×

বিশেষ সংখ্যা

রাজিন তার কাক্কা এবং আমি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২০, ০৫:২২ পিএম

রাজিন তার কাক্কা এবং আমি

রাজিন দেখতে কী রকম? রাজিনের বয়স কত? বয়সের কথা আগে বলি! রাজিনের বয়স একশ এখনো হয়নি। হবে। একশ বছর আয়ুকে বলে শতায়ু। রাজিন শতায়ু হবে আমি শিওর। এখন তবে বয়স কত রাজিনের? জানি না। যদিও মাত্র দুই দিন আগে একটা জন্মদিন গেছে রাজিনের। আমি তাকে উইশও করেছি। কিন্তু সেটা তার কততম জন্মদিন, জিগ্যেস করিনি। বয়স কোনো ব্যাপার? এখন বলি রাজিন কী রকম দেখতে। গোলগাপ্পা না ট্যাঙটুঙ? আমি জানি না। সত্যি জানি না। আমি এখনো দেখিনি রাজিনকে। তবে আমি চিনি রাজিনকে। কী করে চিনি? রাজিনের কাকা আমার বন্ধু। মস্ত বড় বন্ধু, মস্ত বড় লেখক। শুধু ছোটদের জন্য লিখেন। আমি তার অনেক বইয়ের মলাট করেছি। সেটা হয়তো একটা ব্যাপার, আবার হয়তো ব্যাপারও না। কত লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ আমি করি, সবাই কি আর রাজিনের কাকা? করোনা আতংকে আমরা অনেকেই এখন হোম কোয়ারেন্টাইন, সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে আছি। আমি একা থাকি, কে খোঁজ নেয়? খোঁজখবর রাখেন যে দুইজন, তাদের একজন হলেন রাজিনের কাকা। আরেক জনের কথা এখানে বলছি না। রাজিনের গল্পের সঙ্গে তার যোগ নেই। রাজিন তারা কাকাকে ডাকে কাক্কা। আমিও এই গল্পে কাক্কাই ডাকব। কেন ডাকব? আমার ইচ্ছা। না থাকলে খুব ভালো হতো কিন্তু আমার একটা মোবাইল ফোন আছে। স্মার্টফোন না, সাধারণ ফোন। ছবি ওঠানো যায় কিন্তু মেমরি কার্ড নেই। নিইনি। কল, মেসেজ করেই হিমশিম খেয়ে যাই, আবার ছবি। ইউটিউব, গুগল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামেও আমি নাই। না হলে এতদিনে দেখে ফেলতে পারতাম রাজিনকে। আফসোস নাই অবশ্য কিছু। রাজিনের সঙ্গে আমার দেখা হবেই। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশনের এই দিনগুলো যাক। ফেব্রুয়ারি থেকেই নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর কথা শোনা যাচ্ছিল। মারাত্মক ভাইরাস। প্রাণঘাতী। ছোঁয়াচে। মোকাবিলার একমাত্র উপায় ঘরে বসে থাকো। মার্চের ৮ তারিখে আমাদের দেশে একজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন শুনলাম। একজন, দুইজন, ছয়জন, আটাশ জন করে সংখ্যাটা এখন দিন দিন বাড়ছে। আজ বুধবার, ১৩ তারিখ মে’র। আজ আমাদের দেশে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন এগারশ বাষট্টিজন। মারা গেছেন উনিশ জন মানুষ। তাদের মধ্যে