিয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছে একটি করে শূন্য আসন নিশ্চিতের পর যাত্রী বসালে তাদের ব্যবসা লাটে উঠতে সময় লাগবে না। অস্ট্রেলিয়ার কান্টাস ও বেসামরিক বিমান পরিবহনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক আইএটিএ জানিয়েছে : এ ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকলে আকাশ পরিবহন দুরূহ হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি খানিকটা ভিন্ন, সামাজিক দূরত্ব রক্ষার চেয়েও আরো বেশি কিছু ঘটেছে জাতীয় আকাশ পরিবহনে। ঢাকা থেকে সৈয়দপুর রুটে লকডাউন পরবর্তী উদ্বোধনী ফ্লাইটে যাত্রী হয়েছে মাত্র ৪ জন। সুতরাং সংকটটি কেবল সামাজিক দূরত্ব নয়, আরো গভীরতর। ফিনান্সিয়াল টাইমস ইউরোপীয় মুখপাত্রদের উদ্ধৃত করে বলছে : আমরা চিরদিন লকডাউনের মধ্যে থাকতে পারি না। আগামী ১৮ মাস না আগামী ৫ বছরের মধ্যে গ্যারান্টি দেয়া ভ্যাকসিন আমরা পাবো কিনা তাও আমাদের জানা নেই। সুতরাং আমাদের এই ঘাতক ভাইরাসকে নিয়েই বাঁচতে হবে। শিখতে হবে বাঁচার কৌশল। শুধু সামাজিক দূরত্বই নয় আন্তর্জাতিক সীমান্ত এমনিতেই বাণিজ্যের প্রধান বাধা, সেখানে নতুন করে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ হতে যাচ্ছে তাতে সামনে যে বাণিজ্যের ঘোর দুর্দিন একথা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। শূন্য চেয়ার অর্থনীতির মডেলেই সম্ভবত বছরটি কেটে যাবে, সরকারি সংস্থাগুলো ব্যর্থ হলেও বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বিজনেস প্লান সেভাবে তৈরি করছে। বিশ্বব্যাধির হুমকিতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ২০৩০ সালের মধ্যে সবার কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবার বৈশ্বিক টার্গেট বিশ্বব্যাধি কোভিড-১৯-এর সামনে হোঁচট খেয়ে পড়েছে। গত এক দশকে ২০১০ থেকে এ পর্যন্ত ১০০ কোটি মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছার সাফল্যের অংশীদার বাংলাদেশও। বিদ্যুৎ বঞ্চিত অবস্থায় ছিল প্রায় ৮০ কোটি মানুষ। আইইএ-ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি জানিয়েছে বঞ্চিত মানুষের ৬২ কোটিরই বসবাস আফ্রিকার সাহারা ও নিকটবর্তী অঞ্চলে। সবার জন্য বিদ্যুৎ টার্গেট থেকে এমনিতে পৃথিবী পিছিয়ে ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস জনিত লকডাউন এবং সাপ্লাই চেইনে দীর্ঘকালীন স্থবিরতায় বিদ্যুতায়ন হুমকির মুখে পড়ে গেছে। একই সঙ্গে পিছিয়ে পড়েছে বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর রান্না থেকে দরিদ্র মানুষকে সরিয়ে আনার কর্মসূচি। এমনকি ২০১৮ সালেও ২৮০ কোটি মানুষের রান্নার উপায় ধোঁয়াযুক্ত কাঠকয়লার চুলো অথবা কেরোসিন। ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ২০ কোটি মানুষ কাঠকয়লা ও কেরোসিনের চক্র থেকে বেরিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০তেও ২৩০ কোটি মানুষ, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ ক্লিন ফুয়েল ও রন্ধন প্রযুক্তির বাইরে থেকে যাবার কথা। কাঠকয়লার চুলো ও কেরোসিন নারী ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি; এ কারণে তাদের শ্বাসকষ্টজনিত সংকট বেশি এর সঙ্গে করোনা ভাইরাসের সংযুক্তি তাদের বিপন্নদশা তীব্রতর করে তোলার কথা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অগ্রগতির অন্যতম সাক্ষ্য, প্রবৃদ্ধিরও প্রধান বাহন। সম্পদ বণ্টনের সময় এ খাতের বরাদ্দের ওপর নির্ভর করছে ২৮০ কোটি মানুষের একটি অংশের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পরিমণ্ডলে চলে আসা। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে অন্ধকারে কিংবা কুপির বাতির আলোতে রেখে আলোর মহোৎসব করার অমানবিক ঔদ্ধত্য মানুষেরই আছে। সেই অপরাধ রাষ্ট্রেরও। অসমতা আরো বাড়ছে চমস্কির আর্থ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে ব্যর্থতাসহ বিরাজমান বিশ্ব পরিস্থিতির দায় ‘অসভ্য পুঁজিবাদের’। এমন অবস্থায় বিশ্বব্যাধি কোভিড-১৯ পৃথিবীজুড়ে কাঠামোগত কারণেই আর্থিক অসমতা বাড়িয়ে তুলছে। জিন স্পার্লিং-এর বই ‘ইকোনমিক ডিগনিটি’ করোনাকালীন সংকটে বিভিন্ন ‘ইনকাম গ্রুপ’-এর আয় ও আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন অসাম্যের ব্যবধানটা অনেক বেড়ে গেছে। এখনো বড় করপোরেটগুলো স্বল্প মেয়াদে বড় লাভের ব্যবসাই করে যাচ্ছে। এ সময় ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়ায় কম আয়ের মানুষের বিপন্নতা আরো বেড়ে গেছে। এদিকে বাড়াবাড়ি ধরনের অসমতা প্রবৃদ্ধিও কমিয়ে দেয়। নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশু ভালো স্কুলে যেতে পারে না, এমনকি তার জন্য স্কুলও মেলে না, ফলে অতি নিম্ন আয়ের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজের উপযুক্তও হয়ে উঠতে পারে না, নিম্ন আয়ের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিম্ন আয়ের দুষ্ট চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে। অসমতার বিশ্লেষণে এমনকি উন্নত দেশের অর্থনীতিতেও কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে তুলে ধরে : ১. বাজার কখনো সরকারের কাজটা করতে পারে না। (বাজার মুনাফাচালিত, সরকার এমনকি ব্যর্থ হলেও তাতত্ত্বিকভাবে জনকল্যাণের কাজ করে থাকে।) ২. বাজার বেকার, কর্মক্ষমতাহীন মানুষের জন্য আয়ের পথ উন্মুক্ত রাখতে পারে না। ৩. এমনকি এখন যারা কর্মরত আছে, বাজার তাদের চাকরি থাকার গ্যারান্টিও দেয় না। ৪. বাজার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় নিজের কিছু ভঙ্গুরতা মেরামত করে নিতে পারে, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বাজার বিকৃত হয়। ৫. বাজার এমন সব পরিসংখ্যান তৈরি করে যা ক্ষমতাসীন সরকারের কল্যাণেচ্ছাকে প্রকাশ করে থাকে যা আসলে কল্যাণ নয়, পরিসংখ্যান মাত্র। করোনাভাইরাস এমনকি আমেরিকায় ‘হাই ইনকাম ইনইকুয়ালিটি’ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশই নিজেদের স্বাস্থ্যরক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসা সুযোগ নিয়ে মিথ্যের বেসাতি করছে। এমনকি মানুষের বেঁচে থাকা ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনে স্বাস্থ্য ও হাসপাতাল বাণিজ্যে মুনাফার সম্প্রসারিত হাত গুটিয়ে নেয়নি। করোনাভাইরাস স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগ নর্দমায় চলে যাওয়ার চিত্রটি স্পষ্ট করে মেলে ধরেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ যদি ভাইরাসের বিরুদ্ধে মৌলিক সুরক্ষা সহায়তা পেত তাহলে সংক্রমণ এতটা ছড়াত না। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুফল চলে গেছে ঠিকাদার, আমলা, অসৎ ডাক্তার ও রাজনীতিবিদদের পকেটে। সাধারণ মানুষের অংশীদারিত্ব সেখানে অতি সামান্যই। করোনা ভাইরাসের মতো বিশ^ব্যাধির মুখোমুখি দাঁড়ানোর শক্তি ও সামর্থ্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক সরকারের নেই। এটা কেন্দ্রীয় সরকারেরই দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতাই দেশের সবচেয়ে ধনশালী ‘ইনকাম গ্রুপের’ আয় আকাশচুম্বী করে দেয়। পশ্চিমে অন্তত মন্দের ভালো, তাদের টাকাটা তাদের দেশেই বিনিয়োগ করা হয়, তাদের ব্যাংকেই জমা হয়, ‘চুইয়ে পুড়া’ অর্থনীতি হলেও মানুষ কল্যাণের কিছু ভাগ পায়। কিন্তু কিছু লুটেরা রাষ্ট্রের মতো বা বাংলাদেশের টাকা পাচার হয়ে যায়, বাংলাদেশের লুটেরাদের নিয়ে সৃষ্টি হয় বেগমপাড়া, তাদের জন্য সেকেন্ড ও থার্ড হোম তৈরি হয়। জিএফসির শিক্ষা : সংকট থেকে বেরোনোর পথ গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস বৈশ্বিক আর্থিক সংকট এখন জিএফসি নামেই আর্থিক বিশ্বে পরিচিত। নোবেল প্রাইজ বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজও লিখেন ‘লেসনস ফ্রম জিএফসি’। স্টিগলিজ নন, অন্য কোনো বড় আর্থিক তাত্ত্বিকও নন মিসরীয় মোহামেদ আলী এল-এরিয়ান একটি বহুজাতিক কোম্পানি অ্যালিয়াজের প্রধান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি মনে করেন কিছু প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ বৈশ্বিক আর্থিক সংকট সৃষ্টি