প্রকৃতি শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার সুযোগ পেয়েছে
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২০, ০১:৪৩ এএম
ঢালী আল মামুন। আলোকচিত্র: নাসির আলী মামুন।
ঢালী আল মামুন
ঢালী আল মামুনের চিত্র
ঢালী আল মামুনের চিত্র
বিশেষ সাক্ষাৎকার ঢালী আল মামুন চিত্রশিল্পীঢালী আল মামুন। সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবেন। সামাজিক অনাচার আর অসামঞ্জস্যকে সামনে তুলে আনেন। ছবিতে তাই আশ্রয় নেয় প্রতীকধর্মিতা। দৃশ্যভাষায় দৃষ্টিনন্দন নির্মাণের পরিবর্তে দৃষ্টিগ্রাহ্যতাকে তিনি মনোযোগ দিয়ে শিল্প গড়েন। আঘাত করা তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। ভণ্ড মুখোশধারী প্রতারক, চলতি সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা চাটুকারকে তিনি কটাক্ষ করেন। তিনি মূর্ত আর বিমূর্ত- এ-দুইয়ের মাঝামাঝি দৃশ্যভাষা তৈরি করেন। মূর্ত আর বিমূর্তের মাঝে শিল্পী যে-লড়াই করেন তাতে শেষ অবধি উপলব্ধিরই জয় হয়। মামুনের ক্ষেত্রে এটি সত্য। গত শতকের আশির দশকে দেশের চারুশিল্পে আবির্ভূত স্বনামধন্য কয়েকজন সৃজনশিল্পীর মধ্যে অন্যতম একজন ঢালী আল মামুন সমাজ বাস্তবতার ভাবনায় যারা নিরন্তর নিজের সৃজনকে মানব-কল্যাণ ও সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে নিয়োজিত করতে চেয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে ছিলেন নেতৃস্থানীয়। এই শিল্পী চারুশিল্পে বাংলাদেশের প্রধান স্বীকৃতিগুলোর অন্যতম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছেন তিনি ২০০০ সালে, ঢাকায় আয়োজিত দ্বাদশ এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্র্যান্ড পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে ইতালির ভেনিসে আয়োজিত ৫৫তম বিয়েনালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম, নরওয়ের ইবসেন মিউজিয়ামসহ দেশে-বিদেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সংগ্রহে আছে ঢালীর শিল্পকর্ম। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক। [caption id="attachment_220666" align="aligncenter" width="700"] ঢালী আল মামুনের চিত্র[/caption] মানবিক এই শিল্পীর করোনা কাল কেমন কাটছে ভোরের কাগজের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাজ করার চেষ্টা করছি। মনের মধ্যে এক ধরণের উদ্বিগ্নতা আছে। ঠিক পরিপূর্নভাবে মনোযোগ দেওয়া সেটা অনেকক্ষেত্রে হয়ে উঠছে না হয়তো। তবে কাজ করছি। করোনা পরিস্থিতি সময়টা পাল্টে দিয়েছে। আমি কলোনীয়াল হিস্ট্রি নিয়ে কাজ করছি, তারই ধারাবাহিকতায় কাজ করবার চেষ্টা চলছে । এর মধ্যে যে ভাবনা নিয়ে কাজ করবার পরিকল্পনা ছিলো তা আর থাকছেনা পাল্টে যাচ্ছে ছবির দেহ ও ভিতরকার সত্তা। কারণ এখনকার পরিস্থিতি, পরিবেশ, পরিমণ্ডল এবং বাস্তবতা সব কিছু মনের ওপর একটা প্রভাব বিস্তার করছে। এছাড়া পড়াশোনাও চলছে সাথে ডিজিটাল মিডিয়ায় পছন্দের অনেক বক্তৃতা শুনছি। কিছু পছন্দের ফিল্মও দেখছি। এভাবেই চলছে। করোনার কারণে চেনা পৃথিবীটার কতোটা বদল ঘটেছে বলে মনে করছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশিষ্ট এই শিল্পী বলেন, বদল ঘটেছে তো বটেই। আমরা এতোদিন ধরে গ্লোবালাইজেশন গ্লোবালাইজেশনের কথা শুনে আসছি, কিন্তু জলবায়ুর সমস্যা কিংবা মহামারি গ্লোবাল হলেও মানুষের অধিকার কিংবা সুযোগ সুবিধার বিষয়ে বৈষম্য থেকেই গেছে। ক্রয়-বিক্রয় সহ কতৃত্বের মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটলেও অতীতের সব কিছু যথারীতি জায়গায় রয়েছে। কিন্তু করোনা আমাদেরকে একটা বোধ জাগিয়ে দিয়েছে। তা হচ্ছে- সলিডারিটা গ্লোবাল হতে হবে। যদি এই ধরনের পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হয়, তাহলে বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ব বা বৈশ্বিক সহযোগিতার জায়গা না থাকলে মোকাবেলা করাটা খুব কঠিন হবে। কারণ এটা কোনো জাতীয় কিংবা অঞ্চল ভিত্তিক সমস্যা নয়, এটা বৈশ্বিক এবং হোমোসেপিয়ানদের সমস্যা। [caption id="attachment_220668" align="aligncenter" width="700"] ঢালী আল মামুনের