×

জাতীয়

দ্বিগুণ হচ্ছে বাস ভাড়া

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২০, ১২:৫৪ পিএম

ভোগান্তি বাড়বে যাত্রীদের সড়ক-মহাসড়কে এখন ঢাকামুর্খী মানুষের ঢল

গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ছে। ট্রেনের ভাড়া না বাড়লেও বাসের ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। আগামী দুয়েক দিনের মধ্যেই যাত্রীদের এই বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে। আজ শনিবার ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হবে। এই মুহূর্তে বাসের ভাড়া বাড়ানো হলে যাত্রীদের জন্য তা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হবে। করোনার প্রভাব কেটে গেলে এই ভাড়া কমানো হবে কিনা, স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে কিনা, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে কোনো সংস্থা মনিটরিং করবে কিনা- এসব বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠেছে। তবে আশার কথা হলো, এখনই লঞ্চের ভাড়া বাড়ছে না। লঞ্চগুলো আগের ভাড়াতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহন করবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার কারণে যাত্রী কম হলে অল্প সময়ের মধ্যেই ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।

আগামী ১ জুন থেকে বাস চলাচল শুরু হবে। এই বিষয়ে নির্দেশনা দিতে গতকাল শুক্রবার বিকেলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সচিব নজরুল ইসলাম বনানী বিআরটিএ কার্যালয়ে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে এই বৈঠকে বাসের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বিধি মেনে কীভাবে বাস চালানো হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। সচিব নজরুল ইসলাম জানান, সব বাসে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। বাসে ওঠার আগে যাত্রীর তাপমাত্রা মাপতে হবে। দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বাস চলাচলের সময় মাঝপথে যাত্রী উঠানো যাবে না। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক উভয়পক্ষই এতে একমত হয়েছেন। তারা ১ জুন থেকে গাড়ি রাস্তায় নামাবেন।

ভাড়া বাড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দূরত্ব বজায় রাখতে অর্ধেক যাত্রী তুলতে হবে। মালিকদের ক্ষতি পোষাতে নতুন করে ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। আগামীকাল (আজ) শনিবার ভাড়া নির্ধারণ কমিটি বৈঠকে বসে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করবে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালাতে সরকারের সিদ্ধান্তকে দূরপাল্লার গণপরিবহনের মালিকরা স্বাগত জানালেও রাজধানীর ভেতরে চলাচলরত গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা খুশি হতে পারেননি। রাজধানীর পরিবহন মালিক শ্রমিকরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালালে প্রতিদিনই লোকসান গুনতে হবে। সরকারি ভর্তুকি ছাড়া ক্ষতি পোষানো সম্ভব হবে না। একটি গাড়ি রাস্তায় বের হলেই জ্বালানি খরচ, ড্রাইভার ও হেলপারের বেতন, মেরামত ও নানা খাতের চাঁদা বাবদ নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা খরচ হয়। যাত্রীর ভাড়া থেকেই এসব খরচ মেটাতে হয়। অন্য সময়ে দাঁড়িয়েও যাত্রী পরিবহন করা হয়। এখন করোনা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গাড়ি চালালে খরচ উঠবে না। সব গাড়িকেই লোকসান গুনতে হবে। এ কারণেই সরকারের এই সিদ্ধান্তে আমরা খুশি না। আমাদের জন্য সরকারের কোনো ভর্তুকি নেই। এ কারণে অনেক মালিক এখনই গাড়ি নামাতে চাচ্ছেন না। তবে সরকারের নির্দেশনা মেনে গণপরিবহন চালাতে অনুমতি দেয়ায় দূরপাল্লার গণপরিবহনের মালিকরা খুশি হয়েছেন। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমরা বাস চালাব। ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছি। মালিকরা বৈঠক করে স্বাস্থ্যবিধি মানার কৌশল ঠিক করেছেন। তবে ভাড়া না বাড়ালে মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়বে।  বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও শ্যামলী পরিবহনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাকেশ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালাতে হলে ভাড়া অবশ্যই ‘পুনর্বিন্যাস’ করতে হবে। এজন্য আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি।

এদিকে, গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গণপরিবহনের ভাড়া না বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের দাম কমানো এবং চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন লকডাউনের ফলে বহু মানুষ বেকার হয়ে গেছে। সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই তীব্র আর্থিক সংকট রয়েছে। এই অবস্থায় জনগণের ওপর বর্ধিত ভাড়া চাপিয়ে দেয়া হলে তা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হবে। তাছাড়া, গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ালে তা স্বাভাবিক সময়েও কমানোর নজির এদেশে নেই। এই অবস্থায় ভাড়া বাড়ানো সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।

