×

মুক্তচিন্তা

করোনা : মানুষ-অমানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২০, ১০:০৭ পিএম

করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেবল গুজব রটানো নয় আরো অমনুষ্যত্ব কিংবা আতঙ্ক চোখে পড়ে যখন আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন মানুষের সঙ্গে আপনজনসহ আত্মীয়স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীদের আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়। কখনো কখনো মনে হয় আমরা যেন মনুষ্যত্ব চরমভাবে হারিয়ে ফেলেছি। যে দেশে একজন অতি সাধারণ মানুষও অন্য একজন মানুষের পাশে না থেকে নিজেকে স্বস্তিতে রাখত না সেখানে এখন মা-বাবা, সন্তানাদির সঙ্গে ভয়ঙ্কর আচরণ করা হচ্ছে। মানুষ তার প্রিয়জনকে ফেলে চলে যাচ্ছে বা মৃতদেহ সৎকার করছে না। ইমাম সাহেব জানাজা পড়াচ্ছেন না বা জানাজায় শরিক হচ্ছে না কেউ অথবা কবর খোঁড়া বা গোসল করানোর মানুষ নেই। এমনকি কবরস্থানে কবর দিতে দেয়া হচ্ছে না। বাড়িওয়ালা সাধারণ মানুষ, কর্মজীবী, ডাক্তার-নার্সকে বাড়ি ছাড়তে নোটিশ দিচ্ছে। মসজিদের খাটিয়া করোনা আক্রান্ত রোগী বহন করতে দেয়া হয়নি এমন নজিরও রয়েছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে, মৃতদেহ থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা ক্ষীণ। এসব দৃশ্য মানব ইতিহাসে অমানবিকতারই প্রমাণ। এটি সত্য যে, ভাইরাসটি ছোঁয়াচে সংক্রামক। ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপন করা অতি প্রয়োজনীয়। তবে সেটি মানার ক্ষেত্রেও এমন কোনো কারণ নেই যে আমরা অমানুষ হয়ে যাব। বরং লক্ষ করা যাচ্ছে যে হাটবাজার, বিপণিবিতান থেকে শখের কেনাকাটাতেও বিপুল জনসমাগম হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের বা দোয়া মাহফিল বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাজা এবং এখন বিপণিবিতানগুলোর অবস্থা দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায় যে করোনাবিষয়ক সতর্কতা মোটেই কার্যকরভাবে পালিত হচ্ছে না। ঘটনা-১ : ৬ মে ফেসবুকে প্রকাশিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখুন : কেউই লাশ নামাতে দেয় না। আবদুল হাই (৬৫) অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। তার মরদেহ নিয়ে বাড়িতে ঢুকল অ্যাম্বুলেন্স। তখন রাত ১১টা। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনে হাইয়ের আপন ভাই, চাচাতো-জেঠাতো ভাইয়েরা বেরিয়ে আসেন। প্রতিবেশীরাও হাজির। না, তারা কেউ লাশ নামাতে আসেনি। এসেছে যেন কেউ লাশটি নামাতে না পারে সেজন্য। সবাই একবাক্যে বলে দিল, আবদুল হাই করোনায় মারা গেছে। তার লাশ গ্রামে দাফন করা যাবে না। মা-ছেলে অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে চলে যান আরেক গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ি। সেখানেও প্রত্যাখ্যাত তারা। এভাবে রাত ২টা বেজে গেল। একটি ভ্যানগাড়ি জোগাড় করেন শাহজাহান। অ্যাম্বুলেন্স থেকে বাবার লাশ নামিয়ে ভ্যানে তোলেন। ছেলে ভ্যান টানছেন, বাবার মরদেহের পাশে মা বসে আছেন। ঘটনাটি ময়মনসিংহের গৌরীপুরে। আবদুল হাইয়ের বাড়ি পৌরসভার সাতুতি গ্রামে। নানা গ্রাম ঘুরে হাইয়ের মরদেহ নিয়ে ভ্যানটি থামে পৌরসদরের একটি ধান মহালের সামনে। গভীর রাতে থানায় এ খবর গেলে পুলিশ ছুটে আসে। তারা আবদুল হাইয়ের মরদেহ নিয়ে সাতুতি গ্রামে যায়। ওই গ্রামেই মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করে। স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক সমকাল। ঘটনা-২ : এমন আরো একটি ঘটনা আমার