×

জাতীয়

চাঁদ রাতেও এলো না করোনাযোদ্ধাদের সুখবর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২০, ০৯:৫১ পিএম

করোনাকালীন সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। কিন্তু গত দুই দিন আগেও বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে আন্দোলন করেছে বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু তাদের সেই দাবি ঈদের আগের দিনও পূরণ হয়নি। অন্যসময় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আয় ভাল হলেও এই করোনা পরিস্থিতিতে তা অনেকটাই কমে এসেছে। আয় কমে যাওয়ার জের গিয়ে পড়েছে চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীর অনেকেরই এখনো বেতন, বোনাস হয়নি। অনেকের মিলেছে অর্ধেক বেতন। আবার অনেকের কয়েক মাসের বেতন বকেয়া আছে। অনেককে করা হয়েছে ছাঁটাই। অনেককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এর আগে ২২ মে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর পূর্ণ বেতন ও ঈদ বোনাস দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। আবেদনে বলা হয়, গত ২ মে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) নির্দেশিকায় বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারীতে সব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সংগঠনের সদস্যভুক্ত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মচারীদের উৎসব বোনাস দেয়া হবে না। এপ্রিল মাসের বেতন, যা মে মাসে দেয়ার কথা তা সব অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের মোট বেতনের ৬০ শতাংশ দেওয়া হবে। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির সব কর্মচারী তাদের শতভাগ বেতন পাবেন। কলেজ স্টাফ যারা অনুপস্থিত তারা ৬০ শতাংশ বেতন পাবেন। আর যেসব চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মী হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন, তাদের বেতনের শতভাগ দেওয়া হবে। তবে ৪ মে এ নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

রিট আবেদনকারী আইনজীবী বলেন, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হলেও বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ আসছে যে, চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের পূর্ণাঙ্গ বেতন ও বোনাস দেয়া হচ্ছে না। প্রায় ২০ হাজারের মতো চিকিৎসক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে চাকরি করেন। তাদের যদি যথাযথ বেতন না দেয়া হয় তাহলে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা দিতে উৎসাহী হবেন না। এজন্য বিবাদীদের নির্দেশনা দিতে রিট আবেদনটি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) হিসেব অনুযায়ী, চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-বোনাস দিয়েছে মাত্র ৮টি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ৩১টি প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যকর্মীরা এপ্রিল মাসের বেতন পেয়েছেন। ১২টি হাসপাতালে পুরো বেতনের পরিবর্তে বেতনের ৫০ থেকে ৭০ ভাগ দেয়া হয়েছে। কর্মীদের দুই থেকে ১২ মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া আছে ৮টি হাসপাতালে। আর সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি এন্ড রাইটসের তথ্য অনুযায়ী, ৫০’টিরও বেশি নার্সিং কলেজ এন্ড ইন্সটিটিউটে বেতন বোনাস বন্ধ আছে। এই তালিকায় রয়েছে নামী দামি অনেক প্রতিষ্ঠানের নামও।

বিডিএফের হিসেব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত (২৪ মে) ৮১২ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ জন। সুস্থ হয়েছেন ৩১৬ জন। সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি এন্ড রাইটসের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৭০৩ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন ১৫৫ জন।

বেতন বোনাস দেয়া হাসপাতাল: ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ডায়াবেটিস ও সবাস্থ্য সেবা হাসপাতাল (দিনাজপুর), এনএইচএন (ঢাকা), ইবনে সিনা হাসপাতাল (সিলেট),মনোয়ারা হাসপাতাল (ঢাকা), চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল (ঢাকা)।

বেতনের ৫০ থেকে ৭০ ভাগ দিয়েছে যে সব প্রতিষ্ঠান: আদ দ্বীন মেডিকেল খুলনা, আদ দ্বীন মেডিকেল যশোর, কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল, মুন্নু মেডিকেল (মানিকগঞ্জ), ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল। ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল আগামী তিন মাসও চিকিৎসকদের অর্ধেক বেতন দেবে বলে হাসপাতার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। কেয়ার মেডিকেল ফেব্রেুয়ারি মাসে শেষ বেতন দিয়েছে। তাও অর্ধেক। সেন্ট্রাল মেডিকেল কুমিল্লা ( ৭০%), ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল, টঙ্গী বেতনের ৬০ ভাগ গিয়েছে। রংপুর কমিউনিটি মেডিকেলের সবাইকে বেতন দেয় হয়নি। তবে চিকিৎসকদের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়েছে ২০ দিন (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত)। ময়নামতি মেডিকেলের অধ্যাপকরা ৫০, সিএ ও রেজিস্টার ৬০, লেকচারাররা মোট বেতনের ৭০ ভাগ পেয়েছেন। টিএমএসএস বগুড়া মেডিকেলের চিকিৎসকরা ঠিকমত বেতন পাচ্ছেন না। উপরন্তু অনেককে ছাটাই করা হয়েছে। ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেলে কর্মরত অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসকদের বেতন দেয়া হয়নি।

দীর্ঘদিন যাবত বেতন বন্ধ : এই তালিকায় আছে নামিদামী হাসপাতালগুলো। ইউ এস বাংলা মেডিকেল (৫ মাস), হলি ফ্যামিলি মেডিকেল (৩ মাস) , সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল ( ৬ মাস), শাহাবুদ্দীন মেডিকেল কলেজ ( ২ মাস), ম্যান্ডি ডেন্টাল কলেজ (১০ মাস), সিটি ডেন্টাল কলেজ ( ১২ মাস), নর্দান মেডিকেল, রংপুর ( ৩ মাস), সিটি মেডিকেল কলেজের বেতন বন্ধ ৬ মাস যাবৎ।

