খাদ্যশস্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতাই আমাদের সাহস জোগাবে
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২০, ০৫:০২ পিএম
বিশ্বজিৎ ঘোষ। মননশীল প্রাবন্ধিক ও গবেষক। বাংলা কথাসাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা, মূল্যায়ন, পুনর্মূল্যায়ন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। দুই বাংলা মিলিয়ে যে কজন পরিশ্রমী গবেষক তাদের শ্রমলব্ধ আয়াস দ্বারা বাংলা কথাসাহিত্যকে, কথাসাহিত্যের নির্যাসকে আমাদের সামনে তুলে ধরেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি সাহিত্য নিয়ে লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাংলা কথাসাহিত্য বিশেষত উপন্যাস ও ছোটগল্পবিষয়ক আলোচনা-সমালোচনা যে খুব একটা কম হয়েছে, তেমন নয়। কিন্তু দেখা জিনিসকে নতুন করে দেখানো, নতুন করে চেনানোর ক্ষেত্রে বিশ্বজিৎ ঘোষ গবেষণাকে নিয়ে গেছেন শিল্পের পর্যায়ে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক যিনি একই সঙ্গে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদক লাভ করেন।
মননশীল এই গবেষকের করোনাকাল কেমন কাটছে ভোরের কাগজের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু আমাদের নয়, পৃথিবীর কোনো মানুষেরই এই অভিজ্ঞতাটা ছিল না। এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আড়াই মাস ধরে ঘরেই আটকে আছি। বেরই হইনি আমি। প্রথম দিকে মানিয়ে নেয়া বেশ কষ্টকর ছিল। যখন বোঝা গেল যে এভাবেই ঘরে থাকতে হবে। নিজের নিরাপত্তার জন্য, পরিবারের নিরাপত্তার জন্য এবং মানুষের নিরাপত্তার জন্য। তখন আমি পড়ালেখা করাটাকেই প্রাধান্য দিলাম। এই সময়ে শিশু একাডেমির জন্য মাইকেল মধুসূধন দত্তের ওপর শিশু উপযোগী একটা বই লিখলাম। এছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার ওপর একটা প্রবন্ধ লিখছি কালি ও কলম পত্রিকার জন্য। আনিস স্যারের ওপরও দুটো প্রবন্ধ লিখছি।
কী পড়ছেন জানতে চাইলে বিশিষ্ট এই প্রাবন্ধিক বলেন, এর মধ্যে প্রগতি লেখক আন্দোলনের ইতিহাসের ওপর একটা বই লিখতে চাই। সে জন্য ভারতের বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক সাজ্জাদ জহিরের ‘দ্য রোশনি’ নামে বইটি পড়ছি। এটি প্রকাশ করেছে অক্সফোর্ড। বইটি ইংল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করে পড়ছি। আমি যেহেতু এর উপর লিখতে চাই, এজন্য বইটা পড়ছি।
এছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি-জন্মশতবর্ষ আসছে সামনের সেপ্টেম্বরে। বিদ্যাসাগরের উপরে ব্যাপক পড়ালেখা করলাম এই সময়ে। ব্যাপক শব্দটি বললাম, এই কারণে যে বহু বিষয়ে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে পড়ালেখা করলাম। এই একটা দিক।
আরেকটা দিক হচ্ছে গৃহস্থালি কাজের অভিজ্ঞতাটাও নিলাম। সঙ্গে আমার ছোট কন্যাও আছে। কন্যার সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা বার্তা, আলাপ আলোচনা করার সুযোগটা পেলাম। যা অন্য সময় সাধারণত পাওয়া যায় না। সময়টা সেদিকেও দেয়ার চেষ্টা করেছি।