এক শিশুও আছে। বহু আগে থেকে বাংলার মানুষকে বারবার বলা হচ্ছে ঘরে থাকো। লক ডাউনে অচল হয়ে যাচ্ছে দেশ। তাও বাংলার কিছু মানুষ কথা শুনছে না। তারা বেরুচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব বলেও কিছু মানছে না, কেন? ভয়ডর কি নেই তাদের? না তারা বোকা? বোকা। নির্বোধ। একবেলা অন্ন জোটে না এমন মানুষের কথা বলছি না, আর যারা আছেন তারা। জুজুর ভয় বলে। জুজু কী? জুজুকে ভয় পায় কেন মানুষ? কেউ কখনো দেখেছে জুজুকে? দেখবে কী করে? জুজু বানানো। কাল্পনিক কিছু। করোনা ভাইরাস কাল্পনিক নয়। কাল্পনিক জুজুর থেকেও বহুগুণ মারাত্মক। কোয়ারেন্টাইনের হিসাব চৌদ্দ দিন। আমি আছি কতদিন ধরে? চার কোয়ারেন্টাইন হয়ে গেছে। ঘরে বসে থাকি, বসে থাকি শুধু, কাজকর্ম কিছু করি না, বই পড়ি না, টিভি দেখিনা। বাজে লাগে। এত বাজে দিন কখনো ভাবিনি। ফোন খুলি দিনে এক দুইবার। যার সঙ্গেই কথা বলি একমাত্র বিষয় হলো করোনা। অসহ্য লাগে। কোয়ারেন্টাইনের দিন : ৮ এ সম্ভবত, ঘুম থেকে উঠেছি, ভীষণ মন খারাপ। ফোন খুলে একটা মেসেজ লিখে সেন্ড করে আবার ফোন অফ করে দিলাম। মেসেজ টু কাক্কা। : আপনি আর সবার খবর রাখেন, আমার কোনো খবর রাখেন না। ফোন খুললাম রাত ১২টার পর আর। ১২:১২। কাক্কা কল দিলেন। ‘কী মিয়া? কী করো? ফোন বন্ধ রাখছ সারাদিন!’ ‘ভালো লাগে না, কাক্কা।’ ‘ভালো লাগবে না ক্যান মিয়া! তুমিতো শব্দ লাইক করোনা, শব্দহীন এই শহরে তো সবচেয়ে ভালো থাকনের কথা তোমার।’ ‘শব্দ না, কাক্কা। আমি পছন্দ করি না কোলাহল।’ ‘একই তো মিয়া। নাগরিক কোলাহল নাই এখন ঢাকায়। পৃথিবীর সব শহর এখন ফার ফ্রম দ্য মেকিং ক্রাউড, বুঝছ না? কী করো সারাদিন?’ ‘বসে থাকি?’ ‘বসে কী করো? যোগব্যায়াম? ধনুর্ভঙ্গাসন, অষ্টবক্রাসন?’ ‘না কাক্কা। আধ্যাত্মিক কিছুর চর্চা আমি করি না। ফর্মুলা ওয়ান- যোগ আর যোগ, এক না।’ ‘ফর্মুলা ওয়ান যোগ, ভালো কইছ মিয়া। শোনো এখন কালকে দুপুরে কি খাইবা কও। নিরামিষ, মাছ, গরু কোনটা? না সবটাই?’ ‘আপনি যা পাঠাবেন কাক্কা।’ ‘দাঁড়াও দেখি ফ্রিজে কী আছে?’ ‘আরে, আপনি কি এখনই রান্না করবেন নাকি?’ ‘এখন না মিয়া সকালে করুম। তবুও দেখি। তোমার ডিপ্রেশন কাটে সেই রকম আইটেম রান্না করন লাগব তো, বুঝছ না? আর ডিপ্রেশন। কাক্কার সঙ্গে কথা বললেই আমার ডিপ্রেশন অর্ধেক কেটে যায়। বিশ্বভরা প্রাণ মার্কা মানুষ, আমার দেখা এই একজনই। আর রান্না! মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া, মাস্টারশেফ ইন্ডিয়া না, কাক্কা হলেন মাস্টারশেফ ইউনিভার্স। আমি একটা কথা গল্প করে বলি, কাক্কা পানিও রান্না করতে পারেন। কথা শেষ হয়নি। ‘বইপত্র কিছু তোমার লাগব?’ কাক্কা বললেন। ‘না কাক্কা। আমি কিছুই পড়তে পারতেছি না।’ ‘পড়ো মিয়া। স্কুল লাইফে পড়ছ এমন কোনো একটা বইয়ের কথা মনে করো, যেটা এখন পড়লে ভালো লাগব তোমার।’ ‘রূপের ডালি খেলা’ আছে আপনার কাছে?’ ‘সাত কপি মিয়া। আচ্ছা শোনো, কথা বলো একটু।...এই! এদিকে আয়।...ধর। কথা বল।...কে, তুই জিগা?’ আমি আন্দাজ করতে পারলাম না কে। কাক্কা এখন অফিসে না, বাসায়। এই রাত বারোটায় তার ঘরে কোন চ্যালা? কাক্কার চ্যালাশুমারি করা কঠিন। এত চ্যালা। করোনার এই রাতেও কাক্কা চ্যালা সমভিব্যবহারে আছেন। ‘হ্যালো।’ মিষ্টি রিনরিনে একটা পাখি শিস দিল। ‘হ্যালো?’ ‘আসসালামওয়ালিকুম।’ ‘ওয়ালিকুম সালাম। তুমি কে?’ ‘আমি রাজিন।’ তুমি কেমন আছ, রাজিন?’ ‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’ ‘ভালো আছি।’ ‘আপনি কে?’ ‘আমি? কে? মনে নাই তো।’ ‘আপনি কি মাওলানা ফসিউদ্দিন?’ ‘কী? কী-কী-কী? মাওলানা ফসিউদ্দিন? হা! হা! হা!’ ‘হ্যাঁ। কাক্কার ফোনে ছবি দেখেছি। এই লম্বা দাড়ি না আপনার? আর শাদা?’ ‘হ্যাঁ-এ-এ।’ ‘এখন বলেন আপনি কে?’ ‘মাওলানা ফসিউদ্দিন।’ এই হলো উপক্রমণিকা। পরদিন দুপুর ১২টায় কলবেল। দরজা খুলে দেখি মাস্কপরা রিপন। কাক্কার গাড়ির ড্রাইভার। হাতে ব্যাগ আছে। ‘কী রিপন?’ ‘বসে পাঠাইছে। আপনারে কল দিতে বলছে।’ ‘দেব, যাও।’ হাতের ব্যাগ রেখে চলে গেল রিপন। ব্যাগে কী? বড়ো বড় তিনটা প্লাস্টিকের বক্স আর একটা বাঁশপাতা কাগজের প্যাকেট। প্লাস্টিকের বক্সে খাদ্য নিশ্চিত। বাঁশপাতা কাগজের প্যাকেট খুললাম। সেই বইটা, সেই মলাট। ‘রূপের ডালি খেলা।’ রুশ দেশের বই। লেখকের নাম ইউ. ইয়াকভলেভ বইয়ের সঙ্গে কাক্কা একটা দুই পাতার চিঠিও লিখে দিয়েছেন। এই মোবাইল যুগে আমি মিস করি কী? রাস্তার ধারের লাল পোস্টবক্স। দেখলেই চিঠি মনে পড়ত। আমাকে যদি কেউ একদিন একটা লাল পোস্টবক্স ভরতি চিঠি লিখত! কাক্কার চিঠিটা আগে পড়লাম। দুবার পড়লাম। অনুপ্রেরণামূলক। কাক্কার বিশ্বভরা প্রাণ ফুরায়নি করোনায়। ‘রূপের ডালি খেলা।’ বহুদিন পর বইটা। কত বছর পর? ঘ্রাণ নিলাম। পাতা উল্টালাম। ছোটো সময়ে পড়া প্রিয় বই নাকি বড়ি হয়ে নাকি পড়তে নাই আর। এটা আসলে কোনো কাজের কথা না। পড়ার সময় ছোট হয়ে গেলেই হয়। প্রথম কোন গল্পটা পড়ব? ‘বীরব্রতী ভাসিয়া’? ‘কোথায় আকাশের শুরু?’ না। ‘রূপের ডালি খেলা।’ পড়ে বহুদিন পর আমার মন রিমঝিম করে উঠল। নিনকার জন্য মন খারাপ হলো। এই এক জাদু। তুমি ছেলে হও কী মেয়ে এই গল্প নিনকা বানিয়ে দেবে তোমাকে। নিনকার মা তোমার মা হয়ে যাবেন। বৃষ্টিতে ‘রূপের ডালি খেলা’ খেলবে তোমরাও। এনা, বেনা, রেসা কুইন্তের, কন্তের, জেস... একা মানুষের চোখ ভিজে কম, তবে আমার বুকের ভেতরে অনেকক্ষণ কিরকম হয়ে থাকল। লকডাউনের পর থেকে আমি নিজে রান্নাবান্না করে খাচ্ছি। ভাত এবং ভর্তা ফ্যাক্টরি। কাঁচকলা ভর্তা, আলু ভর্তা, পেঁপে ভর্তা, ডিম ভর্তা। খেয়ে নেয়া যায় গোছের হয়। আর কেউ খাচ্ছে না, এই এক স্বস্তি । কিছু মানুষ আছেন যারা অন্য মানুষকে চমকে ভর্তা করে দিতে পারেন। কাক্কা তেমন এবং তাই করলেন। যা পাঠিয়েছেন রাজার খাদ্য। চিতল মাছ, শুকতো, শুঁটকির ঝোল এবং আমডাল। অমৃততুল্য পদ। কাক্কার মতো শুকতো এখনকার পিসিমারাও রাঁধতে পারবেন না। চিতল মাছ, শুটকি, আমডাল খেয়ে মনে হলো জমিদারি ফিরে পেলাম বুঝি। কবে যে আমি জমিদার ছিলাম! নাকি আমি নবাবের বংশধর? বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার? নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বংশধরের নাম কি মাওলানা ফসিউদ্দিন হতে পারে? অবশ্যই পারে। মনে রাখতে হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প! হতে পারে না বলে জগতে কিছু নাই আর। করোনা রঙিন একটা দিন তবে যায়। কোভিড-১৯-এর যে সমস্ত ছবি আমাদের দেখাচ্ছে মিডিয়া, তারা খুব রঙিন। ভয়ংকর সুন্দর! ভাতঘুম দিলাম বহুকাল পর। জমিদারি ঘুম। উঠে দেখি ঘরদোর বিল্ডিং প্যাঁচার মতো মুখ অন্ধকার করে আছে। আকাশের রং মোষের রঙের মতো। বৃষ্টি নামল। ঝুম বৃষ্টি। বারান্দায় বসে দেখলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা এক শহরে বৃষ্টি। টার্নার এখন থাকলে ভালো হতো। এই বৃষ্টির ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেন। সন্ধ্যা কখন হলো বোঝা গেল না। বৃষ্টিও ধরল না। রাতের অন্ধকার এবং ম্রিয়মাণ নগরীর আলোকে বিপর্যস্ত করে রাখল। রুটিন। সন্ধ্যায় আমি একবার অবশ্যই ফোন করি আমার এক বন্ধুকে। মান্না। শুভংকর তালুকদার। আমাদের শহরে সরকারি কলেজ এবং মহিলা কলেজ ছাড়া আরো একটা কলেজ আছে। পৌর কলেজ। শুভংকর তালুকদার ব্রাকেটে মান্না সেই কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। ‘কী রে মান্না?’ ‘কী রে?’ ‘বৃষ্টি হয়?’ ‘বৃষ্টি মানে। তুফান ব্যাটা। শব্দ শুনতেছিস না?’ শুনছি। আমাদের শহরের বাতাসের শব্দ। বৃষ্টির শব্দ। মান্না বলল, ‘দুপুরে কী খাইছিস? আলু ভর্তা?’ ‘না রে মান্না। চিতল মাছ, শুকতানি আর শুঁটকি!’ ‘চিতল মাছ, শুঁটকি, শুকতানি! কে দিল তোরে?’ ‘আরে কে, কাক্কা!’ মান্না কাক্কা সম্পর্কে অবহিত। বলল, ‘এই মানুষটা তোরে বড় মায়া করে রে।’ মনে হয়। বৃষ্টি ধরল। এশার আজান হলো। রাতে আমি এখন চোখে কম দেখি। বইয়ে ছাপা বারো পয়েন্টের অক্ষরও ভালো করে পড়তে পারি না। পাওয়ার বদলাতে হবে চশমার। লকডাউনের পরে। ‘রূপের ডালি খেলা’ অবশ্য বারো পয়েন্টে ছাপানো বই নয়। আবার ধরলাম। ‘কিজিল কাঠের ছড়ি’ পড়লাম। এই বইয়ের কোন গল্পটা সবচেয়ে সুন্দর? বারোটাই। ‘রুটির ফুল’ পড়ব, কাক্কা কল দিলেন। ‘কী করো মিয়া?’ ‘রূপের ডালি খেলা পড়ি কাক্কা। কোয়ারেন্টাইনে আছি আর যে কয়দিন এই একটা বই-ই পড়ব। বারবার পড়ব। বিশ্বাস করেন আমার মাথায় এখন কোভিড-১৯ নাই। আমি, এখন পাশা সেদভের সঙ্গে হাঁটতেছি। পাশা সেদভের শহরে করোনা ঢুকে নাই।’ ‘ভালো কইছ মিয়া। ভালো বই এই রকমই। আমি এখন একটা বই লিখতেছি, বুঝছ। আমার রবীন্দ্রনাথ। কোনো রেফারেন্স ছাড়াই লিখতেছি। কিছু হইতেছে কি না, বুঝতেছি না। বাদ দেও। চিতল মাছ খাইছ?’ ‘সব খাইছি, কাক্কা। রাতেও খাব। কাল দুপুরেও খাব।’ ‘আরে না মিয়া, কাইল দুপুরের আগেই আমি রিপনরে পাঠামু। কাইলকা দেখি খাসির একটা স্পেশাল প্রিপারেশন করা যায় কি না। আর শোনো আজকে তো তোমারে মরিচের আচার পাঠাইতে ভুইলা গেছি মিয়া। কাইলকা পাঠাইয়া দিমুনে।’ ‘আইচ্ছা, কাক্কা।’ ‘খাবার কেমন হইছে কইলা না মিয়া?’ ‘অমৃততুল্য বলা যাবে না, অমৃতের মা হইছে কাক্কা। দুপুরে থেকে আমার মনে হইতেছে কী, আমি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বংশধর হইলেও হইতে পারি। তবে জমিদার তাতে কোনো সন্দেহ নাই। পুরানা পল্টন লাইন মৌজার জমিদার। ভাত ঘুম দিলাম পর্যন্ত। আপনি একটা রান্নার বই লেখেন কাক্কা।’ ‘আমার লেখা তো কিছু হয় না, বুঝলা না?’ ‘কী হয় না! কোন পণ্ডিত বলছেন?’ ‘পণ্ডিতের মুখেই শোনো।...এই রাজিন! রাজিন! এই দিকে আয়... এই জলদি!’ কাক্কার ফোন নিল রাজিন, ‘হ্যালো, আসসালামআলিকুম।’ ‘ওয়ালিকুম সালাম। কী করো রাজিন?’ ‘অ, তুমি।’ ‘কে আমি? মওলানা ফসিউদ্দিন?’ ‘নাহ্! মওলানা ফসিউদ্দিন তো তোমাকে দেখতে। তুমি কে আমি জানি। তুমি আর্টিস্ট।’ ‘আচ্ছা। তুমি কী করো?’ ‘ইউটিউব দেখি।’ ‘ইউটিউবে কী? গেম?’ ‘নাহ। আমাজন দেখি। আমাজন ফরেস্ট।’ ‘খুব ভালো। এখন একটা কথা বলতো রাজিন, তোমার কাক্কার লেখা কেমন হয়?’ ‘কিচ্ছু হয় না।’ ‘কিচ্ছু হয় না? হা! হা! হা!’ ‘হাসবে না তুমি। সত্যি। এরকম বাজে হাতের লেখা আমি জীবনে দেখি নাই।’ ‘জীবনে দেখো নাই? ওরে বাবারে!’ ‘নাহ! কী লেখে এসব?