বর্তমানে দেশে রিজার্ভারগুলোতে উপচে পড়া জ্বালানি তেল মজুদ রয়েছে। এই অবস্থায় জ¦ালানি তেলের দাম কমানো যেতে পারে। তাছাড়া পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি বন্ধ করলে গণপরিবহন কোম্পানিগুলোকে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের পরেও লোকশান গুনতে হবে না। রাজধানীতে চলাচলকারী প্রতিটি বাস-মিনিবাসকে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, আবার কোথাও ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। লেগুনাকে প্রতিদিন বিভিন্ন খাতে গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা বন্ধ এবং জ্বালানি তেলের দাম কমালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহনগুলো অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করলেও লোকসান হবে না।

অন্যদিকে বাস ভাড়া বাড়ানো, স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যবস্থা নেয়া, স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা এবং চাঁদাবাজি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গণপরিবহনে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এবং যাত্রীরা তা কতটা মেনে চলতে পারবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষ ও পরিবহন মালিকদের কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে পরিবহন কোম্পানিগুলো আশ্বাস দেয়, কিন্তু মেনে চলে না। এটা দেখার জন্য সরকারের একটি শক্তিশালী সংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করা উচিত। কিন্তু এই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কিছু বলা হয়নি।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, সীমিত আকারে গণপরিবহন চালানোর সিদ্ধান্তে গণপরিবহনে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বাড়বে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এবং নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, করোনা পরিস্থিতির অবনতি সত্ত্বেও সরকার জনজীবন ও অর্থনীতি সচল রাখার প্রয়োজনে অফিস-আদালত চালু এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে গণপরিবহন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু গণপরিবহন সীমিত আকারে চালুর বিষয়টি কীভাবে কার্যকর হবে, তা পরিষ্কার নয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা থাকলেও এটা বাস্তবায়ন করা বিরাট চ্যালেঞ্জ।

দীর্ঘদিন গণপরিবহন লকডাউন থাকার কারণে মালিক-শ্রমিকরা আর্থিক সংকটে। ফলে অধিকাংশ মালিক-শ্রমিক একযোগে সীমিত গণপরিবহনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে রাস্তায় গাড়ি চালাতে চাইবে। চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট ঘুষ ও চাঁদার বিনিময়ে তাদের পরিবহনকে সীমিত গণপরিবহনের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেবে। এভাবে প্রকারান্তরে প্রায় সব পরিবহনই রাস্তায় চললে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে এবং ব্যাপক চাঁদাবাজির ক্ষেত্র তৈরি হবে। এছাড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্পযাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাত্রীভাড়া বাড়াবেন। বাস্তবে কোনো পরিবহনই স্বল্পযাত্রী বহন করবে না, স্বাস্থ্যবিধিও মানবে না।

এদিকে স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করে আগামীকাল রবিবার থেকে লঞ্চ চলাচল শুরু হবে। তবে লঞ্চের ভাড়া বাড়ছে না। আগের নির্ধারিত ভাড়াতেই লঞ্চগুলো যাত্রী পরিবহন করবে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে লঞ্চ মালিক সমিতি ও নৌযান শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সরকারের সিদ্বান্ত অনুযায়ী আজ থেকেই নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও নৌযান চলাচল করবে। গতকালের বৈঠকে লঞ্চ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের ১৪টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক গণমাধ্যমকে জানান।

এই নির্দেশনা অনুযায়ী লঞ্চ চালাতে রাজি হয়েছেন। যাত্রীর ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মূলত স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে লঞ্চ চলাচল শুরু করা যায় তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। তবে শারীরিক দূরত্বে কারণে যদি যাত্রী কম হয় তাহলে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে পড়ে লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে আলোচনা হবে। জনসাধারণের উপরে যেন চাপ না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

এদিকে সব সড়ক-মহাসড়কে এখন ঢাকামুর্খী মানুষের ঢল। চাকরি বাঁচাতে গণপরিবহন ছাড়াই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সবাই ঢাকায় ফিরছে। রাজধানীর সবগুলো প্রবেশ পথে গতকাল সকাল থেকে মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। সড়কগুলোতে দিনভর ছিল মানুষের ঢল। চাপ সামলাতে হিমসিম খেতে হয় পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তাদের। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে সারাদিনই মানুষের ভিড় ছিল। ভোর থেকেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে ভিড় জমাতে থাকে। ফেরিগুলো ঘাটে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অন্যদিকে, শিমুলিয়া ঘাটেও মানুষের চাপ ছিল। ঈদের সময় যেতে না পারায় এখন অনেকেই গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটে গতকাল ভোর থেকেই চারটি রো রো ফেরিসহ মোট ১২ ফেরি চলাচল করেছে।

দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটেও ঢাকামুখী যাত্রীদের ভিড় ও ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বেড়েছে। গতকাল সকাল ৮টার পর থেকে এই চাপ বাড়তে শুরু করে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ রনি জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে যানবাহন ও সাধারণ যাত্রী পারাপারে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৬টি ফেরি চলাচল করছে। আজ থেকে ফেরির সংখ্যা বাড়ানো হবে। ঘাট এলাকা ও ফেরিতে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App