×

বিশেষ সংখ্যা

করোনাক্রান্তি ও পিঁয়াজের ঝাঁঝ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২০, ০৪:৩৫ পিএম

করোনাক্রান্তি ও পিঁয়াজের ঝাঁঝ
দেখতে দেখতে এতগুলো দিন কেটে গেল, তপু যেন বুঝতেই পারেনি কিছু; দিন-তারিখগুলো কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছে বুঝতেই পারে না। ছোট্ট ঘরটা তার পৃথিবী হয়ে ওঠে। বুকসেলফ থেকে এক এক করে বেশ কিছু পুরনো বই নেমে আসে খাটে, বালিশের পাশে। বইয়ের বিস্তৃতি বাড়ে। শয্যা ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। ইতোমধ্যে খাটে নেমে এসেছেন ফ্রয়েড-মার্কস-এঙ্গেল; ইলিয়ড-ওডেসি-মহাভারত-রবীন্দ্র রচনাবলির কয়েকটি খণ্ড-বিশ্বকোষ সব এখন নাগালের মধ্যে। গীতবিতান, শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা আর জীবনানন্দ দাশ তপুর পুনর্পাঠের নিত্য অনুষঙ্গ। রাতে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে জীবনানন্দ কাব্যসম্ভার থেকে চুপচাপ মগজে চালান হয়ে যায়- গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছলচ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার। তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে- কোনোদিন আর জাগবো না জেনে কোনোদিন জাগবো না আমি- কোনোদিন জাগবো না আর- তপুর মগজে সারাক্ষণ কত বিচিত্র বিষয় যে ঘুরপাক খায়! আর ঘোরে দীপু-দীপালী রায়। নির্ঘুম রজনী অগণন কষ্টের কর্কটক্রান্তি দেয় ছুঁয়ে, তবু অনুনয়-মাখা ক্লান্ত ভোর আছে মাথা নুয়ে। শুশ্রƒষার পথে কাঁটা পরিতৃপ্তি নাগালের বাইরে থাকে পড়ে, অমৃতের স্পর্শ ছাড়া জ্বলে না আলোকশিখা ক্লান্ত অন্তপুরে; কোন অপরাধ ঘুম কেড়ে চোখে স্বপ্ন সেঁটে দেয়, কেন জেগে থাকি কেন অন্তর্দাহ প্রতিশোধ নেয়! যে মানুষ ঈশ্বর-সৃষ্টির ইতিহাস গড়েছিল খেলাচ্ছলে, সে কী-করে আত্মসমর্পণ করে শয়তানের পদতলে? মোরগের বাক শুনে আঙিনায় ফুটেছিল আলো, আলোর আভাস পেয়ে দোয়েলেরা শিষ দিয়েছিল; সূর্যালোক কিছুটা প্রখর হলে দোয়েল বিদায় নিয়ে গেল। পাতার আড়ালে বসন্তবাউরি আশ্রয় নিলে আসে দাঁড়কাক, দুপুরে যুগল ঘুঘু প্রেমালাপে মত্ত আকস্মিক শিকারির তাক! পাখিদের টানা বেদনার সুরে প্রচারিত হয় তোমার অসুখ, তবু ব্যস্ততায় মুখরিত থাকে সঞ্জিবনী ফেইসবুক। এভাবেই চিন্তার দুয়ারে কড়া নাড়ে ফেসবুক; প্রযুক্তির সহযোগিতায় দ্রুত দীপুর মুখোমুখি হয় তপু। দীপু তখন ছাদবাগানে হাঁটে; হ্যান্ড সেটের মনিটরে চুম্বন করে দুজন দুজনকে আদর পাঠায় ভিডিও কল করে। দীপুর ছাদে দুজন হাঁটে কিছুক্ষণ। পাশের বাগান বিলাসের ঝোপ থেকে ভেসে আসে অগণন চড়ুই পাখির কিচির-মিচির। দীপু দেখায় আমের ডালে ঝুলে আছে সবুজ-বালক আম। বেলি আর গন্ধরাজের থোকা থোকা ফুল, পেয়ারা আর জামরুলের পুষ্পরেণু, বাতবির বেড়ে ওঠা; ছাদের আলো কমে আসে। অনিচ্ছায়ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দুজন। তপুর ছোট ঘরের আলো কমে আসে। পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে পিঁয়াজের ঝাঁঝ নাকে এসে লাগে তপুর। পিঁয়াজের ঝাঁঝে কোথায় হারিয়ে যায় তপু। \২\ কয়েক বছর আগের কথা, দীপু ঢাকা গিয়েছিল বোনের বাসায় বেড়াতে। কথা ছিল সাতদিন দেখা হবে না। সন্ধ্যায় হঠাৎ দীপুর কল আসে। বলে, ‘মনোযোগ দিয়ে শোনো সোনা। আগামীকাল সাড়ে এগারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত বাসায় আমি একা থাকবো। তোমার কি কালকে জরুরি কাজ আছে কোনো? না থাকলে ভোরে চলে এসো। খিলক্ষেত বাজার থেকে একটা অটোতে চড়বে, সোজা এসে কনকর্ড লেকসিটির গেইটে নামবে। সাড়ে এগারোটার পর আমায় রিং দেবে। আমি তোমায় গেট থেকে নিয়ে আসবো।’ একান্তে মিলিত হবার আকাক্সক্ষায় পরদিন তপু ভোরে রওনা হয়ে যায় বাসে। খিলক্ষেত বাজারে যখন বাস থাকে নামে তখন সাড়ে দশটা। ভোরে কিছু না খেয়েই যাত্রা করেছিল, গাড়ি থেকে নামার পর প্রচণ্ড খিদে পায়। হাতে সময় আছে অনেক। খিলক্ষেত কাঁচাবাজারের পাশ থেকেই অটো যাচ্ছে কনকর্ড লেকসিটির দিকে, পৌঁছাতে বড়জোর পনেরো মিনিট। কাছেই বেশ ক’টি হোটেল। একটাতে খেতে বসে যায় সে। অবাক হয় তপু। খাশির বিরিয়ানি মাত্র চল্লিশ টাকা প্লেট! পরোটাও আছে, কিন্তু চেহারা পছন্দ হয় না পরোটার। এমনিতে তপু সাধারণত বিরিয়ানি খেতে চায় না; সেদিন সে রিস্ক নিতে চায়নি। প্রয়োজনে পনেরো মিনিট আগে গিয়ে বসে থাকবে। লেকসিটির ভিতরে ছোট্ট একটা পার্কের মতো আছে। প্রয়োজনে ওখানে কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নেবে। বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে খাবারের অপেক্ষা করে, মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। হোটেলের ছেলেটা একটা প্লেটে বিরিয়ানি আর সাথে দুই গ্লাস ফিল্টার করা জল দিয়ে যায়। বিরিয়ানিতে হাত দিয়েই তপু বুঝে যায় চল্লিশ টাকা প্লেট বিরিয়ানির রহস্য। ভেতরে একবার ফোঁস করে উঠলেও নিজেকে সামলে নেয় সে। বুকের ভেতর তখন চরম উত্তেজনা, একটু পরই দেখা হবে দীপুর সাথে ওর বোনের ফাঁকা ফ্ল্যাটে। তপু ছেলেটাকে বলে, “তুমি কি আমায় সামান্য কাঁচালঙ্কা আর পিঁয়াজ দিতে পারো?” ছেলেটা প্রথম চমকে তাকায় তার দিকে, কাঁচালঙ্কার সাথে ওর পরিচয় নেই, কিন্তু পলকে বুদ্ধি খাটিয়ে পিঁয়াজের সাথে মিলিয়ে নেয়, এবং পিঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা দিয়ে যায়। বিরিয়ানি মুখে দিয়ে তপু খাওয়া বন্ধ করে, আবার কী মনে করে পিঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা যোগে কিছুটা খাবার গলাধঃকরণ করে উঠে যায়। শুধু অভিসারের কথা ভেবেই নিজেকে সে শান্ত রাখে। বিরিয়ানির যে ঘ্রাণ তাকে আকর্ষণ করেছিল, খাওয়ার পর মুখে পিঁয়াজের ঘ্রাণ তাকে ততটাই পীড়া দিচ্ছে। ভালোভাবে কুলকুচা করে অটোতে চড়ে বসে। একবার ভাবে, জর্দা দিয়ে একটা পান খেয়ে নিই, কিন্তু জর্দার ঘ্রাণ দীপু সইতেই পারে না সে জানে। অভিসারটাকে মাটি করতে চায় না তপু। সামলে নেয় নিজেকে। নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগেই পৌঁছে যায় কনকর্ডের গেইটে। ঠিক সাড়ে এগারোটায় তপু কল করে দীপুকে। কোনো ভূমিকা না করেই দীপু ওপাশ থেকে বলে, “পৌঁছে গেছো? ——- তাহলে গেইট দিয়ে ঢুকে সোজা হাঁটতে থাকো, আমাকে পথেই পাবে।” সত্যি তিন মিনিট হেঁটেই তপু পেয়ে যায় দীপুকে। ওকে নিয়ে দীপু সোজা চলে যায় ওর বোনের বাসায়। ফাঁকা লিফটে উঠে তপু একবার জড়িয়ে ধরতে চায় দীপুকে, দীপু গা ঝারা দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেয়। কড়িডোর দিয়ে যেতে যেতে তপু দুবার দীপুর গায়ে গা ঘেঁষতে চেয়েছিল, কিন্তু দীপু নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়েছে। তপুর উদ্বেগ বেড়ে যায়। দ্বিধা নিয়ে দুজন পৌঁছে যায় বাসায়। বাসায় ঢুকে দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে বদলে যায় দীপু। নিজেই জাপটে ধরে তপুকে। দুবছর সম্পর্কের জীবনে ওরা দুজন আগেও একাধিকবার একান্তে মিলিত হয়েছে। মিলনাকাক্সক্ষাতেই আজ দুজনের স্বল্পকালীন অভিসার। তপু জানে দীপুর ঠোঁট ওর স্পর্শকাতর অঙ্গ, নিবিড় চুম্বন করলে দীপু আকুল হবে মিলনে। কিছুক্ষণ দুজন জড়িয়ে ধরে থাকে দুজনকে। সময়ের সংক্ষিপ্ততা বিবেচনা করে তপু দীপুর ঠোঁটে নিবিড় চুম্বন করে। মুহূর্তে যেন ঘরে ভ‚মিকম্প হয়ে যায়। এক ঝটকায় তপুর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দূরে সরে যায় দীপু! “কী খেয়ে এসেছো তুমি!” তপু কিছুটা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলে, “বিরিয়ানি খেয়েছি খিলক্ষেত বাজারে এসে। খিদে পেয়েছিল খুব।” তপুর মুখের কথা