চিত্র[/caption] আপনার কি মনে এ সমস্যা বৈশ্বিকভাবে সমাধান করতে হবে? এর জবাবে এই শিক্ষক বলেন, আমি বিশেষজ্ঞ নই। তবে বুঝি বৈশ্বিকভাবেই এই মহামারী ছড়িয়েছে। এটার এখন আর কোনো সীমারেখা নেই, কোনো বর্ডারও নেই। এটা সর্বস্তরেই ছড়িয়ে পড়েছে। এটা তো এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা বৈশ্বিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হচ্ছে- স্থানীয় বাস্তবতা এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকেও আমলে নিতে হবে, যখন স্থানীয়ভাবে চিহ্নিত করে মোকাবিলা করা হবে। সেটা কেমন? ঢালী আল মামুন বলেন, যেহেতু সমস্যাটা বৈশ্বিক। যেমন বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ, সেখানে অনেক দিক থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন যায়গা তুলনায় তারতম্য রয়েছে। অনেক তথাকথিত উন্নত দেশের চেয়ে এখানকার লোক বসতি, এখানকার শিক্ষা দীক্ষা, এখানকার সহায় সম্পত্তি, মানুষের বুদ্ধি বিবেচনা সহ ইত্যাদিরই অনেক পার্থক্য রয়েছে। একটা উদারহণ দিচ্ছি- আমেরিকাতে আমার কিছু আত্মীয় স্বজন থাকে। তারা বললেন, এই কোয়ারেন্টাইন সময়ে কমিউনিটি কেন্দ্রিক সমস্যা হয়েছে। যেখানে সাদাপ্রধান এলাকা ছিল সেখানে সুপারসপে কয়েকদিনের মধ্যে টয়লেট টিস্যু থেকে শুরু করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি হাওয়া হয়ে গেল! আর যেখানে এশিয়ান কমিউনিটি থাকে সেখানে সুপারসপগুলোতে দেখা গেল চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুনের সমস্যা দেখা দিল। এসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জনপদভিত্তিক একটা সংস্কৃতিবোধ অনুভুত হলো তাদের মধ্যে। ঠিক তদ্রুপভাবে লক ডাউন শব্দটির একটি আঞ্চলিক পরিভাষা থাকা দরকার ছিল। আমাদের যেমন টেলিভিশন এই বিষয়ে যে সব অনুষ্ঠান হয়, সেটা সম্পূর্নরূপে মধ্য বিত্ত কেন্দ্রিক। এর ফলে আমাদের বিরাট একটা জনপদ, জনগোষ্ঠীকে আমরা ঠিক সেভাবে পাঠ করি না। তাদেরকে বলি, তারা কেউ শোনে না। কিন্তু আসলে তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার যে ভাষা এবং যোগাযোগ স্থাপন করার যে উপায় সেটা আমরা অবলম্বন করছি না। কারণ আমরা একটা শ্রেনীকেন্দ্রিক মানসিকতা থেকেই কাজগুলো করছি। সর্বস্তরেই এরকম হচ্ছে। আমার মতে, এ ক্ষেত্রে একটা অঞ্চল ভেদে জনপদভিত্তিক ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরী। [caption id="attachment_220665" align="aligncenter" width="960"] ঢালী আল মামুন[/caption] করোনার কারণে আপনার চেনা পৃথিবীর কোনো বদল ঘটেছে বলে মনে করছেন কি? এর জবাবে তিনি বলেন, বদল যে ঘটেছে এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে করোনার ভাইরাসের মতোই আরেকটি বৈশ্বিক সমস্যা হচ্ছে পরিবেশ ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তন। সেটি তো প্রায় আড়াইশো তিনশ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিয়ালইজেশনের পরেই ঘটনাটি ক্রমান্বয়ে ঘটে চলেছে। যা এতোদিন ধরে বিজ্ঞানীরা অনেকভাবেই বলেছেন। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদ আর ক্ষমতাধররা, নীতিনির্ধারকরা যারা শুধুমাত্র লাভ লোকসানের হিসাব করেন তারা আমলে নেননি বিষয়টা। বরঞ্চ তারা যে উন্নয়নের একটা তকমা তৈরী করেছেন সে অনুযায়িই চলছে। আমার তো হচ্ছে, এখন লক ডাউনের কারণে গোটা পৃথিবীতে প্রকৃতি একটা শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। তাই শুধু মানুষকেন্দ্রিক এবং আরামকেন্দ্রিক সমাজের কথা চিন্তা না করে ভাবতে হবে, আমাদের প্রতিবেশি শুধু মানুষ নয়, আমাদের প্রতিবেশি আরও অনেকই আছে। বৃক্ষ, প্রাণী, কীট পতঙ্গ তারাও আমাদের প্রতিবেশি, এবং মানুষের মধ্যে ও নানা মানুষ। এমন বোধ না আসলে এ্যান থ্রোপসিন নামে যে শব্দটি এখন বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন। আমরা সত্যিকার অর্থে তাই বলেই গণ্য হবো। নইলে ডাইনোসরদের মতো মানুষও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ এই ধরিত্রি মানুষ ছাড়াও ছিল, মানুষসহও আছে এবং মানুষ ছাড়াও থাকতে পারবে। তাই মানুষকে এখন ভাবতে হবে ধরিত্রির সঙ্গে কিভাবে আচরণ করবে।