×

মুক্তচিন্তা

চীনের দেয়া ঋণ এখন মরণ ফাঁদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২০, ০৮:০৪ পিএম

চীনের দেয়া ঋণ এখন মরণ ফাঁদ

চীনের ঋণের জাল

চীনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ এখন মুখে মুখে। এ বিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি দেশ। তবে এই ঘটনার আগে থেকেই চীনের বিরুদ্ধে ছলে-বলে- কৌশলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ চাউর ছিল। বলা হতো, তারা উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশকে অবকাঠামোগত প্রকল্পের জন্য ঋণ গ্রহণে প্রলুব্ধ করে। এরপর সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালায়। ‘সিএফজিডি’ নামে একটি গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষণ মতে, আটটি দেশ শিগগিরই চীনের এধরণের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছে। দেশগুলো হলো- জিবুতি, কিরগিজস্তান, লাওস, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, মন্টিনিগ্রো, পাকিস্তান ও তাজিকিস্তান।

এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা একধাপ এগিয়ে। একটি উচ্চাভিলাষী বন্দর উন্নয়নে চীনকে বিনিয়োগ গ্রহণের সময় বুঝতে পারেনি বেইজিংয়ের কত ভয়ংকর ফাঁদে তারা পা দিচ্ছে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদসহ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে তারা ২০১৫ সালে বন্দর এবং এর আশেপাশের ১৫ হাজার একর জমি ৯৯ বছরের জন্য চীনকে ইজারা দিতে বাধ্য হয়।

একই ধরণের ফাঁদে পড়েছে আফ্রিকার দেশ জিবুতি। সেদেশের মূল বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ ভার চীনের কাছে হস্তান্তর করা এখন সময়ের ব্যাপার। দেশটিতে আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর মূল ঘাঁটি অবস্থিত। সঙ্গত কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপে জিবুতির ওপর ক্ষুব্ধ। কিরগিজস্তান ও মালদ্বীপ বন্দর, রেল যোগাযোগ ও খনির মতো কৌশলগত সম্পদগুলি চীনের তদারকিতে ন্যস্ত করতে বাধ্য হয়েছে।

মূলত উপকারভোগীদের প্রলুব্ধ করার পর তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলে দ্রুত হাতের মুঠোয় আনার লক্ষ্য নিয়ে চীনের ঋণ প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। চীনা ঋণের বিপরীতে উচ্চ সুদের হার গুনতে হয়। অপরদিকে ঘন ঘন সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। ফলে ঋণগ্রহিতা দেশগুলো ঋণ পরিশোধে হিমশিম খায়। এটাই হচ্ছে চীনা ‘ঋণের ফাঁদ’। এ কারণে প্রতি দুই বছর পর বা তারও আগে জামানত হিসেবে ব্যবহৃত স্ট্র্যাটেজিক জাতীয় সম্পদ পুনরায় তফশিল করার প্রয়োজন পড়ে। এ ধরণের চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ পাওয়ার সুযোগ থাকায় চীনে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলি দরিদ্র দেশগুলিতে ঋণ দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনা বিনিয়োগ ‘ট্রোজান ঘোড়া’র মতো, যা উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির আড়ালে জাতীয় অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রবেশ করে। এরপর দেশটিকে ‘কখনও পরিশোধযোগ্য নয়’ এমন ঋণের দিকে নিয়ে যায়। যা ‘ঋণের জাল’ হিসেবেও বহুল পরিচিত। অন্য কথায়, সস্তায় অবকাঠামো গড়ার টোপ ফেলে ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ করার পর সুদসহ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ‘ডিফল্টর’ হিসেবে চিহ্নিত করাই চীনা ঋণের লক্ষ্য। সময়মত পরিশোধ না করায় ঋণ বহুগুণে বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, জিবুতির কথা উল্লেখ করা যায়। চীনের কাছে দেশটির ঋণের পারিমাণ এখন তার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৮০ শতাংশেরও বেশি। অপরদিকে চীনের কাছে ইথিওপিয়ার ঋণ তার বার্ষিক আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ এবং কিরগিজস্তানের ৪০ শতাংশ বলে ধারণা করা যায়।

