×

মুক্তচিন্তা

করোনা ভাইরাস : সরকার ও গণমনস্তত্ত্ব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২০, ১১:০৮ পিএম

গণমানুষের মন বুঝার চাইতে কঠিন বোধকরি আর কিছু নেই। সামনাসামনি থাকা একজন মানুষের মনই বুঝা যায় না। আর যখন জনে জনে মিলে গণ হয়, তখন এক যোগ এক সমান দুয়ের মতো যোগফল হয় না, হয় ভিন্ন একটা কিছু। এই ভিন্ন কিছু যাকে বলে সামাজিক মনস্তত্ত্ব, মিছিল-সমাবেশ হলে তাও বেশ কিছুটা আঁচ করা যায়। কিন্তু তা যখন থাকে বিক্ষিপ্ত ঘরে ঘরে, তখন তা বুঝা কষ্টকর বৈকি! বলাই বাহুল্য, বিশেষভাবে করোনাকালে আমাদের দেশের গণমানুষের মনস্বত্ত¡ বুঝা সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রোগের ভয়, মৃত্যুভয় থাকা সতত্ত্বেও মানুষ নিয়ম ভাঙছে। এটা ঠিক আমাদের দেশে এখনো করোনা মহামারি আকারে দেখা দেয়নি। কিন্তু রোগীর সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা তো বেড়েই চলেছে। এই অবস্থায় গণমানুষের মন বা মনস্তত্ত্ব এমন কেন, তা গভীরভাবে ভাবনার বিষয়। করোনা প্রতিরোধে আমরা যথেষ্ট সময় পেয়েছি। ইউরোপ-আমেরিকা সেই সময় পায়নি। ডিসেম্বর ২০১৯-এর শেষদিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে শুরুতে চীন এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি, গোপন করেছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীন সরকার এসব বিষয়ে তাদের ‘দুর্বলতা’ ও ‘ঘাটতি’ স্বীকার করে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ভাইরাসের ভয়াবহতা প্রথমদিকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই সংস্থার সভায় এই ভাইরাস নিয়ে সতর্ক করলেও বলে যে, মহামারি আখ্যায়িত বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। অর্থাৎ ইউরোপ-আমেরিকার কাছে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগে প্রথমদিকে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আমাদের কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা সামনে ছিল। ওষুধ না থাকার কারণে করোনা প্রতিরোধের একমাত্র দাওয়াই হলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। আর তা করার জন্য যাতায়াত তথা সড়কপথ-রেলপথ-আকাশপথ, অফিস-আদালত, মিল-কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ করা অপরিহার্য বিধায় মহামারির বিপদ ঠেকাতে আমাদের দেশেও সব বন্ধ করে দেয়া হলো। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এই প্রচারও কম হয়েছে তা বলা যাবে না। সাংবাদিকরা জীবনের ভয় ত্যাগ করে সংবাদ পরিবেশন করছেন। সবার কানে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি পৌঁছেনি এমনটা বলা যাবে না। কিন্তু প্রথম থেকেই দেখা গেল, মানুষ তা মানছে না। সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ দলে দলে বাড়িতে যেতে বের হয়ে পড়ল। মানুষ বাজার-হাটে, কিংবা মসজিদ-মন্দিরে যাওয়া তেমন কমাল না। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে আড্ডা চলল। এমনকি কোনো বাড়িতে করোনা রোগী ধরা পড়ায় বাড়ি লকডাউন করলে মানুষ তা দেখার জন্য জটলা করতে থাকল। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যখন আইন অমান্যকারীদের লাঠির বাড়ি দিয়ে কোথায়ওবা রক্ত ঝরালো তখন বর্বরতা (রাস্তাঘাটে পিটুনি বর্বরতাই) বিবেচনায় তা বন্ধ করার জন্য হৈচৈ শুরু হলো। তারপর কিন্তু আবার আর্মি নামানোর কথা উঠল। আর সন্দেহভাজন যাদের কোয়ারেন্টাইন করা হলো তাদের অনেকেই এবং এমনকি পরিবারের সদস্যরাও তা মানতে অস্বীকার করল। ইতালি ফেরতদের থেকে আমাদের রোগটা এসেছে এবং বিস্তৃতি ঘটেছে। যখন প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হলো, তখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারো কারো ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি, গালাগালির ঘটনাও