×

জাতীয়

চরম স্বেচ্ছাচারিতায় চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২০, ০১:০০ পিএম

চরম স্বেচ্ছাচারিতায় চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক

চট্টগ্রামে করোনা উপসর্গের রোগীদের তো বটেই, সাধারণ রোগীদেরও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি নেয়া হচ্ছে না। এ নিয়ে রোগী ও স্বজনদের চরম ভোগান্তি ও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। রোগীদের সঙ্গে চরম স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠেছে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো। চিকিৎসাসেবাবঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ রোগী। সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো পরিচালনা করে আসছে এসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকরা। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সংকটে করোনা উপসর্গের রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে গেলেও ভর্তি নেয়া হচ্ছে না। করোনা সন্দেহে নগরের কোনো বেসরকারি হাসপাতাল আইসিইউ সাপোর্ট দিচ্ছে না। চিকিৎসাসেবা না পেয়ে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ, তাদের অসন্তোষের মাত্রা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সচেতন নাগরিকদের অভিযোগ, বেসকারি হাসপাতালগুলো বছরের পর বছর চিকিৎসার নামে গলাকাটা ফি আদায় করে মুনাফা করেছে। বর্তমান করোনা দুর্যোগ পরিস্থিতিতেও বেসরকারি হাসপাতালগুলো সাধারণ মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে।

অথচ গত ৩০ মে শনিবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আয়োজিত এক বৈঠকে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে কোভিড, নন-কোভিড সব ধরনের রোগী ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত হয়। করোনা উপসর্গ কিংবা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া কোনো রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দিলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলসহ আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে গত ৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য ১২টি বেসরকারি হাসপাতাল নির্বাচিত করা হয়। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল- ভেন্টিলেটর সুবিধাসহ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এ প্রজ্ঞাপনের কোনো আদেশ মানা হচ্ছে না। এতে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবা শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতালকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।

এদিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও সাধারণ রোগীদের চিকিৎসায় ভোগান্তি নিরসনে নাগরিক পরিবীক্ষণ জোরদারের দাবি জানিয়েছে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব। ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে করোনায় আক্রান্ত ও আক্রান্ত নন- এমন সব রোগীদের চিকিৎসাসেবা পেতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। সরকার সরকারি-বেসরকারি সকল হাসপাতালে সকল রোগীর সেবা নিশ্চিতের নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু বেসকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ রোগীরা ভর্তি হতে ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কোভিড পরীক্ষার রেজাল্ট আছে কিনা তা প্রদর্শন করতে না পারলে ভর্তি নিচ্ছে না। প্রতিদিন কোনো না কোনো সাধারণ রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছে। এমনকি চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবিরের কিডনি রোগাক্রান্ত মাকে চট্টগ্রামে ডায়লাইসিস করাতে ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। চিকিৎসাসেবা পেতে রোগীদের ভোগান্তি-হয়রানি, লাগামহীন সেবামূল্য আদায়, সরকারি নজরদারির অভাবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো স্বেচ্ছাচারিতায় মেতেছে। সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবাবঞ্চিত হবার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ভোগান্তি নিরসনে নাগরিক পরিবীক্ষণ জোরদার ও চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

নগরীর লালখান বাজার এলাকার এক বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মায়ের রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়েছিল। শারীরিকভাবে দুর্বল ও গায়ে জ্বর এসেছিল। চিকিৎসকের পরামর্শে আমরা হাসপাতালে ভর্তির জন্য বিভিন্ন জায়াগা নিয়ে যাই। কিন্তু তারা ভর্তি করাননি। শেষপর্যন্ত অনেক চেষ্টা তদবির করে নগরীর একটি ছোট-খাটো হাসপাতালে ভর্তি করাই।

বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাব মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘সরকারিভাবে নির্দেশনা থাকলেও আমরা করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকা রোগী ভর্তি নিচ্ছি না। কারণ এখানে এমন রোগী ভর্তি করা হলে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে। তাছাড়া আমাদের হাসপাতাল চালু রাখার একটি ব্যাপার আছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা খালেদ আহমেদ বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আলাদা ভবনে বা ফ্লোরে কোভিড ও নন-কোভিড রোগী চিকিৎসা করতে হবে। শনিবার বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা পার্কভিউ ও রয়েল হাসপাতাল কোভিড রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড (বিশেষায়িত) করবে। আর বাকিগুলোতে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করতে হবে। অন্যথায় হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাধারণ রোগীদের ভর্তি না করানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালের চেম্বার করা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ এস এম লুৎফুল কবির শিমুল করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরও স্বয়ং ওই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত থাকলেও তিনি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট হিসেবে সংযুক্ত আছেন। ওই ম্যাক্স হাসপাতালে তার চিকিৎসক স্ত্রীও চেম্বার করেন। এরপরও তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মর্মান্তিক এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ফেসবুক পোস্টে। তিনি বলেন, ‘আমি দুবার করোনা টেস্ট করিয়েছি দুবারই নেগেটিভ এসেছে রিপোর্ট। এরপরও শরীর খারাপ হওয়ায় জেনারেল হাসপাতালে না গিয়ে নিজে যেখানে চেম্বার করি সেই ম্যাক্স হাসপাতালে থাকতে চেয়েছি। একটা কেবিন চেয়েছি আর অক্সিজনের ব্যবস্থা করতে বলেছি। তবে হাসপাতল সেটা করেনি। ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি মিথ্যা কথা বলে আমাকে ভর্তি নিতে চাইলেন না। বিক্ষিপ্ত এবং এলোমেলো কথা বলে ফোন কেটে দিলেন। একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারও দিলেন না।’

নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে আইসিইউ সাপোর্ট না পেয়ে গত ৩১ মে রাতে মারা গেছেন এছহাক ব্রাদার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাজি মোহাম্মদ ইউনুছ। তার পরিবারের সদস্যরা জানান, হঠাৎ অসুস্থতাবোধ করলে তাকে প্রথমে নগরের জিইসি মোড়স্থ মেডিকেল সেন্টারে নেয় হয়। সেখানে দুঘণ্টা অপেক্ষায় রেখে শেষপর্যন্ত ভর্তি করা যাবে না জানিয়ে দেয়ার পর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার তাৎক্ষণিক আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হচ্ছিল। নগরের আইসিইউ সংবলিত সকল বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে আইসিইউ, নিদেনপক্ষে এইচডিও শয্যা ভিক্ষা চাওয়া হয়। কিন্তু করোনা সন্দেহে কোনো হাসপাতালই আইসিইউ সাপোর্ট দিতে এগিয়ে আসেনি। শেষপর্যন্ত রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হয়। কিন্তু এর মধ্যেই রাত ১০টার দিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। হাজি মোহাম্মদ ইউনুছের আগে থেকে ডায়বেটিস, কিডনি এবং হাঁপানির সমস্যা ছিল। গত ২৫ মার্চ ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে সুস্থ হয়ে তিনি চট্টগ্রাম ফেরেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App