×

মুক্তচিন্তা

করোনাকালের ঈদে ‘নস্টালজিক মন’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২০, ০৮:২৪ পিএম

করোনাকালের ঈদে ‘নস্টালজিক মন’

করোনাকালের ঈদ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি তখনও পার হইনি। কিশোর মনে রঙিন স্বপ্ন। সব কিছুতেই আনন্দ আর আনন্দ। এখনকার মতো তখনও গ্রীস্মকালে একবার রোজা পড়েছিল। আব্বা রোজা রেখে সাইকেল চালিয়ে অফিসে যেতেন। বাসায় ফেরার পর তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। গরমে যেখানে ঘরেই টেকা দায়, সেখানে আব্বা কী করে সেই নীলক্ষেতে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া-আসা করেন! আব্বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসে চাকরি করতেন। অনেকবার তার সাইকেলে চরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি। দীর্ঘ সময় বসে থাকতে প্রায়ই পায়ে ঝিঝি ধরে যেত। সাইকেল থেকে নামার পর মনে হতো পা অনেক বড় হয়ে গেছে। রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হওয়ার পর ধীরে ধীরে পা ঠিক হয়ে আসতো।
স্মৃতির জানালায় নানান রঙের দিনগুলি
রমজান মাস এলে চারদিকের চিরচেনা পরিবেশ অনেকটাই বদলে যেত। গরমে রোজা ভেঙে ইফতারে ঠান্ডা পানি, শরবত পান করতে উদগ্রীব থাকতো সবাই। প্রতিদিন বিকেলে বাসার অদূরে বরফ কিনতে যেতাম বন্ধুরা মিলে। রিকশায় করে তুষে ঢাকা বরফের বিশাল টুকরো নিয়ে আসা হতো। ইফতারের আগ পর্যন্ত টুকরো টুকরো করে ভেঙে বিভিন্ন দামে বরফ বিক্রি চলতো। বাসা থেকে কেউ বাটি, কেউ মগ, কেউ ছোট পাতিল নিয়ে বরফ আনতে যেতাম। ঝামেলা এড়াতে কেউ কেউ আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু ইফতারের এতো আগে বরফ নিয়ে গেলে তা কিছুক্ষণ পর আর ঠান্ডা থাকতো না। তাই ইফতারের আগে বরফ কিনতে ভিড় লেগে যেত। ইফতারের কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে যেত তারাবি নামাজের আয়োজন। নামাজের অজুহাতে বাসা থেকে বের হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে একেবারে পেছনে বসে গল্প-গুজব চলতো। এটা এক ধরণের উপভোগ্য বিষয় ছিল ওই সময়। বড়দের সঙ্গে ছোটরা মসজিদে গেলেও তাদের কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ হতো না। এখনও হয় না। এখনও শিশুদের ঠাঁই হয় একেবারে পেছনে। রোজার দিনগুলো পেরিয়ে এক সময় চলে আসতো ঈদ। নতুন জামা কেনার আনন্দ যেন ধরে না! যে কোনোভাবেই হোক, চাঁদরাতের মধ্যে নতুন জামা-কাপড় হাতে চাই। সেটা কাপড় কিনে দর্জি দিয়ে বানানো হোক কিংবা মার্কেট থেকে কেনা রেডিমেডই হোক। একটি মজার বিষয় প্রায় প্রতি ঘরের শিশুদের মধ্যে দেখা যেত। ঈদের দিন ছাড়া কোনো শিশু নতুন জামা কাউকে দেখাতো না, এমনকি বন্ধুদেরও না। শুধুমাত্র পরিবারের লোকজন সেটা দেখতে পারতো। মনে আছে, একবার জানালার ফাঁক দিয়ে এক বন্ধু ঈদের নতুন জামা দেখে ফেলেছিল বলে ঈদে সেটি আমি আর পরিনি। দুই সেট জামার অন্যটি পরেছিলাম। এমন মজার ঘটনাগুলো মনে হলে সত্যিই শিহরিত হই। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে নতুন চাঁদ দেখতে যেতাম। কম বয়সী ছেলেমেয়েদের তর সইতো না। মনে হতো ২৯ রোজা হলেই ভালো হয়! আজই চাঁদ উঠে যাক। ইফতার শেষ করে বাসার সামনের পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতাম। বন্ধুরা মিলে সুতোর মতো চাঁদের চিকন মাথা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। বড়রা কেউ কেউ রেডিও হাতে উপস্থিত হতেন। এক সময় জানা যেত, দেশের আকাশে কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি। বিষণ্ণ মনে সবাই যার যার বাসায় ফিরে যেতাম। পরদিন যখন চাঁদ দেখা যেত তখন বন্ধুরা বলাবলি করতাম, ৩০ রোজা হয়েই ভালো হয়েছে। একদিন বেশি সময় পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলতো, চাঁদ কালকেই উঠেছিল, আমরা দেখিনি। দেখিস না, চাঁদটা কতো বড়!
এখন করোনাকাল। কয়েকদিন পর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ-উল-ফিতর। সরকারি ঘোষণায় স্বল্প পরিসরে মার্কেট, শপিংমলগুলো খুললেও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় দেশের অনেক স্থানেই তা আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো বড় ধরনের কোনো ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে না। সীমিত পরিসরে জামাত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই প্রথম বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে ঈদে কোলাকুলি হবে না। কারো বাসায় বেড়াতে যাওয়া হবে না। করোনায় যারা বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে কিংবা নিকটাত্মীয়দের হারিয়েছেন তারা হয়তো মন খারাপ করেই দিন কাটিয়ে দেবেন।
করোনায় এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মী, ডাক্তার, নার্স, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, ব্যাংকার, ছাত্রসহ প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ভাগ্যের জোরে কেউ কেউ বেঁচে আছেন। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ঊর্ধ্বগামী। বৈশ্বিক এই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে তিনি আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণাসহ নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সারাদেশে কর্মহীন দুস্থদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি রেশনিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে দেশের সর্বত্র। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঈদ উপহার হিসেবে আর্থিক সহযোগিতা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে দুস্থদের কাছে। করোনা মহামারি থেকে কবে মুক্তি মিলবে কেউই কিছু বলতে পারছে না। ওষুধ, টিকা, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে নিরন্তর। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের মতো বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে প্লাজমা থেরাপি। করোনাকালে ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দ, রাতভর জেগে থাকা, কোনো কিছুই হয়তো এবার তেমনভাবে উদযাপন করা হবে না। তবুও চাঁদ উঠবে তার আপন নিয়মে। কেটে যাবে আঁধার। আসবে নতুন ভোর। [caption id="attachment_217911" align="alignnone" width="500"] বোরহান বিশ্বাস[/caption] লেখক: সাংবাদিক, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App