ড্রেনের মতো হাতের লেখা তার।’ ‘ড্রেনের মতো হাতের লেখা!’ এ আবার কেমন! এমন তুলনা আমি জীবনেও শুনি নাই। রাজিন বলল, ‘ড্রেনের মতো মানে ড্রেনে দেখো না, কত কিছু পরে কী রকম হিজিবিজি হয়ে থাকে।’ ‘সে রকম লেখা কাক্কার?’ ‘তা নয় তো কী? গল্প লিখে। কী গল্প লিখে? আমি যা বলি তাই লিখে দেয় আর বলে গল্প। কথা হলো, বলো?’ যে যা বলে তাই লিখে দেন কাক্কা। ঠিক? কিছুদিন আগে কাক্কা একটা পান্ডুলিপি। শেষ করেছেন, ‘রাজিনের উড়ন্ত সাইকেল এবং অন্যান্য গল্প’। পাণ্ডুলিপির সব গল্প রাজিনকে নিয়ে। রাজিনের কথা, রাজিনের গল্প। আমি পড়েছি। মলাট এবং অলংকরণ করব। এই রাজিন সেই রাজিন তখন ভাবিনি। আমি তাহলে গল্পের বইয়ের এক নায়কের সঙ্গে কথা বলছি। ছোট্ট নায়ক। তার কাছ থেকে বিশদ শুনলাম। কাক্কা কোনো কাজেরই না। ‘কোনো কাজেরই না?’ ‘নাহ! সে কিছু পারে?’ ‘কী পারে না, তুমি বলো।’ ‘চিপসের প্যাকেট খুলতে পারে না।’ ‘তাই নাকি?’ ‘হ্যা-এ-এ। দুই পায়ে সবসময় দুই রঙের মোজা পরে সে। তুমি জিগ্যেস করো পরে কী না?’ ‘আচ্ছা জিগ্যেস করব। আর কী করে?’ ‘আমি যা চাই সব কিনে দেয়। আমি যা খাই সব রান্না করে দেয়।’ ‘তবে তো ভালোই।’ ‘ভালো রান্না করতে পারে না তো। ডালে লবণ কম দিয়ে দেয়। তরকারিতে মরিচ বেশি দিয়ে দেয়। তুমি কি রাতে খেয়েছ!’ ‘খাইছি রে, বাবা।’ ‘কী খেয়েছ।’ ‘কাক্কা খাবার পাঠালো দেখোনি?’ ‘না তো।’ ‘অ। শুকতো, শুঁটকি, চিতলমাছ খাইছি।’ ‘চিতল মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারো? আমি পারি না।’ ‘আমিও পারি না। তবে চিতলমাছ খেতে খুব স্বাদ তো, খেয়ে ফেলি আর কি। তুমি কী খাইছ?’ ‘চিকেন। চিকেন রোস্ট, চিকেন বল, চিকেন কারি, চিকেন ড্রামস্টিক।’ ‘ও বাবা! কে রান্না করল?’ ‘কাক্কা।’ ‘কেমন হইছে?’ ‘ভালোই। তোমার সঙ্গে কোনোদিন দেখা হবে বলো।’ ‘করোনার পরেই।’ ‘করোনার পরেই? করোনার পর আবার কী? লকডাউন উঠে গেলে বলো।’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, লকডাউন উঠে গেলে পর।’ ‘আচ্ছা রাখি। খোদা হাফেজ।’ ‘খোদা হাফেজ। কাক্কাকে দাও। কাক্কার গলা শুনলাম, ‘এই রাজিন, ঘুমাতে যাবি না? ট্যাব টুব অফ কর।’ ‘ট্যাব টুব! টুব কি বলো? টুব কোথায়? টুব আমি কী করে গোছাব? টুব কী বলো।’ রাজিন কাক্কাকে নিয়ে পড়ল। কাক্কা বললেন, ‘টুব কিছু না।’ ‘তাহলে টুব কেন বললে?’ ‘এমনি বলছি। বুঝছ তো মিয়া, কথাটথা বলাও আইজকাইল মুশকিল।’ ‘আবার কথা-টতা। টতা কী বলো? টতা কী বলো?’ কাক্কা আর কী বোঝাবেন! আমরা যখন ছোট তখন একটা ব্যাপার ছিল পত্রবন্ধুতা। এখন হয় মোবাইল ফোন বন্ধুতা, ফেসবুক বন্ধু। কে কার বন্ধু, বয়স ব্যাপার না। রাজিন হলো আমার মোবাইল ফোন বন্ধু। চব্বিশ ঘণ্টায় একবার আমাদের কথা হয় এখন। কাক্কার কাছেও শুনি বাচ্চাদের কথা। কাক্কাকে সে দুপুরে বলেছে, ‘কাক্কা, তুমি কি মুরগির বিয়ে দেখেছ?’ ‘মুরগির বিয়া! না দেখি নাই।’ ‘তুমি তো কিছুই দেখো নাই।’ ‘দেখি নাই তো। মুরগির বিয়া হয় তোরে কে বলল?’ ‘কেউ বলেনি। আমি ভাবলাম।’ ‘কী ভাবলি?’ ‘মোরগের সাথে যদি মুরগির বিয়ে না হয় তবে মুরগি ডিম পাড়ে কীভাবে?’ কাক্কা বললেন, বোঝো অবস্থা!’ আমি কি বুঝলাম? রাজিন আমাকে বলল, ‘কাক্কা তো কানা।’ ‘কী?’ ‘হ্যাঁ কাক্কা তো চোখে দেখে না। এইমাত্র আমাকে কী বললে শুনবে? এই রায়া রাজিনকে ডাক তো। আমি কি রায়া বলো। রায়া তো মেয়ে। চুল ঝুটি করে। আমি কি চুল ঝুটি করি?’ ‘আমি করি।’ ‘কী করো? চুল ঝুটি করো। তোমার চুল কি রায়ার থেকেও লম্বা? তোমার দাড়ির থেকেও লম্বা?’ পড়লাম মুশকিলে। করোনার ভয়ে সেলুনে যাচ্ছি না। চুল দাড়ি লম্বা হয়ে গেছে অনেক। গরমে অস্থির লাগে। চুল ঝুটি করে রাখি। কিন্তু আমার চুল না দাড়ি লম্বা? মেপে দেখব নাকি? ঘরে স্কেল আছে। ১২ই মে জন্মদিন রাজিনের। এই জন্মদিনে কী করবে রাজিন? জমানো ছয় হাজার টাকা আছে তার। চাল কিনবে, ডাল কিনবে, আলু কিনবে, তেল কিনবে। ত্রাণ দেবে গরীব মানুষদের। নিজেই বলল ছোট্ট নায়ক। ১১ই মে জিরো আওয়ারে আমি কল দিলাম কাক্কার নম্বরে। জন্মদিনের উইশ করব রাজিনকে। কিন্তু কাক্কার নাম্বার বিজি। অগত্যা টেক্সট পাঠিয়ে রাখলাম, শুভ জন্মদিন, প্রিয় রাজিন। ঘুমিয়ে পড়তে যাব জি ক্লাসিক চ্যানেলে দেখলাম ‘কিস্সা’ দেখাচ্ছে। ইরফান খানের ছবি। অসাধারণ। আগেও দেখেছি। আবার দেখলাম। ‘কিসসা’র পর দেখলাম সাড়ে চুয়াত্তর। আরেকটা চ্যানেলে। সেরা হাসির ছবি। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ শেষ হতে হতে সাহরির আজান হলো মসজিদে। ঘুম গেছে। টিভি অফ করে বসে থাকলাম। জানালার ধারে। সুবেহ সাদেক দেখলাম। সূর্যকে কটমট করে উঠতে দেখলাম। কখন ঘুম ধরল মনে নাই আর। ঘুম ভাঙল কলবেলের শব্দে। রিপন। কাক্কা পঞ্চব্যঞ্জন পাঠিয়ে দিয়েছেন। রিপন ঘরে একটা বাজারের ব্যাগের মতো ব্যাগ রেখে বলল, ‘এইটা রাজিন ভাই আপনারে পাঠাইছে।’ ‘অ, আচ্ছা।’ রিপনের ফোন বাজল। রিপন ধরে বলল, ‘বস কথা বলবেন।’ ‘দাও।’ ফোন নিলাম, ‘হ্যালো, কাক্কা?’ ‘কি মিয়া পাইছ?’ ‘হ্যাঁ, কাক্কা সব পাইছি। রাজিনের ত্রাণও পাইছি।’ ‘হ, মিয়া একটা ব্যাগ সে তোমারে দিবোই। ব্যাগে কিন্তু কেইকও আছে দেখো একপিস। দোকানের কেইক মনে কইরো না আবার। রায়া আর রাজিন বানাইছে। খাইবা তো? ফালাইয়া ফুলাইয়া দিবা না তো আবার?’ ‘আপনি যে কী বলেন কাক্কা? এখনই খাব।’ ‘হ। তোমারে দেখ বিফ শুটকি পাঠাইছি। বহুত দিন পরে করলাম। খাইয়া জানাইও কেমন হইছে।’ ‘জানাব, কাক্কা। রাজিন কই?’ ‘আছে, কথা বলো। এই রাজিন...।’ রাজিন ধরল ‘হ্যালো। আসসালামুআলিকুম।’ ‘ওয়ালিকুম সালাম। শুভ জন্মদিন রাজিন।’ ‘থ্যাংক ইউ। তোমার মেসেজও আমি দেখেছি। থ্যাংক ইউ।’ ‘ওয়েল কাম। আচ্ছা রাজিন, কেকটা কি তুমি আর রায়া বানাইছ? না কাক্কা?’ ‘দুর কাক্কা। কাক্কা কেক বানাতে পারে? আমি আর রায়া বানিয়েছি। কেমন হয়েছে?’ ‘এখনও খাই নাই তো, খেয়ে জানাই? আচ্ছা, জানিও।’ ‘তোমার ত্রাণও পাইছি রাজিন।’ ‘থ্যাংক ইউ।’ রিপন চলে গেল। ত্রাণের ব্যাগ খুললাম রাজিনের। চাল, ডাল, আলু, এক শিশি তেল। বড় এক পিস কেক প্লাস্টিকের বাক্সে। ভাইয়ের জন্মদিনে ভাইবোনের বানানো। দারুণ স্বাদ। এখন?

দুপুর ৩টা ৩৩ বেজে গেছে দেখি। ভাত খেয়ে নেব? কিছু ভাত আছে ফ্রিজারে। গরম করতে হবে। না কি? বিফ শুঁটকি ছাড়াও, বোয়ালমাছ এবং সবজি পাঠিয়েছেন কাক্কা। এত স্বাদের খাবার। এই বেলা না খাই? গতকালকের ভাত গরম না করি? তবে কী করব? ডাল আমি রান্না করতে পারি না। যা পারি তা করলাম। রাজিনের পাঠানো ত্রাণের চালের ভাত এবং রাজিনের পাঠানো আলুর ভর্তা। রান্না শেষ হতে হতে ইফতারির আজান হলো মসজিদে। খেতে বসলাম হাড়ি বাসন কোসন নিয়ে। একটা গ্রাস মুখে নিয়েছি, চোখ কটকট করে উঠল একটু। একা মানুষের চোখ সহজে ভিজে না। তবে ঝাপসা হয়ে এলো একটু। ঘরের আটাকানো দরজা মনে হলো খোলা। মনে হলো দরজায় রাজিন। ছোট্ট রাজিন না। গোলগাপ্পা না ট্যাঙটুঙ না, মস্ত এক রাজিন। দরজা ছাড়িয়ে তার মাথা চলে গেছে। আমাকে দুটো ভাত খেতে দেখছে সে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App