এপ্রিলের বেতন দিয়েছে যেসব হাসপাতাল : পপুলার মেডিকেল কলেজ, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ, গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ডেল্টা মেডিকেল কলেজ, সাপ্পারো ডেন্টাল কলেজ, এনাম মেডিকেল কলেজ, পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ (উত্তরা), বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ (ঢাকা), ইব্রাহীম কার্ডিয়াক (ঢাকা) , শিকদার মেডিকেল কলেজ (ঢাকা), উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ, জহুরুল হক মেডিকেল কলেজ (বাজিতপুর), খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ (সিরাজগঞ্জ), নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ (সিরাজগঞ্জ), ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন মেডিকেল কলেজ (ফরিদপুর), চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিকেল কলেজ (চট্টগ্রাম), ইউএইচটিসি মেডিকেল কলেজ (চট্টগ্রাম), ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল (চট্টগ্রাম), সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ (চট্টগ্রাম), ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ (কুমিল্লা), সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ (কুমিল্লা), ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ, কমিউনিটি বেইজড মেডিকেল (ময়মনসিংহ), খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ, আর্মি মেডিকেল কলেজ (বগুড়া), ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ (রাজশাহী), বারিন্দ মেডিকেল কলেজ (রাজশাহী), জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া (সিলেট), প্রো একটিভ মেডিকেল কলেজ (নারায়ণগঞ্জ)।

বেতন ও বোনাস হয়নি যেমন নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটে : ইমপালস হাসপাতাল (ঢাকা), আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢাকা), মার্ক নার্সিং কলেজ (ঢাকা), কমিউনিটি বেইসড নার্সিং কলেজ ( ময়মনসিংহ), ট্রমা নার্সিং ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সাল নার্সিং কলেজ, আর্ট নার্সিং কলেজ, কুমিল্লা, অক্সফোর্ড নার্সিং ইনস্টিটিউট, শ্যামলী নার্সিং ইনস্টিটিউট, ইউনি হেল্থ নার্সিং ইনস্টিটিউট, সাইক গ্রুপের সকল নার্সিং ইনস্টিটিউট ও কলেজ, স্কাবো নার্সিং কলেজ (ময়মনসিংহ), স্কলার্স নার্সিং ইনস্টিটিউট (ময়মনসিংহ), ময়মনসিংহ উইমেন্স নার্সিং ইনস্টিটিউট, মোমেনশাহী নার্সিং ইনস্টিটিউট, কমিউনিটি বেজ্ড নার্সিং ইনস্টিটিউট (ময়মনসিংহ), ডা. হালিমা খাতুন নার্সিং ইনস্টিটিউট (ময়মনসিংহ), সুরতোন নেছা নার্সিং ইনস্টিটিউট (ময়মনসিংহ), আইডিয়াল নার্সিং ইনস্টিটিউট (পাবনা), আনোয়ারা নার্সিং কলেজ (দিনাজপুর), স্মার্ট নার্সিং ইনস্টিটিউট (পাবনা), ব্রাইট নেশন নার্সিং ইনস্টিটিউট (পাবনা), পাবনা কমিউনিটি নার্সিং ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইন্টান্যাশনাল মেডিকল কলেজ হাসপাতাল (গাজীপুর), আল বারাকা হাসপাতাল (কেরাণীগঞ্জ), ঢাকা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডেল্টা হাসপাতাল (ঢাকা), আজগর আলী হাসপাতাল, ধানমণ্ডি কিডনি এন্ড জেনারেল হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল (চট্টগ্রাম), ম্যাক্স হাসপাতাল (চট্টগ্রাম), ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল (চট্টগ্রাম), ফেমাস হাসপাতাল (লক্ষ্মীপুর), কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট ওমেন্স হাসপাতাল, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন (সিলেট), জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (বগুড়া), প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (রংপুর), কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (সিরাজগঞ্জ), হলি ফ্যামেলি এন্ড রেডক্রিসেন্ট নার্সিং কলেজ, ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতাল (ঢাকা)।

বিডিএফের চেয়ারম্যান ডা. মো. শাহেদ রাফি পাভেল এবং সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি এন্ড রাইটসের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির মাহমুদ জানান, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সরা বেতন ও বোনাস পেয়েছেন। তাদের সুযোগ সুবিধাও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের তুলনায় অনেক বেশি। করোনা কালীন বেসরকারি হাসপাতালের অনেক চিকিৎসক ও নার্স বেতন পাননি, বোনাস পাননি। অনেকে অর্ধেক বেতন পেয়েছে। অনেকে আশা করেছিলেন ঈদের আগে হয়তো এই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু হলো না।

তবে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) সভাপতি এম এ মুবিন খান জানান,স্বাস্থ্যকর্মীরা বেতন পাচেছ না বলে যে অভিযোগ করছে তা সঠিক নয়। তাদের কাছে এমন অভিযোগ নেই। শুধু তাদের কাছেই নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ডিন অফিসে কোথাও এই অফিযোগ নেই। তিনি দাবি করেন, ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ হাসপাতালের বেতন দেয়া হয়ে গেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App