করে। সংকট মানুষকে শেখায়ও। সংকটোত্তর কালের জন্য কতগুলো বাস্তব ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন তিনি। তার ব্যবস্থাপত্রের সবই বাংলাদেশের আরোগ্যের জন্য প্রয়োজন, কতগুলো অতি প্রয়োজন। প্রথমটি হচ্ছে নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিভিন্ন ধরনের চেক এন্ড ব্যালেন্স, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, স্বচ্ছ ব্যালেন্স নিয়ে দায়বদ্ধ অর্থ ব্যবস্থাপনা উন্নত দেশগুলোতে নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। বাজার ভিত্তিক অর্থনীতিতে ব্যাংক সেসব দেশে ‘অ্যাকিলিসের গোড়ালি’ হয়ে দেখা দেয়নি। বাংলাদেশের কথা ভাবুন প্রধানমন্ত্রীর পাশে সবচেয়ে বেশি ছবি ছাপা হওয়া একজন ব্যাংকারের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে। একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শত শত কোটি টাকা নিয়ে সানন্দে কানাডা চলে গেছেন; একজন ব্যাংক চেয়ারম্যান হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে বুক ফুলিয়ে চলছেন। ক্ষমতাসীন এক উপদেষ্টার আশীর্বাদ নিয়ে হলমার্ক কেলেঙ্কারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চরম অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একাশি মিলিয়ন ডলার সম্ভবত চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেছে। অধ্যাপক বা ব্যবসায়ী ব্যাংক চেয়ারম্যান ও এমডি যখন আত্মসাতের আঁতাত করেন সে ব্যাংক রক্ষা করা দুরূহ কাজ। সম্প্রতি ব্যাংকের একজন এমডি ও তার সহকর্মী লাঞ্ছিত হন, মালিকের ক্ষমতাবান পুত্রদ্বয় তাদের পঙ্গু করে দেবার হুমকি দেন, মামলা হলে ক্ষমতাবানদের সহযোগিতায় নিজস্ব উড়োজাহাজে দেশও ছাড়েন। কেউ কেউ আঁচ করতে পারেন এক সময় তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হবে, মামলা প্রত্যাহার হয়ে যাবে, তারাও বীরের মতো স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন, কোনো এমডি কিংবা তার কোনো না কোনো সহকর্মী তাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করতেও যাবেন। আর্থিক দুর্বৃত্তায়ন কোথায় পৌঁছেছে এটা তো অজানা নয় কেউ ব্যাংকের শীর্ষে বসছেন দাস্যবৃত্তি করে, কেউ আসছেন বোর্ড চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বারদের কাউকে না কাউকে সর্বোচ্চ সুবিধে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কাজেই দুর্ভাগ্যজনক বলে ঘটনাটিকে যারা চিহ্নিত করছেন তারাও জানেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। ব্যক্তির সঞ্চয় তো মার খাবেই। যে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা যত দুর্নীতিগ্রস্ত যত অদক্ষ সেখানে পাবলিক ফান্ডও বেশি আসে, হাতের কাছে উদাহরণও আছে। করোনাকালেই কোনো কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটছে হয়তো কোয়ারেন্টাইনে থাকা জনগণ জানছে না, পরে জানবে অবশ্য জনগণ তো অনেক কিছুই জানে, শোনে, তাতে অর্থ খাতের লালিত দুর্বৃত্তদের কী এসে যায়। মোহামেদ আলী এল-এরিয়ান গ্লোবালই হোক কি ন্যাশনাল, সবার আগে নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। তিনি দক্ষ আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন যিনি টাকা পাবেন দ্রুত তাকে টাকা প্রদান করতে হবে বিবদমান বিষয় থাকলে দ্রুত স্বচ্ছতার সঙ্গে তার সমাধান করতে হবে। তার প্রেসক্রিপশনের আরো কয়েকটি বিষয়ের কেবল উল্লেখ করছি : অধিকতর স্মার্ট আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ইনক্লুসিভ গ্রোথ, অভ্যন্তরীণ প্রণোদনা, ঝুঁকি শনাক্তকরণে ব্যর্থতা, নীতির নমনীয়তা ইত্যাদি। বিশ^ব্যাধি পরবর্তী আর্থিক সংকটে নিপতিত পৃথিবীকে টেনে তুলতে যে প্রতিষ্ঠানটিকে ভ‚মিকা নিতেই হবে সেই ব্যাংকে অরক্ষিত রেখে অধিকতর সংকট তৈরি করছে অনেক দেশের সরকার, অদক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অসৎ ব্যবস্থাপনা বোর্ড এবং অসততায় জ্বালানি সরবরাহ করা ব্যাংকের টপ ম্যানেজমেন্ট। ড. এম এ মোমেন : ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App