করোনার কারণে চেনা পৃথিবীটার কতটা বদল ঘটেছে বলে মনে করছেন জানতে চাইলে এই সমালোচক বলেন, আমরা ঠিক যেভাবে বড় হয়েছি বা যেভাবে আমাদের সময় এবং জীবনটা কেটেছে বা কেটে গেছে। এখন ঠিক বুঝতে পারছি না আমাদের সামনের পৃথিবীটা কীভাবে চলবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চলাফেরা থেকে শুরু করে সব কিছুতে একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। সব কিছুর সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। এখন আমরা বিষয়টা হয়তো ওভাবে বুঝতে পারছি না। কিন্তু আস্তে আস্তে সেটা হয়ে যাবে। যেমন এখন বাইরে যেতে হলে ড্রেস পরিবর্তন করতে হচ্ছে, আবার বাহির থেকে এসে আবারো পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এখন বাইরে যাওয়া মানে সঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সঙ্গে নিতে হবে, মাস্ক থাকতে হবে। এটা একটা অভ্যাসে রূপান্তরিত হবে। এটা স্বাভাবিক জীবনেরই অঙ্গ হয়ে যাবে। আমাদের বিহেবিরাল পাটার্ন আচার আচরণ : যেমন রাস্তা ঘাটে থুথু ফেলা, হাঁচি-কাশির সময় আমরা শিষ্টাচার রাখতাম না। এখন তার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। এটা নিশ্চিতই।
প্রকৃতির পরিবর্তনের মধ্যে লক্ষ্য করেছি, গাড়ির হর্ন নেই, ফলে এখন শব্দ দূষণও নেই। তার ওপর এখন বর্ষাকাল। বৃষ্টি হচ্ছে। আমার মনে হয় কয়েকশো বছরের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী প্রকৃতি এমন চমৎকার পরিবেশ আর কখনো পায়নি। এজন্য এই করোনার এই সময় আশীর্বাদের মতো মনে হয়েছে। তারপর সাগরের ডলফিন থেকে শুরু করে সাগরের অন্যান্য প্রাণীদের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ, প্রকৃতিতে গাছ পালাসহ সব কিছুর মধ্যে একটা সজীবতা দেখছি। এটা আমরা কল্পনাই করতে পারিনি। এটা প্রকৃতির জন্য খুব আশির্বাদ। প্রকৃতি মহাখুশি নিঃসন্দেহে। প্রকৃতিরও জীবন আছে। প্রকৃতিও তো সব বোঝে। একটা গাছ কাটলে কষ্ট পায়। একটা লজ্জাবতী পাতায় হাত দিলে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। প্রকৃতির ওপর আমরা যে নির্যাতন, নিপীড়ন করি, সে জায়গা থেকে প্রকৃতিও করোনাকালটাকে তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা মহা আনন্দের জায়গায় পৌঁছেছে। যা হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দীতে এসে আগে পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে কিনা সন্দেহ।
করোনার অভিঘাত বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করেন কিনা জানতে চাইলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উপাচার্য আরো বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর উন্নত দেশ আর্থিকভাবে সচ্ছল দেশগুলোও তো হিমশিম খাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ শেষ পর্যন্ত সব কিছু খুলে দিতে বাধ্য হলো শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে। পৃথিবীর আরো অনেক দেশ অর্থনৈতিক কারণেই লকডাউন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। আমরা কেবল একটা মধ্যম আয়ের দেশে পা রাখতে যাচ্ছিলাম, ঠিক এই সময়ে করোনার আক্রমণ হলো, যা ভয়াবহ। আমাদের দেশের প্রায় এক কোটির মতো মানুষ বিদেশে চাকরি করতেন। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখতে বেশি ভ‚মিকা রাখত। এই অভিঘাতে এদের অনেকেই বেকার হয়ে যাবে। ফলে সেসব তো বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে একটা অর্থনৈতিক সংকটে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পরব আমরা। কিন্তু আমাদের একটা বড় সুবিধার জায়গা আছে। তা হচ্ছে আমাদের জনশক্তি আছে। দ্বিতীয়ত, আমরা খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্যশস্যের এই স্বয়ংসম্পূর্ণতাই আমাদের সাহস জোগাবে।