×

জাতীয়

দেশ ছাড়ছেন ধনাঢ্যরা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২০, ১২:০৭ পিএম

দেশ ছাড়ছেন ধনাঢ্যরা!

সোহেল খান ও মোর্শেদ খান/ ফাইল ছবি

চার্টার্ড বিমানে দুই শীর্ষ ব্যবসায়ীর সপরিবারে লন্ডন যাত্রায় তোলপাড়

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসে দেশে সংক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ধনাঢ্যরা। বিশেষ করে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থাহীনতা উদ্বেগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের একজন পরিচালকসহ একাধিক শিল্পপতি ও ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যের মৃত্যু এবং ঢাকার গুলশানের অভিজাত হাসপাতাল ইউনাইটেডে অগ্নিকাণ্ডে তিন করোনা রোগীসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা তাদের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে মৃত্যু ভয়ে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেছেন। সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, ইমিগ্রেশন পুলিশ এবং সংশ্লিষ্টদের বিশেষ সহযোগিতার কারণে ধনাঢ্যরা বিশেষ ব্যবস্থায় দেশ ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছেন বলে চাউর রয়েছে। এরমধ্যে ভাড়া করা চার্টার্ড বিমানে করে দেশ ছাড়ছেন অনেকে। দেশত্যাগীর তালিকায় মামলার আসামির নাম থাকলেও নির্বিঘ্নেই তারা উড়াল দিচ্ছেন আকাশে! গতরাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আরো ১১ জনের দেশ ছাড়ার আবেদন বিবেচনাধীন আছে বলে একটি সূত্র দাবি করেছে। যার মধ্যে একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং একটি শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে দেশত্যাগী শীর্ষ ধনাঢ্যদের কারো কারো দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বিশেষ সুপার (ইমিগ্রেশন) শাহারিয়ার আলম গতকাল শনিবার বিকেলে এ প্রতিবেদককে বলেছেন, কারো দেশত্যাগের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে লিখিত কোনো আদেশ না থাকলে তারা কাউকে আটকাতে পারেন না। সিকদার গ্রুপের দুই পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের দুদিন পর পত্রিকার খবরে তারা তা জানতে পারেন। কিন্তু দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার কোনো আদেশ তারা পাননি। শাহারিয়ার আলম বলেন, মোরশেদ খানের দেশত্যাগ করতে পারবেন এমন আদালতের আদেশ রয়েছে। আরো ১১ জনের আবেদন প্রসঙ্গে তিনি জ্ঞাত নন উল্লেখ করে বলেন, নিয়ম মেনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে যে কেউ বিদেশ যেতে পারেন। এক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।

অন্যদিকে বেবিচক চেয়ারম্যান মো. মফিদুর রহমান জানিয়েছেন, প্লেন চার্টার্ড করে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার নতুন কোনো আবেদন তার কাছে নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কেউ বিদেশ যাওয়ার অনুমতির আবেদন করলে সেটি জানা নেই বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, মামলার আসামি হয়েও গত ২৫ মে সকাল ৯টা ১৩ মিনিটের দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ব্যাংককের উদ্দেশে বিমানে চেপে উড়েছেন সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদার। তারা চিকিৎসার কারণ উল্লেখ করে সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স চার্টার্ড করে দেশত্যাগ করেছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান বৃহস্পতিবার সস্ত্রীক লন্ডন গেছেন ভাড়া করা বিমানে। মোরশেদ খান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেয়াই। তার ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের সঙ্গে মোরশেদ খানের মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এরপর গত শুক্রবার একটি বিশেষ ফ্লাইটে দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান ও তার স্ত্রী লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন। সোহেল এফ রহমানের মেয়ে লন্ডনে থাকেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা। করোনা সংকটে একমাত্র মেয়ের পাশে থাকতেই সোহেল এফ রহমান এবং তার স্ত্রী বিমান ভাড়া করে লন্ডন গেছেন বলে তার পারিবারিক সূত্র দাবি করেছে।

