×

জাতীয়

ভয়ঙ্কর পথে যাত্রা শুরু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২০, ০১:১৬ পিএম

দেশে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময় সাধারণ ছুটির মেয়াদ না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাত দফা সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর পর সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই পহেলা জুন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অফিস-কল-কারখানা-ব্যাংক এমনকি গণপরিবহনও চালু হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ এবং ‘সীমিত পরিসরে’ এই দুটি কথা বারবার বললেও কার্যত খুব একটা এর প্রয়োগ হয়নি। দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময়ে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে হতাশ রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা বলছেন, এমন সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয় সরকারের কাছে জনস্বাস্থ্যের চেয়ে অর্থনীতির প্রাধান্যই বেশি। প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে সরকার এক ধরনের আত্মসমর্পণই করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে পহেলা জুন থেকে দেশ এক ভয়ঙ্কর পথে যাত্রা করবে। তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে নিজের সুরক্ষা নিজেকেই করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। ব্যক্তিগত সুরক্ষাই এক্ষেত্রে রক্ষাকবচ। সংক্রমণের ধারা নিম্নমুখী হলে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ও করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, টেকনিক্যাল কমিটির পক্ষ থেকে বার বারই কার্যকর লকডাউনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে তা শিথিল করার পক্ষে মত দিয়েছি। আমরা বলেছি, করোনা সংক্রমণের ধারা যখন কমে আসবে তখন লকডাউন শিথিল করা যাবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঈদে আমরা মানুষকে গ্রামে ও বিভিন্ন এলাকায় যেতে দেখেছি। তারা যখন ঢাকায় বা নিজ কর্মস্থলে ফিরে আসবে তখন করোনার সংক্রমণের একটা ঢেউ আসবে। আগে যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি ছিল না এখন ওই সব এলাকাতেও সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছে। এসব বিবেচনায় সরকারের এমন সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির অন্য সদস্য রোগতত্ত¡বিদ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন দেশে কার্যত লকডাউন কখনোই মানা হয়নি। ফলে সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে পহেলা জুন থেকে সব কিছু খুলে দিলে ব্যক্তিগত সুরক্ষাই একমাত্র রক্ষাকবচ। তাই নিজের সুরক্ষায় নিজেকেই সচেষ্ট হবার পরামর্শ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য। তিনি নাক-মুখ ঢাকা থাকে এমন মাস্ক ব্যবহার, চোখে চশমা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও রোগতত্ত্ববিদ ভোরের কাগজকে বলেন, এমন সিদ্ধান্তে এটা স্পষ্ট, সরকারের কাছে অর্থনীতিই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, জনস্বাস্থ্য নয়। প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে সরকার যে এক ধরনের আত্মসমর্পণ করেছে। মনে হয় সরকার হার্ড ইমিউনিটির ওপর ভরসা করতে চলেছে। কিন্তু এর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক যে মূল্য দিতে হবে তার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? হার্ড ইমিউনিটির দিকে গেলে কত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরবে সেই দিকটিও ভাবতে হবে। পহেলা জুন থেকে ভয়ঙ্কর এক পথে যাত্রা করব আমরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, যখন একটি এলাকার বেশিরভাগ মানুষকে কোনো একটি সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক দেয়া হয় তখন ওই এলাকায় ওই রোগটির ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ ওই এলাকায় আর সংক্রমিত হওয়ার মতো মানুষ কম থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি এলাকায় যদি হাম দেখা দেয়, আর বেশিরভাগ মানুষের যদি টিকা দেয়া থাকে তাহলে ওই রোগটি আর অন্য কারো মধ্যে ছড়াতে পারে না। কিন্তু করোনা ভাইরাসের এখনো কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তাহলে এটি মোকাবিলায় হার্ড ইমিউনিটি কিভাবে কাজ করবে? এ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, যারা একবার ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়, তাদের মধ্যে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। এভাবে বেশি বেশি মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে থাকলে এক সময় অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ভাইরাসের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। যার কারণে মানুষের মধ্যে একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি হয় এবং রোগটির সংক্রমণ থেমে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে হলে কমপক্ষে ৭০ ভাগ মানুষকে এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে হবে। এর আগে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ হার্ড ইমিউনিটির কথা চিন্তা করলেও পরবর্তীতে তারা অবস্থান পরিবর্তন করেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও কাঠামাগত যে অবস্থা তাতে হঠাৎ করে রোগী বাড়লে এই স্বাস্থ্যব্যবস্থা দিয়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফলে এ সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। সরকারের ঘোষণায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে গেছে এবং সামনে আরো ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা করছেন পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, আমাদের দেশে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। অনেক সময় পাবার পরও আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। তবুও আমি বলব, এখনো সময় আছে। এখনো অনেক জেলা ও এলাকায় করোনার সংক্রমণ কম আছে। করোনার সংক্রমণ যেহেতু স্বাস্থ্যগত সমস্যা তাই আমি বলব প্রতিটি জেলায় এর সংক্রমণ রোধে সিভিল সার্জনকে দায়িত্ব দেয়া হোক। সেই সঙ্গে ওই জেলার ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে প্রতিটি জেলায় আলাদা কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হোক। যেসব জেলায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা একশর কম তাকে সবুজ, একশ থেকে ৩শ আক্রান্ত ব্যক্তির শনাক্ত জেলাকে হলুদ এবং ৩শর বেশি রোগী শনাক্ত এলাকাকে লাল এই তিন জোনে ভাগ করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমরা স্বাস্থ্য রক্ষা করব নাকি অর্থনীতি এমনই একটি সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুধু আমাদের দেশই নয়, বিশে^র অনেক দেশই এই উভয় সংকটে পড়েছে। তবে আমাদের দেশে এখন সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে জনস্বাস্থ্যর দিক দিয়ে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত খুবই ক্ষতিকর। এতে সংক্রমণের হার আরো বাড়বে। নিকট অতীতে সরকার নির্দেশিত সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়নি। ঈদের সময় নির্দেশ অমান্য করে মানুষ গ্রামে ও বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে এটা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের জীবন আমাদেরই হাতে। স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কিনা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে কিনা এসব বিষয়ে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি সরকারের স্বাস্থ্য ও পুুলিশ প্রশাসন বিভাগের মনিটরিং ব্যবস্থার ওপর জোর দেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App