আজাদ রহমানের মনের রঙেই রাঙিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানে অনেক রত্নের মাঝে তিনি জ্বলজ্বল করা হীরক খণ্ড। তিনি একাধারে সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী। স্বাধীনতার ক’বছর আগে ১৯৬৩ সালে কলকাতার ‘মিস প্রিয়ংবদা’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন আজাদ রহমান।
তবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে বাবুল চৌধুরীর ‘আগন্তুক’ ছবির মাধ্যমে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন। প্রথম ছবিতে একেবারেই নতুন শিল্পী খুরশিদ আলমকে ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’ গানটি দিয়ে জনপ্রিয়তা পাইয়ে দেন। এই গানটি দিয়েই খুরশিদ আলম রাজ্জাকের কণ্ঠ মেলানো গানগুলোর জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন।
তবে গীতিকার নইম গওরের লেখা ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো…’ গানটির সুর করে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেন আজাদ রহমান। তার সুর করা গানগুলো আমাদের সোনালি দিনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। যেসব গানের মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র স্বর্ণযুগ পেয়েছে তার অনেক গানই আজাদ রহমানের সুর করা। যেমন-
১. বন্ধু ওগো, কী করে ভাবলে,
তুমি দূরে চলে গেলে আমি
সুখে থাকবো।
তুমি ছাড়া আমি একা
সুখে ঘর বাঁধবো… এমন গান এখনও যখন শুনি, তন্ময় হয়ে যাই। এমনি আরো গান আছে যা
আমাদের চিরন্তন আবেগ তৈরি করে।
২. মনেরও রঙে রাঙাবো বনেরও ঘুম ভাঙাবো
সাগর পাহাড় সাগর পাহাড় সবাই যে কইবে কথা
আকাশে বাতাসে জাগবে প্রাণেরও কাঁপন
বনেতে মনেতে লাগবে মধুরও লগন
ফুলেরা হাসবে ভ্রমর আসবে
সুরেতে গাইবে তরুলতা।
৩. ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি
তুমি হলে মনের রাণী
তোমার দৃষ্টি যেন ছোবল হানে
যখন তখন শুধু আমার প্রাণে,
ওরে কালনাগিণী।
৪. মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না
দোহায় মা আমার লাইগা আর কানদিস না।
মায়ের চোখে কান্না এলে
ছেলের খুশি যায় গো চলে
সব ব্যথা মা সহে যে তোর কান্না সহে না।
৫. ভালোবাসার মূল্য কত
আমি কিছু জানি না
এ জীবন তুল্য কি তার
আমি সে তো বুঝি না
৬. ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়
বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়
মুখ ঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায়
মানুষকে কী দেখে চিনবে বলো?
৭. আকাশ বিনা চাঁদ হাসিতে পারে না
যাদু বিনা পাখি বাঁচিতে পারে না
যাদু পাখি এক, এক দুজনা, এক দুজনা
ওরে যাদু তোরে ছাড়া জীবন কিছুই চাহে না।
এছাড়াও রয়েছে, বনে বনে যত ফুল আছে…, ও রানা ও সোনা এই শোনো না…, যুগে যুগে প্রেম আসে জীবনে…, আপায় কইছে আমারে বাল্যশিক্ষা কিইন্না দিবো… অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান।
মাসুদ পারভেজের ‘এপার ওপার’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাদের মন আরো বেশি জয় করে নেন। অথচ এই গানটি গাওয়ার কথা ছিল আব্দুল জব্বারের। তবে আব্দুল জব্বার গানটির জন্য দুইবার আলাদাভাবে পারিশ্রমিক দাবি করলে সঙ্গীত পরিচালক আজাদ রহমান বেঁকে বসেছিলেন। তিনি আব্দুল জব্বারকে এক পারিশ্রমিকেই ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ গানটির রোমান্টিক ও স্যাড দুই ভার্সনের জন্যই গাইতে বলেন। আব্দুল জব্বার রাজি হয়ে শুধু ‘মন সঁপেছি আমি তার মনেরই আঙিনায়’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে চলে যান।
পরবর্তীতে আজাদ রহমান ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ গানটি নিজের কণ্ঠে তুলে প্রযোজক ও নায়ক সোহেল রানাকে শোনালে সোহেল রানা তাকেই কণ্ঠ দিতে অনুরোধ করেন। ছবি মুক্তি পাওয়ার পর সোহেল রানার ঠোঁটে সিলেটের জাফলং এলাকার কমলা বাগানে চিত্রায়িত ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ গানটি শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। যা আজও শ্রোতাদের প্রিয় গানের তালিকায়।
আর এই গানটির জনপ্রিয়তার কারণেই পরবর্তীতে সোহেল রানার ‘দস্যু বনহুর’ ও ‘গুনাহগার’ ছবি দুটোর সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’, ‘লোকে আমায় কয় গুনাহগার’ গানগুলোতেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন আজাদ রহমান।
পরবর্তীতে সুভাষ দত্তের ‘ডুমুরের ফুল’ ছবিতেও ‘মা হলো গর্ভধারিণী/ সব দুঃখ হরণকারিণী’ গানটিতেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এরপর বহুদিন ধরে আজাদ রহমানের কণ্ঠ শোনা যায়নি। তবে ১৯৯৩ সালে কাজী হায়াতের ‘চাঁদাবাজ’ ছবির একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আজাদ রহমান।
আজাদ রহমান আগাগোড়াই ক্লাসিক সুরকার। তিনি সবসময় সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় ধারার সঙ্গে আধুনিকতাকে যুক্ত করেছেন। তার গানগুলো শুনলেই আলাদাভাবে চেনা যায় খুব সহজেই। বাদী থেকে বেগম, এপার ওপার, পাগলা রাজা, অনন্ত প্রেম, আমার সংসার, মায়ার সংসার, দস্যু বনহুর, ডুমুরের ফুল, মাসুদ রানা, রাতের পর দিনসহ প্রায় সাড়ে তিনশো ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রের গানে নান্দনিক আবহ সঙ্গীত ও গানের জন্য পেয়েছেন একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।