×

মুক্তচিন্তা

এখনো গেল না আঁধার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ মে ২০২০, ১০:২৪ পিএম

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি সমাজে যে ভীতি-আতঙ্ক-সংক্রমণ ও মৃত্যুর অন্ধকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, কিছুটা হলেও বাংলাদেশ তার অংশীদার। এর সূচনা আমাদের দেশে ধীরেসুস্থে হলেও তা প্রবল সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় মানুষের কর্মহীনতার কারণে। সারা দেশ, নানা শ্রেণির মানুষ গৃহবন্দি অবস্থায়, সরকার অবস্থা মোকাবিলায় ব্যতিব্যস্ত একদিকে সংক্রমণ বিস্তার নিরোধে, আক্রান্তের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে এবং মৃত্যু ঠেকাতে, সেই সঙ্গে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনায় ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থাপনায়। সেখানে আবার জনপ্রতিনিধিদের কল্যাণে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি সমস্যাকে জটিলতর করে সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। এটি জাতীয় সমস্যা, জাতীয় সংকট এবং তা সমাজের সর্বশ্রেণিকে নানাভাবে ঘিরে ধরেছে। বাদ নেই উচ্চশ্রেণি ও বিত্তবান শ্রেণি, রাজনৈতিক মহল, পেশাজীবী ও শিক্ষায়তন। এও এক ধরনের সামাজিক অন্ধকার-অবস্থা যেখানে সমাজের প্রতিটি মানুষের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা অপরিহার্য। সাধারণত মারী ও মড়কে, দুর্যোগে-দুর্ভোগে এমনটাই প্রত্যাশিত এবং অংশত হলেও নানা ক্রান্তিকালে আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের সমাজে আরেকটি বড় অন্ধকার দিক, এত শিক্ষা বিস্তার, আধুনিকতার প্রসার সত্ত্বেও আমরা নিয়মিত দেখে আসছি কী নগরে-বন্দরে, কী গ্রামাঞ্চলে নিয়মিত নারী নির্যাতন, শিশুকন্যা নির্যাতন, এমনকি হত্যা। দীর্ঘদিন থেকে সংঘটিত এ সামাজিক অন্ধকারের নিরসন ঘটাতে কী সমাজশক্তি, কী প্রশাসনিক শক্তি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সফল হয়নি, সেখানে উদাসীনতাই প্রকট। গত কয়েক দশকের সংবাদপত্রভিত্তিক প্রতিবেদনে এই বর্বরতা লক্ষ করে আসছি, যার বেশকিছু নমুনা সংগ্রহে আছে। দুই. দেশব্যাপী করোনা সংকটের বেড়াজালের পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে একটা নিগূঢ় প্রত্যাশা ছিল অন্তত এই দুর্যোগে-দুর্ভোগে বাংলাদেশি সমাজের প্রতিটি মানুষ পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, মানবিক চেতনার প্রকাশ ঘটাবে। কিন্তু এ পর্যন্ত সামাজিক পরিসরে সংঘটিত ব্যক্তিগত ও পেশাগত কার্যক্রমে, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও আত্মকেন্দ্রিকতার প্রকাশ, কোথাও প্রকট দুর্নীতি ও স্বার্থপরতা। না হলে দরিদ্রের ত্রাণের সরকারিদানে কেউ হাত দেয়, তাও আবার জনপ্রতিনিধি থেকে পাতি রাজনৈতিক নেতা, ডিলার ইত্যাদি এবং তা জেল-জরিমানা উপেক্ষা করে, অদ্ভুত এক বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে। সেসব কথা থাক। কারণ এগুলো নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক লেখালেখি হয়েছে। এই তো মাত্র সেদিন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে গুরুতর রোগাক্রান্ত অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালের দরজা থেকে দরজায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে বরণ করতে হলো, এরকম বহু অমানবিক ঘটনা বাংলাদেশের করোনা যুগের ইতিহাসে কালো অক্ষরে লেখা থাকবে। অবশ্য এর কিছু বিপরীত চিত্রও আছে, ভুখা মানুষকে অনাহার থেকে বাঁচাতে বেশকিছু সংখ্যক সদাশয় মানুষ ত্রাণসামগ্রী, খাদ্যসামগ্রী নিয়ে মাঠে নেমেছেন, তাতে হয়তো অনেক অনাহারক্লিষ্ট মানুষের প্রাণ বাঁচবে। ব্যতিক্রম হিসেবে বেশকিছু সংখ্যক চিকিৎসক-সেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সেবায় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত কাজে নিয়োজিত করেছেন এবং তাদের কেউ কেউ করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মারাও গেছেন। দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনে তেমন চিত্রই ফুটে উঠেছে। তিন. কিন্তু করোনা পরিপ্রেক্ষিতে এসব আনুষঙ্গিক বিষয় আমার আলোচনার নয়, যদিও এগুলোর প্রাসঙ্গিকতা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু আমার বক্তব্য নানা সময় পরিসরে সমাজের অন্ধকার মানসিকতার দিকটির কথা যা নিয়মিত নারী ও শিশুকন্যাদের ওপর আসুরিক বর্বরতার প্রকাশ ঘটায়, নিজেদের অমানুষ নামের পদবাচ্য করে তোলে। কিন্তু এই করোনা দুর্যোগের সময় নামি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় এ জাতীয় তেমন কোনো খবর প্রকাশিত হতে না দেখে আশান্বিত হয়েছিলাম। আসলে