×

সাহিত্য

অবিরাম মনের মৃত্যু ঘটছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২০, ১২:১৮ পিএম

অবিরাম মনের মৃত্যু ঘটছে

আলী ইমাম

বিশেষ সাক্ষাৎকার আলী ইমাম শিশু সাহিত্যিক

আলী ইমাম। শিশু সাহিত্যিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং অডিও ভিজ্যুয়াল ব্যবস্থাপক। এছাড়া ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাব্যবস্থাপক। তবে, সব পরিচিতি ছাপিয়ে তার প্রধান পরিচয় তিনি শিশু সাহিত্যিক। বড়দের চাইতে শিশুমহলেই তার জনপ্রিয়তা বেশি। সহজ, সরল ও আবেগমথিত ভাষায় শিশুদের জন্য দুহাত ভরে তিনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ফিচার, ভ্রমণকাহিনী, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লিখেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৬০০টির অধিক। এখনো সচল এই সুসাহিত্যিকের কলম।

ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন তার করোনাকালের যাপিত জীবন, ভাবনার বাতায়ন এবং আগামীর প্রস্তুতি সম্পর্কে। গতকাল বুধবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বলেন, করোনার এই ঘরবন্দি অবস্থায় প্রথম আমার উপলব্ধি হচ্ছে- আমি নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। যাপিত জীবনের ব্যস্ততায় নিজের সঙ্গে দেখা তো আমাদের হয় না। নিজের ভেতরের অনুভ‚তি, চিন্তা ও স্মৃতির সঙ্গে খুব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এই ঘরবন্দি অবস্থায়ই যখন আছি ক্ষতিকে কীভাবে লাভে রূপান্তরিত করা যায় ভাবলাম। আমার অনেক পুরনো বইয়ের সংগ্রহ ছিল। অনেক বই কিনে কিনে জমিয়েছিলাম। নতুন করে সেই বইগুলো আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করল। আমি সেই বইয়ের জগতে চলে গেলাম। এসব বই পড়া শুরু করলাম। এর ভেতর লিখলামও। কিশোর উপন্যাস লিখলাম দুটো। ‘হারানো প্রাণীর খোঁজে’ আরেকটা ‘বিজ্ঞান কল্পকাহিনী’। তবে মনটা খুব অস্থির। ভাবলাম এসব কীভাবে প্রকাশ করি।

তিনি বলেন, আমার কাছে শব্দ ছাড়া তো আর কিছু নেই! শব্দ বাক্য বিন্যাস, বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে কেবল লিখতে পারি। এছাড়া আর কিছু তো পারি না। সেই লেখালেখি করতে গিয়ে দেখলাম, অনেক বই কেনা হয়েছে, কিন্তু পড়া হয়নি। নতুন করে সমরেশ বসু, বিমল করের রচনাবলি পড়া শুরু করলাম। এছাড়া আমার প্রিয় লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রকে আমি নতুন করে আবিষ্কার করলাম। তার রচনাবলি পড়া শুরু করলাম। পড়ে বুঝলাম এতদিন অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত ছিলাম।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনার এই সময়ে মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। সবখানে অনিশ্চয়তা, দ্ব›দ্ব, বিবেকহীনতা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। কেউ সাহস করে কারো সঙ্গে কথাও বলতে চাইছে না। এটা মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। এই করোনাকালে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেল। এটা আমাকে একেবারে স্তম্ভিত করে দিল। অবাক হয়ে কেবল ভাবছি, এমনটা কেন হলো? বুঝতে পারলাম মানুষের মানবিক মূল্যবোধগুলো হয়তো সেভাবে বিকশিত হয়নি।

তিনি বলেন, এই পৃথিবীতে দুর্যোগ আসবে। রোগ আসবে। প্লেগ এসেছিল। মহামারি আসবে। এসব নিয়েই অবস্থান করতে হবে। কিন্তু এটাকে নিয়ে এমন কৃত্রিম সংকট, আতঙ্ক, গুজব কেন? শিক্ষার অভাবে আতঙ্কটা নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় এমনকি, বিশ্ব রাজনীতিতে বাজে খেলা শুরু হয়ে গেল। বিশেষ করে আমেরিকা আর চীনের রেষারেষি। ভ্যাকসিন আবিস্কারের গবেষণা সুনিশ্চিত না করে উল্টো রাজনীতি শুরু হয়েছে। এসব দেখে দুঃখ পাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমরা মানবিক মূল্যবোধ কি হারিয়ে ফেললাম! পৃথিবীব্যাপী যেখানে মানুষ মানুষকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছে। আবার সেই পৃথিবীতেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অনিশ্চয়তা, হানাহানি কিছুই কমেনি। বোধহয় পৃথিবীর সাড়ে সাতশ কোটি মানুষেরই মানবিক মূল্যবোধের মহাবিপর্যয় ঘটে গেছে। এই সংকট তীব্র, তীক্ষè এবং প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। এই ক্ষতিটাকে কীভাবে পুষিয়ে নিতে আগামীতে আমাদের মনের চর্চা, অনুভ‚তির চর্চা করতে হবে। করোনাকালে সবচেয়ে উচিত হবে আত্মমগ্ন হওয়া, আত্ম আবিষ্কার করা, একাগ্রচিত্তে নিজের ভিতরে এক ঘরে কোনায় বসে থেকে কবিতার কাছে যাওয়া। এটিই মনে হয় এ মুহূর্তে করা উচিত।

করোনায় চেনা পৃথিবীর পরিবর্তন সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চিনতে পারছি না! আমার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, আস্থার ভিতরেও করোনা ভাইরাস! এই করোনায় পৃথিবীতে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, পারিবারিক মেলবন্ধন, সব কিছুর ভিতরেই চরম মানসিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। আগামীতে এই আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে বেগ পেতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তা আগামীর সম্ভাবনাময় জীবনগুলোর অনেক ক্ষতি করবে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, দেহের মৃত্যুর হিসাব রাখা হয়, কিন্তু মনের মৃত্যু হিসাব রাখা হয় না। এখানে ব্যাপকভাবে অবিরাম মনের মৃত্যু ঘটছে। এটিকে রোধ করে পারিবারিক আবেগ ও দায়িত্ব বোধ ফিরিয়ে আনতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। করোনাক্রান্ত হলে কেউ কাউকে দেখে না, কাছে যায় না, এড়িয়ে চলে। এই অনিশ্চয়তাই প্রমাণ করেছে আসলে আমাদের মনের বিকাশ হয়নি। মানবিক বিশ্বাস জাগিয়ে তোলা এবং ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এটাই এখন বড় দায়িত্ব হবে এবং আগামী শিক্ষা কারিকুলামে এসব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

তবে পরিপার্শ্ব অনেক বদলে গেছে। যেমন- গাছের পাতাগুলো এখন বড় বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে। ধুলোহীন সজীবতা। ফুলগুলো আরো সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়েছে। প্রকৃতিকে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত কারণে আসলে বড় বেশি অবহেলা করি। প্রকৃতিই এখন বলছে, দেখ তো আমাকে চিনতে পারো কিনা?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App