বেসরকারি হাসপাতালের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২০, ০৯:৪২ এএম
ফাইল ছবি
যেতে চাইছে না নতুন চুক্তিতে সরকার নমনীয়
পহেলা জুন সিলেটের আল হারামাইন, ওয়েসিস, নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ, সিলেট মা ও শিশু, পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ এবং জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা পাননি ৬৩ বছর বয়সী এক নারী। পরে মধ্যরাতে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে এম্বুলেন্সেই তার মৃত্যু হয়। এর আগে অন্তত ছয়টি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে নিজের মায়ের চিকিৎসা করাতে না পেরে গত ২৮ মে চট্টগ্রাম ছাড়েন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির। তিনি ঢাকায় এসে চিকিৎসা নেন।
দেশে করোনা সংক্রমণে শুরুর পর থেকেই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ার এমন করুণগাথা প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে। চিকিৎসা না পেয়ে মৃতের তালিকায় আছেন সরকারের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংকার, ছাত্র, গৃহিণীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সরকারি নির্দেশনার পরও করোনার দোহাই দিয়ে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা না দেয়ার প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল, মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যৌথভাবে এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অধিকারকর্মীরা মনে করেন, ডেঙ্গু কিংবা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় দেশে বড় ধরনের বিপর্যয়ে সরকারের পাশে থাকার পরিবর্তে বেসরকারি হাসপাতালগুলো স্বেচ্ছা-চারিতারই বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে।সংকটকালেও তাদের ব্যবসায়িক মনোভাব প্রাধান্য পেয়েছে। করোনাকালে কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেয়া যাবে না, দিলে সেই হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করা হবে- সরকারের এমন কঠোর হুঁশিয়ারিতেও টনক নড়েনি বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল মালিকদের। কেউ কেউ নামকাওয়াস্তে করোনা ইউনিট খুললেও সেখানে কী হচ্ছে তা প্রমাণ হয়েছে ইউনাইটে হাসপাতালের করোনা ইউনিটের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়। মুনাফালোভী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে রোগীর জীবনের চেয়ে ব্যবসাই প্রাধান্য পেয়েছে। আর তাই প্রাণ দিতে হয়েছে ৫ জন রোগীকে।
১২ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোগীকে চিকিৎসাসেবা না দিলে বিদ্যমান আইনে লাইসেন্স বাতিল কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কিংবা উভয় পদক্ষেপই নেয়া হবে। বিজ্ঞপ্তিতে ৩টি নির্দেশনা উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হলো- সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকতে হবে। করোনা রোগীদের জন্য যে বিশেষ হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা হয়েছে, প্রয়োজন হলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে সেখানে নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা। এছাড়াও করোনা আক্রান্ত নয় এমন রোগী, যারা বিভিন্ন হাসপাতালে কিডনি ডায়ালিসিস সেবা নিচ্ছেন তাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
এদিকে জানা গেছে, করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত যে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে তারা সরকারের সঙ্গে করা চুক্তির মেয়াদ শেষে নতুন করে আর চুক্তিতে যেতে চাইছে না। রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে সম্প্রতি এক ঘটনায়ও এমন তথ্য জানা গেছে।
করোনা আক্রান্ত হয়ে ২৩ মার্চ আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সাইফুর। ২ জুন সুস্থ হওয়ার পর ছাড়পত্র দেয়ার সময় ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৫ টাকার বিলের কাগজ ধরিয়ে দেয়া হয় তাকে। ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে মঙ্গলবার মাঝরাতে হাসপাতাল ছাড়েন সাইফুর। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, ৩১ মে সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ওই তারিখ পর্যন্ত কোনো বিল ধরা হবে না। করে থাকলে সেই অর্থ ফেরত দেয়া হবে। তবে জানা গেছে, চুক্তির এই মেয়াদ ছিল পুরো জুন মাস পর্যন্ত।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই সংকটকালে বেসকারি হাসপাতালের সঙ্গে কোনো বৈরী অবস্থানে যেতে চাইছে না সরকার। অনেকটা পিঠে হাত দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার মতো অবস্থা। কারণ কোনো কারণে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকপক্ষ যদি সেবা দেয়া বন্ধ করে তবে অনেক রোগীরা সংকটে পড়বে।
একই সুর শোনা গেল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফোকাল পারসন ও অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খানের কথায়। তিনি জানান, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যুক্ত হতে অনুরোধ করবেন, কিন্তু কোনো চাপ দেবেন না। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনার পাশাপাশি অন্য রোগীদের চিকিৎসার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। আমরা বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কোনো সহযোগিতা দিচ্ছি না। তাই তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারছি না। আমাদের অনুরোধ থাকবে দেশের এই দুর্যোগকালে ব্যবসায়িক মনোভাব পরিহার করে তারা যেন জনসেবায় যুক্ত হন। তিনি জানান, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত সরকারি-বেসরকারি হাসাপাতালের খরচ সরকার বহন করবে। অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালগুলো চাইলে করোনা রোগীদের চিকিৎসা ও পরীক্ষার জন্য রোগীদের কাছ থেকে যুক্তিসঙ্গত খরচ নিয়ে সেবা দিতে পারে।
সরকারের সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালের করা চুক্তি প্রসঙ্গে হাবিবুর রহমান খান বলেন, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি থেকে বের হয়ে যেতে চাইছে। তারা চাইলে আমরাও হয়তো তাদের ছেড়ে দেব। জোর করব না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার এই দুর্যোগে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের মনোভাব খুবই উদ্যত। সরকার যতই হুঁশিয়ারি কিংবা নির্দেশনা দিক না কেন বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই তাদের স্বেচ্ছাচারিতা চরম আকার ধারণ করেছে। করোনা সংকটের শুরু থেকেই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মালিকদের নিয়ন্ত্রণহীন এবং অযৌক্তিক আচরণ সরকার প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব ভোরের কাগজকে বলেন, নিয়ন্ত্রণহীন স্বাস্থ্য খাতের দৃশ্যপট এখন প্রকাশ হচ্ছে। দীর্ঘদিনের অবহেলার ফল এখন আমরা ভোগ করছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো করোনা আক্রান্ত রোগীদের ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নেই। জনবল, যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসক ও নার্সদের মোটিভেশনও নেই। ফলে তারা এগিয়ে আসছে না। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন বিশিষ্ট এই চিকিৎসক। সেগুলো হলো- চিকিৎসক ও নার্সদের মোটিভেশন, আনুষঙ্গিক সহযোগিতা এবং যারা সামনে থেকে কাজগুলো করছে বা করবে তাদের প্রণোদনার বিষয়টি নিশ্চিত করা। আর বেসরকারি হাসপাতালে যুক্তিসঙ্গত খরচ দিয়ে রোগীদের সেবা নেয়ার প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, সব নাগরিকের চিকিৎসা ব্যয় সরকারকেই বহন করতে হবে। দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে এ ধরনের আইনও রয়েছে। সুতরাং দুর্যোগকালে চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দিতে পারে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সাধারণ রোগীর চিকিৎসা না দিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেয়ার কাজটি অবশ্যই অনুচিত। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। মালিকপক্ষ ও চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করা খুবই জরুরি। চিকিৎসকরা করোনা মোকাবিলায় সম্মুখ সারির যোদ্ধা। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। বেসরকারি হাসপাতালেরর চিকিৎসকরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক বিষয়টিকে এভাবে না দেখে চিকিৎসকরা করোনার যোদ্ধা এমনভাবে দেখা উচিত।