তারা করোনা আক্রমণের দৈশিক ও বৈশি^ক ভয়াবহতা চিত্রণে দিনের পর দিন এতই ব্যস্ত ছিলেন যে তাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা হয়তো এদিকে সময় দিতে পারেননি। একাধিক পত্রিকা পাঠে একটু মনোযোগী হতেই আমার আশা হতাশায় পরিণত হলো না, এ করোনা যুগেও ওই মানসিক অন্ধকারের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। একটি মাত্র দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক তাদের অনুসন্ধানী কর্মে প্রতিদিন নিয়মিত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নারী ও শিশুকন্যা নির্যাতনের খবর প্রকাশ করে চলেছেন। আমি সত্যই বিস্মিত, বিক্ষুব্ধ, বিচলিত হয়ে ভাবছি এমন অসম্ভবও সম্ভব হলো, করোনার দেশজোড়া ভয়াবহতাও সমাজের ওই দুর্বৃত্তদের তাদের যৌন অনাচারের অপকর্ম থেকে বিরত করতে পারেনি। বিস্ময়কর ঘটনা যে ধর্ষণযজ্ঞে বৃদ্ধও শামিল, বয়স হিসেবে যার যৌন লালসা হ্রাস পাওয়ার বা অবসান ঘটার কথা। এসব ঘটনা প্রসঙ্গে কথাটা আমি বহুবার বলেছি যে, আমাদের সমাজের একাংশে শুধু অবক্ষয় নয়, যে পচন শুরু হয়েছে এর প্রতিরোধে আমাদের সুস্থ সামাজিক শক্তি, সাংস্কৃতিক শক্তি, এমনকি প্রশাসনিক শক্তিরও কোনো বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ ও উদ্যম নেই। এ অন্ধকার মানসিকতাকে উল্লিখিত ত্রিশক্তি অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য বলেই বোধহয় ধরে নিয়েছে। তাই তারা এ বিষয়ে নির্বাক-নির্বিকার। চার. তাই করোনার ভয়াবহতার মধ্যেই অব্যাহত নারীধর্ষণ-শিশুকন্যা ধর্ষণ, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণোত্তর হত্যা। আমি শুধু উল্লিখিত দৈনিকটিতে প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত প্রতিবেদনের কয়েকটি শিরোনাম ও অবস্থা বিচারে দুচারটে তথ্য তুলে ধরব; তাতেই পাঠক অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। প্রথম উদ্ধৃত সংবাদটিই পূর্বোক্ত মানসিক অন্ধকার বোঝানোর পক্ষে চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর বলতে হয় : যশোরের ‘বাঘারপাড়ায় শিশু ধর্ষণের অভিযোগে নানা গ্রেপ্তার’ (১১.০৪.২০২০)। ধর্ষক চাচাতো নানা আবু জাফর মোল্লার বয়স ৬০, ধর্ষিতা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। একই প্রতিবেদনে প্রকাশ ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ৯ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক’ এবং ‘শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক বখাটে যুবক গ্রেপ্তার’। সঙ্গে ছোট্ট খবর, ঝালকাঠিতে প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণের শাস্তি স্থানীয় সালিশে ধর্ষককে জুতাপেটা এবং পরে ধর্ষকের পাল্টা হামলা। একই পত্রিকায় আরো খবর (২৮.০৪.২০২০) : ‘টঙ্গীতে একই দিনে চার শিশুকে ধর্ষণ, কেয়ারটেকার গ্রেপ্তার’। এছাড়াও নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণের দায়ে ধর্ষক গ্রেপ্তার। অন্যদিকে বরগুনার বামনায় এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরে শিশু ধর্ষণের চেষ্টায় অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার। মনে হচ্ছে শিশুধর্ষণের মিছিল চলছে অদ্ভুত এক সমাজে। করোনা এদের থামাতে পারেনি। তাই ‘ঈশ^রগঞ্জে তরুণী গণধর্ষণের শিকার’ (০৫.০৫.২০২০)। ধর্ষক ‘দুই বৃদ্ধ নৈশপ্রহরী গ্রেপ্তার’। ‘ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার’। এছাড়া চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে ধর্ষণের অভিযোগে বাসের হেলপার আটক। একই দৈনিকে পরদিনের খবর : ‘মাদারীপুরে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী শিশুটিকে ধর্ষণের অভিযোগে ধর্ষক কারাগারে’। অন্যদিকে মুরাদনগরে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় ইউপি সদস্য কারাগারে। এবার একই কাগজে একটু ভিন্নধর্মী খবর (০৭.০৫.২০২০) : ‘তানোরে ঝড়-বৃষ্টির সুযোগে ঘরে ঢুকে গৃহবধূকে ধর্ষণ’ এবং মিরসরাইয়ে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১’। ওই কাগজেই পরদিনের খবর : ‘সিরাজদীখানে অন্ধ তরুণীকে ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ, নারী গ্রেপ্তার’। ‘পাকুন্দিয়ায় শিশুধর্ষণ’। ধর্ষণের এই মিছিলে ভিন্ন একটি মাত্র দৈনিকে খবর : ‘বারহাট্টায় শিশুটিকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল’ (০৭.০৫.২০২০)। এমন বহু ঘটনা কম করোনা পর্বে এই সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার একটাই আবেদন এই দুর্বৃত্তদের বিশেষ ব্যবস্থায় চরম দণ্ড দেয়া হোক। না হলে সহজে কথিত অন্ধকার দূর হবে না। আহমদ রফিক : ভাষসিংগ্রামী ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App