ঘটল। রোগী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে বহু। এমনটা যখন হয়েছে, তখনই অনুমান করা গেছে রোগক্রমেই আরো ছড়িয়ে পড়বে। প্রশ্নটা হলো নিজে আর সেই সঙ্গে পরিবার-এলাকার আপনজনের মধ্যে রোধ ছড়িয়ে দেয়া আর সেই সঙ্গে মৃত্যুভয় থাকা সত্তে¡ও জনগণের একটা অংশ তা করল কেন? নিজের মৃত্যুভয় কি তাদের নেই? পরিবার বা সমাজের প্রতি কি তাদের কোনো দায়িত্বরোধ নেই? এই প্রশ্নটা যখন সামনে আসবে তখন সরকারি প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা, গাফিলতি কিংবা ত্রুটির বিষয়টা অবশ্যই উঠবে এবং নিঃসন্দেহে এটা বিদ্যমান। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষ বা গণমানুষ বিপন্নতা জেনেও তা করছে কেন? গণমনস্তত্ত¡টা আসলে আমাদের কী? তবে অবস্থা পর্যবেক্ষণে এটা বলতেই হবে যে, একসময় নিয়ম মানা আর নিয়ম না মানার মধ্যে আমাদের দেশের মতো করে একটা মোটামুটি সহনশীল ভারসাম্যমূলক অবস্থা সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রথম আকস্মিকভাবে সেই ভারসাম্য ভেঙে দেন গার্মেন্টস মালিকরা। সঙ্গে সরকারের মন্ত্রণালয়ের সংযোগ রয়েছে। গার্মেন্টস খুলে দেয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে শ্রমিকরা স্রোতের মতো ঢাকার দিকে আসতে থাকে। বাস বন্ধ থাকা সতত্ত্বেও হেঁটে, ট্রাকে, ভ্যানে চড়ে নারী-পুরুষের মিছিল শুরু হয়। প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে হঠাৎই আবার গার্মেন্টস বন্ধ করে দেয়া হয়। শুরু হয় মিছিল করে ফেরার পালা। এদিকে সব বন্ধ থাকায় মানুষ যখন চরম আর্থিক কষ্টে, তখনো গার্মেন্টস মালিকদের কেউ কেউ শ্রমিকদের বেতন দিল না কিংবা কারখানা লে-অফ পর্যন্ত করে দিল। শুরু হলো নিয়ম ভঙ্গ করে ঘেরাও-মিছিল। ভারসাম্য ভেঙে নিয়ম ভাঙার নাটক তখন বিয়োগান্তক রূপ পরিগ্রহ করল। কথা উঠল গার্মেন্টস মালিকরা সরকারকে চাপে ফেলে আর্থিক সহায়তা বাগিয়ে নিতে খোলা-বন্ধের এই খেলা খেলেছেন। সঙ্গতভাবেই দাবি উঠল যারা লাভ-লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে, তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। ওই ঘটনার পর আবারো কিছু একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা সৃষ্টি হলো। কিন্তু সব বন্ধ অবস্থায় থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে কর্মহীন মানুষেরা আয়-রোজগারের প্রশ্নটা সামনে আসল। অর্থকষ্ট-খাদ্যকষ্টের বিষয়টা প্রধান হয়ে দাঁড়াল। সরকারি-বেসরকারি রিলিফে আর কতটা চলে। এতে সরকারের মধ্যেও দোদুল্যমানতা দেখা দিল। সরকারি অফিস খুলে আবার বন্ধ করা হলো। ইতোমধ্যে এসে গেল ঈদ। বাড়লো দোকানদার-ব্যবসায়ীদের চাপ। সরকার নিয়ম মানার শর্তে দোকান ও হোটেল খুলে দিল। দোকানে খুব একটা ভিড় হবে না, এমনটাই আশা বা ধারণা করা হয়েছিল। কেননা রোগের ভয়, মৃত্যুভয় নিয়ে কে যাবে নতুন জিনিস কিনতে বা খাবারের দোকানে খেতে! কিন্তু দেখা গেল দোকানে দোকানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। শুরু হলো বাইরে থেকে ঢাকায় মানুষ আসার স্রোত। শিমুলিয়া-কাঁঠালিয়া ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট সূত্রে জানা যায়, ঈদের আগে বিশেষত দোকানপাট খুলে দেয়ার পর ঢাকামুখী ছিল মানুষের গতি। কেনাকাটা করতেও নাকি মানুষ এসেছে ঢাকায়। রোগ-মৃত্যু-শোকের সব ভয় উবে যেতে থাকল। এদিকে ঈদ সামনে রেখে ১৯ মে থেকে সব বন্ধ করে দিতেই উল্টো গণস্রোত। ১৫ মে শুক্রবার ঢাকা থেকে মানুষের গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু হলো। ১৭ মে রবিবার ভিডিও কনফারেন্সে পুলিশ মহাপরিদর্শক সব ইউনিটকে নির্দেশ দিলেন, ‘আসন্ন ঈদে অনেকেই বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। সরকারের নির্দেশনা ব্যতীত কেউ ঢাকায় প্রবেশ বা ত্যাগ করতে পারবেন না।’ আন্তঃজেলা ভ্রমণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো বলেও তিনি ঘোষণা করলেন। প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, ইতোমধ্যে কথা হলো কলকাতায় নিকটজনদের সঙ্গে। এক স্বজন বললেন, তোমাদের ওখানে বেশ কড়াকড়ি হচ্ছে। তোমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, ঈদের সময় রাস্তায় বের হওয়া যাবে না। ঘরে বসে ঈদ পালন করতে হবে। এবারে আর বাড়ি যাওয়ার সেই দৃশ্য আমরা দেখতে পাব না। তিনি বললেন, এই খবর তিনি সেখানকার সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছেন। কোথায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া নির্দেশ! আর কোথায় আইজিপির পুলিশ বাহিনী! আর কোথায় গণমনস্তত্ত¡! ১৮ মে সোমবার ঢাকা থেকে বাড়ি যাত্রী জনস্রোত করোনাকালে সব যাত্রার রেকর্ডকে ভঙ্গ করে দিল। শিমুলিয়া কিংবা পাটুরিয়া ফেরিঘাটে মানুষের ভিড় দেখলে একটুও মনে হবে না, দেশে করোনা মহামারির আশঙ্কা রয়েছে। বাস নেই তো কি? সাহরি খেয়েই মানুষ ট্রাক, মাইক্রোবাস, লেগুনা, মোটরসাইকেল দিয়ে ঘাটে পৌঁছেছে। যাত্রা চলাচল বন্ধ করার জন্য ঢাকা-আরিচা রোডে পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়। কিন্তু বাধা পেয়েও বিকল্প পথে মানুষ ঘাটে চলে যায়। মানুষ যদি চায়, তবে আটকানোর সাধ্য আছে কার! হায় রে মানুষের মন আর ইচ্ছা বাস্তবায়নের চেষ্টা! এদিকে অফিস-আদালত সব বন্ধ থাকার কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মানুষের জীবনে অর্থকষ্ট সৃষ্টি হচ্ছে, সরকার ত্রাণে খরচ করছে, প্যাকেজ ঘোষণার সুবিধা দিচ্ছে, হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রায় বন্ধ থাকায় জনগণ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি। সরকারকে রিলিফ দিতে হচ্ছে। আর অন্যদিকে নিয়ম কানুন সব ভেস্তে যাচ্ছে। কাজের কাজও হচ্ছে না, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেল, ক্ষোভে-দুঃখে-অভিমানে অনেকেই লকডাউন আর সামাজিক দূরত্বকে গালাগালি করছেন, সব খুলে দেয়ার প্রস্তাব করছেন। এদিকে পরীক্ষা বাড়ায় গত সপ্তাহে করোনা রোগী লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মৃত্যুও বাড়ছে। এসব খবরও সবাই শুনছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-পিজির সামনের রাস্তায় রোগীরা করোনা পরীক্ষার জন্য সকাল থেকে বিছানা পেতে শুয়ে আছেন। এই যখন অবস্থা তখন উৎসব পালনের জন্য দোকানে ভিড় করা কিংবা বাড়িমুখী হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। ইতোমধ্যে জানা গেছে, বিশ্বের সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার সরকার করোনা ভাইরাস যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য বড় বড় শহর থেকে জনগণকে গ্রামে না যেতে নির্দেশ দিয়েছে, প্রায় সোয়া কোটি মানুষ সেখানে ঈদে ঘরমুখী হয়। সৌদি আরব ২৩-২৭ মে ৫ দিন দেশব্যাপী কারফিউ জারি করেছে। তুরস্ক ঈদ উৎসবের বন্ধের দিনগুলোতে কারফিউ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। ১৫টি বড় বড় শহরে যাতায়াত ১৫ দিনের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে। ওইসব দেশে নির্দেশ কার্যকর হবে নাকি আমাদের মতো অবস্থা হবে, তা গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয়। যদি ওইসব দেশ বন্ধ করতে পারে এবং উৎসবের মধ্য দিয়ে যদি করোনা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে, মৃত্যু বেশি হতে থাকে, তবে নিঃসন্দেহে আদেশ-নির্দেশ কার্যকর না করাতে পারার জন্য জনগণ সরকারি কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্ত করবে। সরকারকে অভিযুক্ত করা যাবে, এটা সহজ এবং কারণ থাকলে প্রয়োজনও। কিন্তু জনগণকে কীভাবে কি বলে অভিযুক্ত করা যাবে? গণমনস্তত্ত¡ বিষয়ে বোঝাপড়াটাইবা কি হবে? ভাগ্যের ওপরই কি সব ছেড়ে দিতে হবে? এমনটা যাতে না করতে হয় সেটাই উৎসবের দিনগুলোর একান্ত কামনা। শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App