×

মুক্তচিন্তা

‘বিপদে বন্ধুর পরিচয়’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২০, ১০:০৮ পিএম

একবিংশ শতাব্দীর এই করোনা ভাইরাস বিপদে প্রকৃত আপনজন শনাক্তকরণের জন্যই হয়তোবা আবির্ভাব হয়েছে! মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন যুগে মহামারির প্রাদুর্ভাবে কোটি কোটি মানুষের প্রাণহরণের ঘটনা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু করোনা ভাইরাস মহামারির মতো প্রাণহরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অন্তর থেকে মানবিকতাও তুলে নেয়ার ঘটনা তেমন পাওয়া যায় না। এই পার্থিব জীবনে মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয়জন হলো নিজ স্ত্রী ও সন্তানরা। আর সেই প্রিয়জনদের থেকে আজ জীবনের শেষ পাওয়াটাই জুটছে না! কতটুকু অমানবিক হলে মানুষ নিজের মাকে গভীর রাতে বনে ফেলে দিয়ে আসে, পিতার শেষকৃত্যে অংশ না নিয়ে পালিয়ে যায় এবং নিজ স্বামীকে গভীর রাতে ঘরে জায়গা না দিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বলে! করোনা ভাইরাসই সেই প্রিয়জনদের ভালোবাসার আসল রূপ ফাঁস করে দিয়েছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআ’নুল কারিম কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে সেই দিন মানুষ তার ভাই, পিতা-মাতা ও স্ত্রী-সন্তান থেকে পলায়ন করবে তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই ভয়াবহ অবস্থার দিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়নি; বরং সামান্য করোনা ভাইরাসই প্রমাণ করে দিয়েছে, আমরা পরস্পর কতটুকু আপন? পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে অনেক মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে স্পার্টানদের সঙ্গে গ্রিকদের যুদ্ধ চলা অবস্থায় ‘দ্য প্লেগ অব এথেন্স’ নামে পৃথিবীর প্রথম মহামারি, ২৫০ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের মহামারি, ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে প্রায় ৫০ বছর স্থায়ী হওয়া ‘দ্য প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান’, রাসুলুল্লাহ (দ.)-এর যুগে প্লেগ ও কুষ্ঠরোগ, ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর শাসন আমলে সিরিয়া, মিসর ও ইরাকে ছড়িয়ে পড়া ‘তাউন আমওয়াস’ নামক মহামারি, ১৩৩৪ সালে ইউরোপজুড়ে কয়েক মাসব্যাপী ত্রাস চালানো ‘দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’ মহামারি, ১৭৯৩ সালে ‘ইয়েলো ফিভার এপিডেমিক অব আমেরিকা’, ১৯১৮ সালে ‘দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা পেনডেমিক’, ১৯৭০ সালে ভারতে শুরু হওয়া ‘দ্য স্মলপক্স এপিডেমিক অব ইন্ডিয়া’, ১৯৮৪ সালে আমেরিকায় শুরু হওয়া এইচআইভি ভাইরাস এবং ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারিতে কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানির প্রমাণ পাওয়া যায়। আর ২০২০ সালে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ শুধু মানুষের প্রাণহরণ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়নি; বরং মানুষের কাছ থেকে মানবিকতাও তুলে নিয়েছে! বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্য মতে, করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তি থেকে ভাইরাস ছড়ানোর প্রমাণ তারা এখনো কোথাও পায়নি। আর বিশেষজ্ঞরা দৃঢ় কণ্ঠে বলছেন, মৃত ব্যক্তি করোনা ভাইরাস ছড়ায় না। এছাড়া এই পর্যন্ত করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফনে অংশ নেয়া কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। এরপরও একজন মানুষ পার্থিব জীবনের আপনজন থেকে কেন জীবনের শেষ প্রাপ্যটুকু থেকে বঞ্চিত হবেন? ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করে চিকিৎসকরা যদি করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে পারেন, পুলিশ কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা যদি করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করতে পারেন; তাহলে একই সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করে স্বজনরা কেন জীবিত অবস্থায় তার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন না এবং মারা গেলে তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করতে পারবেন না? আজকে করোনা তাকে আক্রমণ করেছে, আগামীকাল এই অদৃশ্য শত্রু আমার ওপর চড়াও হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? মানুষের মৃত্যু কখন কীভাবে হবে তার জ্ঞান একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া অন্য কারো কাছে নেই। তাই আসুন! অনেক অমানবিক আচরণ আমরা করেছি, এখন অন্তত বুঝার চেষ্টা করি। চিকিৎসকদের পরামর্শ মতে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করে করোনায় আক্রান্ত স্বজনের পাশে দাঁড়াই এবং মৃত্যুর পর তার শেষ অধিকার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করে তাকে শেষ বিদায়টুকু ভালোমতে দিয়ে তার আত্মার ব্যথাটুকু একটু লাঘব করার চেষ্টা করি। সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App