পাকিস্তানও একই দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতা গ্রহণ করেই ‘নতুন পাকিস্তান’ গড়ার এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি এ লক্ষ্যে কঠোর আইন প্রণয়ন করেন এবং দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালান। তার এ উদ্যোগের জন্য পাকিস্তানের জনগণ তাকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিসি) আওতাধীন প্রকল্পগুলিতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অপব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে ইমরান খান চুপ মেরে গেছেন। পাকিস্তানে উচ্চাভিলাষী হিসেবে স্বীকৃত এই প্রকল্প চীন সরকার এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘পানামা পেপারস’-এ নওয়াজ শরীফকে চীনা সংস্থাগুলির কাছ থেকে বিশাল অংকের অর্থ গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়। এই দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ শরীফ এখন জেল খাটছেন। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান সেনাবাহিনীই ইমরান খানকে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাধ্য করেছে। ধারণা করা যায়, চীনের সঙ্গে গোপন ডিলে সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। বাস্তবে চীন তাদের লক্ষ্য অর্জনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চরিত্র হননে কখনও দ্বিধা করে না।

৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর যা পাকিস্তানকে তার মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি দেবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। সম্প্রতি স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদন (আইপিপি) কেন্দ্র সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ ও শুল্ক ব্যবস্থায় অনিয়ম তদন্তের জন্য এই কমিশন গঠন করেছিলেন ইমরান খান নিজে। প্রতিবেদনে এই খাতে দুর্নীতির জন্য কয়েকটি সংস্থাকে দায়ি করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ'লো সিপিসি-র অধীনে দুটি চীনা অর্থায়নে প্রকল্প। এতে অনিয়মের জন্য হুয়ানং শ্যাডং রুই (পাক) শক্তি (এইচএসআর) বা শাহিওয়াল এবং বন্দর কাসিম বিদ্যুৎ সংস্থা লিমিটেড (পিকিউইপিসিএল) কয়লা প্লান্টকে দায়ি করা হয়।

গত ২১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এক বার্তায় তদন্ত কমিটির প্রশংসা করেন এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেন। কিন্তু তার এই ঘোষণার পর এক মাসেরও বেশি অতিবাহিত হলেও এ ব্যাপারে তিনি আর মুখ খোলেননি।

প্রসঙ্গত, সিপিসি চেয়ারম্যান লে. জেনারেল অসীম সলিম বাজওয়াকে প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর জনসংযোগ শাখার প্রাক্তন ডিজি বাজওয়া মনে করেন, চীনা অপব্যবহারের বিষয়ে আইপিপির রিপোর্ট সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশে মিডিয়াকে আরও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য তাকে বর্তমান পদে নিয়ে আসা হয়েছে।

ধারণা করা হয়, ইমরান খানের ঘোষণার পর পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং চীনা প্রকল্পগুলির সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেন। এরপরই পাকিস্তান বুঝতে পারে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি'র পোষ্য প্রকল্প বিআরআইয়ের সমালোচনা তারা সহ্য করতে নারাজ। ‘করুণাভাইরাস’ মহামারী পরবর্তী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পাকিস্তান ইতোমধ্যে ঋণ তফশিল পুনর্গঠনের জন্য চীনকে অনুরোধ করেছে। তাই দেশটির দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত রয়েছে বেইজিং।

এদিকে চীন তার উচ্চাভিলাষি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পকে যতই উভয়ের জন্য সমান লাভজনক বলে দাবি করুক না কেন অন্যদের কথা বাদ দিলেও তার সবচেয়ে বড় মিত্রদেশ পাকিস্তান এখন সন্দেহ পোষণ করছে। এই প্রকল্পের সঙ্গে এশিয়া ও আফ্রিকার ৬০টি দেশ জড়িত। তারা বিশ্ব বাণিজ্যে শরীক হওয়ার আশায় এই প্রকল্পে জড়িত হয়। তাছাড়া প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে ঋণ পাওয়া যথেষ্ট সহজ হওয়ায় তারা প্রলুব্ধ হয়। এই ঋণ এখন গ্রহিতাদের গলার কাঁটা। এই ঋণের অদেখা শর্তের কল্যাণে কমপক্ষে ৮টি দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। আরও অনেক দেশের একই পরিণতি হতে পারে। এর আগে তারা ঋণ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

লেখক: সাংবাদিক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App