নিজেরই মোকাবিলা করতে হয়েছে। মে মাসের ৩ তারিখ সকালে হঠাৎ করেই আমাদের টেলিটকের একজন কর্মচারী ফোন করল। কুশল বিনিময়ের আগেই মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে দিল। কোনো মতে কান্না থামিয়ে জানতে চাইলাম তার কী হয়েছে। সে জানাল সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মার্চ মাসে সে ও তার স্বামী ঢাকা ছেড়ে তার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। আজকে ফিরে এসেছে। কিন্তু বাড়িওয়ালা তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আমি বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে জানলাম তার ৮০ বছর বয়স। কিন্তু সদ্যবিবাহিতা তার নাতনির বয়সী মেয়েটির প্রতি তার কোনো দরদ পাওয়া গেল না। অনেক অনুরোধের পর পুলিশের ভয় দেখিয়ে মেয়েটিকে বাড়িতে ওঠতে দেয়াতে পারলাম। কিন্তু স্বল্প আয়ের এই মেয়েটির ওপর দুই মাসের অগ্রিম বাড়িভাড়া দাবি করে বসল এই বাড়িওয়ালা। করোনার সময়ে নতুন বাড়ির সংস্থান করতে না পারার কারণে বাড়তি চাপই তাকে নিতে হলো। করোনাকালে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। একদিকে স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে নিজের ও অন্যের জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে অন্যদিকে করোনা থাকুক বা না থাকুক অসুস্থ মানুষ মাত্র অমানবিক হয়রানির শিকার হচ্ছে। এটি শহরে যেমন আছে তেমনি আছে গ্রামে। মাকে গাড়িতে করে এনে জঙ্গলে ফেলে যাওয়ার পর পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার করার যেমন ঘটনা আছে তেমনি আছে বাড়ির উঠানে হাঁটতে যাওয়ার জন্য মাকে ঘরে ঢুকতে না দেয়ার ঘটনাও। আমার গ্রামের বাড়ির পাশের থানা শাল্লায় দুই ছেলে ও তাদের স্ত্রীরা তাদের মাকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি এই অজুহাতে যে মা নাকি বাইরে থেকে আসা ধান কাটা শ্রমিকরা যেখানে থাকে সেখানে গিয়েছিল। মা কেবল উঠানে বেড়াতে যাওয়ার কথা বারবার বলার পরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অবশেষে পুলিশকে এসে মাকে ঘরে তুলে দিতে হয়েছে। মানুষের জন্য মানুষ : এতে মুদ্রার উল্টো পিঠটার কথাও আমরা স্মরণ করতে পারছি। করোনার প্রাদুর্ভাব হওয়ার পর সরকার জনগণের পাশে থাকার সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ প্রণোদনা, ত্রাণ বিতরণ ও স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা প্রদান করার ক্ষেত্রে সরকারের এই উদ্যোগ অবশ্যই সর্ব মহলে প্রশংসিত হচ্ছে। সরকারের প্রচেষ্টার বাইরেও অনেক সাধারণ মানুষ হতদরিদ্র-দরিদ্র, নিম্নবিত্ত-দিনমজুরসহ সব মানুষের পাশেই যার যার সাধ্যমতো এগিয়ে আসছেন। একজন অশীতিপর মহিলা তার হজের টাকা গরিব মানুষকে দিয়ে দিলেনৃ। অনেক বেসরকারি সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন নিজেরা নিজেদের সামর্থ্য থেকে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে বাসায় বাসায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। অনেকে স্থানীয়ভাবে হতদরিদ্র-দরিদ্র-দিনমজুর বা দুস্থদের পাশে রয়েছেন। এরই মাঝে নতুন ধরনের মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে শুরু করেছে। বহু মানুষ নিজেরা তাদের গ্রাম, পাড়া, মহল্লা বা এলাকাকে অন্তরীণ করে রাখছে। এসব এলাকায় কেউ ঢুকতে পারে না বেরোতেও পারে না। দেশের বাণিজ্য সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, যুব সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইতাদির স্বেচ্ছাসেবা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের ব্যবস্থাও করেছেন। এলাকা জীবাণুমুক্ত করা থেকে শুরু করে মাস্ক-সুরক্ষা সামগ্রী ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। মানুষ আবার প্রমাণ করছে মানুষ মানুষের জন্যই। প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রীর অভাব থাকায় বাংলাদেশের ডাক্তার ও নার্সদের মাঝে করোনায় সেবা দেয়ার বিষয়ে সংশয় ছিল হয়তো। কিন্তু যখনই ন্যূনতম সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা হয়েছে তখন অন্তত সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজের ও পরিবারের ঝুঁকি নিয়েও রোগীদের পাশে থাকার এই মহতী প্রচেষ্টাকে একটি অসাধারণ মানবিক উদ্যোগ বলে মনে করা যায়। নারী-পুরুষ-যুবা-বয়স্ক নির্বিশেষে বাংলাদেশের ডাক্তার ও নার্সদের এই অবদান জাতি অবশ্যই স্মরণ রাখবে। এটি অবশ্য কেবল বাংলাদেশে নয়, যে চীনে করোনার সূচনা সেখান থেকে সারা দুনিয়ার ডাক্তার ও নার্সরা এই মহাবিপদে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এদের অনেককে জীবন দিয়েছেন এবং তারা প্রতি মুহূর্তে বিপদের মাঝেই থাকছেন। তাদের একে অপরের মানবিক সম্পর্ক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ডাক্তারি বা নার্স শিক্ষা গ্রহণের সময় তারাও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এখন বা এ রকম মহামারির সময়ে সেটি পূরণ করে তারা সেরা মানুষের পরিচয় দিতে পারেন। যেসব ডাক্তার ও নার্স এখনো এই পথে পা দেননি তারাও আশা করি তাদের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। এটি বস্তুত কেবল একটি চাকরি নয়। এটি বস্তুত মানবতার পাশে থাকা ও বিপন্ন মানুষের সেবা করা। সব পেশায় থেকে এই অসাধারণ কাজ করা সম্ভব হয় না। ডাক্তারদের মতোই বিপদ মাথায় নিয়ে ব্যাংক, ডাক বিভাগ, ইন্টারনেট কর্মী, টেলিকম কর্মী, বিদ্যুৎ বিভাগ, টেলিফোন, পরিবহন, ই-কমার্স, ওষুধসহ জরুরি পণ্য সরবরাহ ও বিতরণ অব্যাহত রাখার কাজে নিয়োজিত ইত্যাদি বিভিন্ন খাতের কর্মীরা জরুরি অবস্থায় জনগণকে জীবন বাজি রেখে সেবা দিচ্ছে। আমি একটি খবর শুনে বিস্মিত হয়েছি যে আমার ডাক বিভাগের মহিলা ড্রাইভাররা (এমনকি গর্ভবতী অবস্থাতেও) গাড়ি চালিয়ে বিনামূল্যে জেলায় জেলায় চিকিৎসা ও সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা ডাকঘর খুলে সাধারণ মানুষকে ডাক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনের টাকা দিয়েছে। তারাই আবার ফসলের খেত থেকে শাক-সবজি বিনামূল্যে বাজারে পৌঁছে দিচ্ছে। টেলিফোনের বা ইন্টারনেটের লাইনম্যানরা ভয়কে জয় করে তাদের সেবা অব্যাহত রেখেছে। এই অবস্থাতে নিরলস কাজ করছেন কৃষিকর্মীরা। বিশেষ করে ধান কাটার সময়ে তারা জীবন বিপন্ন করেও খেতের ধান কেটে দিয়েছে। এই সময়ে দিনে-রাতে শ্রম দিয়ে ধান কাটায় যারা নিযুক্ত ছিলেন তারা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। অত্যন্ত চমৎকারভাবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করছে। বিপন্ন মানুষের কাছে তারাই হয়ে ওঠেছে আশ্রয়স্থল। সরকার পুরো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য বিমা ছাড়াও জরুরি কাজে নিয়োজিতদের জন্য প্রণোদনার ঘোষণাও দিয়েছে। যদি আমরা সামগ্রিক অবস্থার ব্যাখ্যা করি তবে এই কথা বলতেই হবে যে বিশ্বজুড়ে বিরাজিত এই মহাদুর্যোগ থেকে অবশ্যই আমরা পরিত্রাণ পাব। প্রধানমন্ত্রীর সেই বাণীটা আমাদের স্মরণ রাখা দরকার। তিনি বলেছেন যে, বাঙালি বীরের জাতি এবং এবারো আমরা বিজয়ী হব। আমাদের সবার বিশ্বাসও তা-ই। মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App