এ প্রসঙ্গে বেবিচক চেয়ারম্যান মো. মফিদুর রহমান জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার একটি বিশেষ ফ্লাইটে মোরশেদ খান ও তার স্ত্রী নাসরিন খান লন্ডনে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে ওই বিমানটি ভাড়া করা হয়েছে। তাতে যাত্রী ছিলেন শুধু দুজন- মোরশেদ খান ও স্ত্রী নাসরিন খান। তিনি গুরুতর অসুস্থ এবং চেকআপ করাতে জরুরি ভিক্তিতে বিদেশে গেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা দাবি করেছেন। দেশের প্রথম সাটেলাইট মোবাইল ফোন কোম্পানি সিটিসেলের নামে এবি ব্যাংক থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ৩৮৩ কোটি ২২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের মামলায় গত বছর ১০ জুন মোরশেদ খানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এরপরে উচ্চ আদালত তার বিদেশযাত্রায় বাধা না দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। আদালতের সেই কাগজ দেখিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনে গেছেন মোরশেদ খান। একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন তিনি।

এদিকে গুলশান পুলিশ সূত্র মতে, সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদার এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ইস্যুতে দুই শীর্ষ ব্যাংক কর্মকর্তাকে গুলি করার হুমকি ও নির্যাতনের অভিযোগে গুলশান থানায় দায়েরকৃত মামলার আসামি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ উল-আহসান সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ফ্লাইটটি ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার খবর নিশ্চিত করেছেন। গত ১৯ মে এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ঋণ গ্রহণের জন্য ব্যাংকটির দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে গুলি করার চেষ্টা ও নির্যাতন করেছে এই দুই ভাই। এরপরই তারা আলোচনায় আসেন।

এদিকে সোহেল এফ রহমানের সস্ত্রীক দেশত্যাগের খবর নিশ্চিত করে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘একটা স্পেশাল ফ্লাইটে, যেটা সালমান এফ রহমানের বড় ভাইয়ের যাওয়ার কথা। ওনাদের (এম মোরশেদ খান) সঙ্গে এটা কানেকটেড ছিল। ওনারা দুটো ফ্লাইট চার্টার করেছিলেন। একটাতে ওনারা গেছেন, আরেকটায় সালমান এফ রহমানের বড় ভাই গেছেন।’

প্রসঙ্গত, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও দেশের শীর্ষ শিল্প গ্রুপ এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদ আলম (৬৮) চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। রাজধানীর সানবিম স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রী নিলুফার মঞ্জুর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ায় ধনীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা এখন চরমে।

টিআইবি :: দেশে একের পর এক জবাবদিহিতা লঙ্ঘিত হচ্ছে: করোনা পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সংকটে জর্জরিত জাতির এই ক্রান্তিকালেও একের পর এক জবাবদিহিতা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের স্বার্থে এখনই এই প্রবণতার লাগাম টেনে ধরার জোরাল দাবি জানিয়েছে টিআইবি। সম্প্রতি একটি বেসরকারি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে মর্মান্তিক প্রাণহানীর ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়হীনতা ও ‘গাফিলতি’ এবং একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে বেআইনিভাবে ঋণ সুবিধা আদায়ের জন্য গুলি করার মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্তদের এয়ার-অ্যাম্বুলেন্সে দেশ ছাড়তে পারার মতো ঘটনাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ব্যবসায়িক দুর্বৃত্তায়ন বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি।

গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে অবিলম্বে ব্যবসা খাতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত শূন্য সহনশীলতা’ নীতির কঠোর বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।

ইউনাইটেড হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে পাঁচজন চিকিৎসাধীন ব্যক্তির প্রাণহানীর ঘটনার বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই মর্মান্তিক ঘটনায় বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ সামনে এসেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এমতাবস্থায় তদন্ত কমিটি কোনো ধরনের প্রভাব উপেক্ষা করে বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন দেবেন এবং তাতে যদি ‘অপরাধমূলক গাফিলতির’ প্রমাণ পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের পরিবারের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণসহ আইনের কঠোরতম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সম্প্রতি অবৈধ ঋণ পাইয়ে দিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে গুলি করা, একাধিক কর্মকর্তাকে আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগে মামলার ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে। অথচ যাদের বিরুদ্ধে মামলা তারাই ‘মিথ্যা রোগী সেজে’ ‘এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে’ দেশ ছাড়লেন। ‘তাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি’ এমন অজুহাতে এখানে দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App