কেড়ে নেয় দীপু, “বিরয়ানির সাথে তুমি পিঁয়াজ খেয়েছো!” তপু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। চরম উত্তেজিত দীপু, “আমার কাছে তুমি আসবে না! পিঁয়াজ খেয়েছো কেন?” কী বলবে তপু বুঝতে পারে না। দীপু কাঁদতে থাকে। পিঁয়াজ খাবার অপরাধে সেদিন ওদের অভিসার অপূর্ণ থেকে গেল। তপু কয়েকবার ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে; কিন্তু বারবারই ফিরিয়ে দেয় দীপু; সারাক্ষণ কেঁদে যায়। \৩\ করোনা সংকট আর পিঁয়াজের গন্ধ আজ তার কাছে সমার্থক মনে হচ্ছে। দুমাস আগে মিলিত হয়েছিল দুজন, এরপর দুজনই হোমকোয়ারেন্টাইনে বন্দি। প্রতিদিন অচলায়তন, অনড় স্থবিরতা জগদ্দল পাথর হয়ে বুকে চেপে আছে। সারাদিন সারারাত মিডিয়ায় কত-শত বিচিত্র তথ্য, কত বিচিত্র বার্তা আসছে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে, কখনো সুরে, কখনো আবৃত্তিতে, কখনোবা ভিডিও বার্তা। মিডিয়াকে তপুর এখন ‘গোয়েবলস মিডিয়া’র বেশি কিছু মনে হয় না। জীবন যেন এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে আছে; অস্থির চিত্তে সে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন : ১৩৩৮ থেকে আবৃত্তি করে- কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সঙ্গীতহারা, অমাবস্যার কারা লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপ্নের তলে। তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে- যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো? দিন যত যাচ্ছে ততই অস্থিরতা বাড়ছে; পৃথিবীর এমন অভিনব অসুখ কেউ কি দেখেছে কোনো কালে? শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে এখন। দীপুকে দেখা হয় না কতদিন, কেবল বার্তাকক্ষের জানালায় উঁকিঝুঁকি। কয়েকদিন ধরে বারবার মনে হচ্ছে ঘরের বইগুলো যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওর দিকে। বইগুলোই কি শেষপর্যন্ত ওর চরম প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে! মনে ভয় বাড়ছে, আমি কি অতঃপর বইয়ের নিচে চাপা পড়ে মরবো? দুদিন যাবৎ নতুন একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে মাথায়, ঘরে যেন ইঁদুর সংসার পেতেছে? ইঁদুর কি বার্তা পেয়ে গেছে আমি বইয়ের নিচে চাপা পড়ে মরে পড়ে থাকবো? আর ইঁদুর বাহিনী ঘরের সহ¯্র বই মনের আনন্দে কাটবে কুঁচিকুঁচি করে? তাই তো, মানুষ তো বই পড়া ত্যাগই করেছে, তবে কেন আর এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ? তপুর শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে, বুকে কাশি গড়গড় শব্দ করে। রবীন্দ্রনাথ আজ ভোরেই কানে কানে মন্ত্রোচ্চারণের মতো শুনিয়ে গেলেন- রূপ-নারানের ক‚লে/ জেগে উঠিলাম,/ জানিলাম এ জগৎ/ স্বপ্ন নয়।/ রক্তের অক্ষরে দেখিলাম/ আপনার রূপ,/ চিনিলাম আপনারে/ আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়; সত্য যে কঠিন,/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,/ সে কখনো করে না বঞ্চনা।/ আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,/ সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,/ মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ ক’রে দিতে। জানালায় পিঁয়াজের ঝাঁঝটা বেড়ে গেছে; উৎসবের আয়োজন চলছে না-কি? ঘরে টেকা যাচ্ছে না। শ্বাসকষ্ট বাড়ে, শ্বাসকষ্ট যতই বাড়ে করোনার শঙ্কা ততই ঘনিভূত হয়; দীপুর সাথে মিলনের স্বপ্ন ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। শয্যাত্যাগের আগ্রহ যেন ফুরিয়ে যেতে চাইছে; তবু একবার ভাবে দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ করে কি পিঁয়াজের ঝাঁঝটা থামানো যায়?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App