×

মুক্তচিন্তা

করোনার চাষাবাদ : ভাইরাসে বাম্পার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২০, ০৫:৪৪ পিএম

করোনার হানা বর্তমান। আর প্রতিকার ভবিষ্যৎ। তখন অভ্যাস আবার আগের জায়গায় চলে আসবে কিনা, কে জানে? করোনা মহামারি আপাতত আমাদের হাত-মুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে দিতে পেরেছে। আরো কিছু বদবৈশিষ্ট্যেও বাদ সাধতে পেরেছে। কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অবিরাম বেত মেরে তাদের সভ্য বানাতে পারে না।

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে হাত ধোয়ার উপকারিতা। নিশ্চিত বলা যায় এবারের বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস কেবল পালন নয়, উদযাপন হবে ব্যাপক আয়োজনে। এত বছর বাঁহাতি দিবস, ডিম দিবস, সুখ দিবস, কবুতর দিবস, টমেটো দিবসের মতো হাস্যস্পদ অগুনতি বিশ্ব দিবসের মতো পালন হয়েছে দিনটি। তা-ও সব দেশে নয়। কিছু কিছু দেশে। তারিখটি ১৫ অক্টোবর। দিনটির উদ্দেশ্য হাত ধোয়ার উপকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। বাংলাদেশেও সীমিত আয়োজনে দিনটি পালন হয়ে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। এ নিয়ে হাসিমশকরাও কম হয়নি। বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসের সূচনা তত আগের নয়। সুইডেনের স্টকহোমে সর্বপ্রথম ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর হাত ধোয়া দিবসের গোড়া পত্তন। আয়োজক ছিল কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মোর্চা ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ফর হ্যান্ডওয়াশিং’। শুরুতে এ ক্যাম্পেইনের মূল টার্গেট করা হয়েছিল স্কুল শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ানো। পরে কিছু দিনের মধ্যে বিশ্বজুড়ে সব বয়সী মানুষের মধ্যে প্রতিদিন যথানিয়মে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার তাগিদ তৈরি হয়। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ চেতনে-অবচেতনে হাত দিয়ে কত কাজ করে, হাত কত জায়গায় নেয়- নিজেও জানে না। এসব কাজ করতে গিয়ে হাতে লাগে অসংখ্য জীবাণুর সংস্পর্শ। এতে প্রত্যেকের হাত প্রত্যেকের শত্রু হয়ে ওঠে। যার ফলে ছড়ায় নানা রোগবালাই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়েও বেশি কাজ করে। সেই বিবেচনায় হাত ধোয়া একটি সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য অভ্যাস। হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে পানি ও মলবাহিত রোগগুলো বেশি দূর এগুতে পারে না। করোনার হানা বর্তমান। আর প্রতিকার ভবিষ্যৎ। তখন অভ্যাস আবার আগের জায়গায় চলে আসবে কিনা, কে জানে? করোনা মহামারি আপাতত আমাদের হাত-মুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে দিতে পেরেছে। আরো কিছু বদবৈশিষ্ট্যেও বাদ সাধতে পেরেছে। কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অবিরাম বেত মেরে তাদের সভ্য বানাতে পারে না। নাগরিকদেরও সভ্য হওয়ার ইচ্ছা থাকতে হয়। সুস্থ থাকা ও রাখার চর্চাও করতে হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জনগণকে উদ্দেশ করে বলতে হয় হাত-মুখ ধুয়ে পয়পরিস্কার থাকতে। কোন তলানিতে জনসচেতনতা? জনগণের বোধ-বুদ্ধি? করোনাকালে প্রমাণ হয়েছে এতদিন শিক্ষা মানুষকে দায়িত্ব সচেতন করেনি। সভ্য করেনি। আমরা মরতে চাই না, কিন্তু স্বর্গে যেতে চাই। বিষ গিলতে চাই। নিয়ম মানতে চাই না। কিন্তু করোনা থেকে সুরক্ষা চাই। হাঁচি-কাশি দিতে দিতে, দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে সরকারের ভুলত্রুটি ধরে ফেলি। হতে পারে বড় জনসংখ্যার ছোট দেশটিতে রাস্তাঘাটে শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা কঠিন। গণপরিবহনে অন্যের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা মুশকিল। বাসের হাতল, সিঁড়ির রেলিং, লিফটের বোতাম, রেস্টুরেন্টের চেয়ার-টেবিল-গ্লাস-প্লেট-তোয়ালে, দোকানির দেয়া প্যাকেট না ছুঁয়ে থাকা সম্ভব নয়। এরপরও সাবধানতার কিছু বিষয়আশয় থেকে যায়। যেখানে সরকারের বাইরে মানুষের নিজ স্বার্থেই করণীয় অনেক কিছু রয়েছে। ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষকে সাফসতুর রাখার দায়িত্ব সরকারের নয়। সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভবও নয়। নিজেরা ভাইরাস ছড়ালে, জন্ম দিলে সরকার কী করবে? যত্রতত্র থুথু ফেলা, পানের পিক ফেলা এবং নাক ঝাড়া বন্ধ করতে সরকারের আদেশ- অনুরোধ লাগছে। নিজেদের চারদিকসহ গোটা পরিবেশকে ভাইরাসের হ্যাচারি করে ফেলছেন কেউ কেউ। চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ আবর্জনা ফেলে ভাইরাসের ভাগাড় তৈরি করলে সরকার বা রাষ্ট্র এখানে কী করবে? কব্জি ডুবিয়ে খাব আমি আর খাওয়ার পর সাবান দিয়ে কব্জি ডুবিয়ে হাত ধুয়ে দেবে আরেকজন? বা সরকার? রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় এই করোনার মাঝেও কফ-থুথু, পানের পিক কদ্দূর কমেছে? এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হতে পারে গণমাধ্যমে। কোনো কোনো অফিস-আদালতও এক-একটি ডাস্টবিন। হাসপাতাল আরো বড় ডাস্টবিন। ফুটপাতে কুকুরের মতো পেসাব-পায়খানা করার স্বাধীনতা এখানে অবারিত। মানুষ হ্যান্ডশেক ছাড়াও আলগা মহব্বত দেখাতে গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে। দুপুরবেলা সিটি করপোরেশনের টুপিখোলা ময়লার গাড়ি রাস্তায় জয়রাইড দেয়। ব্যাংক-নোটও একেকটি ময়লার ভাগাড়। একবার স্পর্শ করলে করোনার আনন্দ র? র‌্যালি করে শরীরে ঢোকার গ্যারান্টি রয়েছে। এসবের জন্য কাউকে দায়ী করা হয় না। দায়ী করা যায়ও না। কোথাও জবাব দিতে হয় না! ভাইরাসের এ রকম বাম্পার হ্যাচারিতে নাক ডুবে থাকার পরও এখনতক বেঁচে থাকা পরম সৌভাগ্য অনেকের জন্য। আর ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে আল্লাহর খাস রহমত। করোনাসহ নানা ভাইরাসের বিস্তার ঘটাতে আমরাই যথেষ্ট। আলামত এবং পারিপার্শ্বিকতায় জানাই ছিল করোনা থেকে বাংলাদেশ রেহাই পাবে না। কার সঙ্গে কথা বলছি, ঘুরছি- একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই। সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন বুমেরাং হচ্ছে পদে পদে। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিধিও মানতে নারাজ আমরা। করোনা মোকাবিলার নামে মাস্ক পরে ঘুরছি। আবার এক বিড়ি ফুকছি চারজনে। মাস্ক আর স্যানিটাইজার নিয়ে যে কাণ্ড ঘটছে তা আমাদের অভ্যাস বদলানোর বার্তা দেয় না। অমানবিক- পৈশাচিক বর্বরতাও বাদ দিচ্ছি না। এমন নিদানকালেও পরিবেশের বারোটা বাজাতে আমরা কমতি করেছি? মাদারীপুরের চরমুগুরিয়ায় দীর্ঘদিন থেকে বেশ কিছু বানর বসবাস করে আসছিল। কিন্তু স্থানীয় কিছু মরদ খাবারের সঙ্গে বিষ প্রয়োগে বেশ কিছু বানরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কী বেটাগিরি। হাট-বাজারে, মাঠ-ময়দানে যেভাবে বঙ্গসন্তানরা বীর বিক্রমে বাজার সওদা আর আহাম্মকের মতো নিশ্চিন্তে হেঁটে হেঁটে খোশগল্প করছি, তাতে পঙ্গপাল কেন, গোটা প্রকৃতিরই ভয় পেয়ে আইসোলেশনে চলে যাওয়ার দশা। হাত স্যানিটাইজের মতো মনটাকে স্যানিটাইজ করার গরজ আছে ক’জনের? বিষ মিশিয়ে পঞ্চাশটি বুলবুলি আর শালিকের মৃত্যু ঘটানো হয়। সামান্য একটা মোবাইলের জন্য চার চারটি মানুষকে পৃথিবীতে থেকে সরিয়ে দিতে দেয়া হয়। স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্যে অন্যের খেতের সবুজ পেঁপেগুলো গাছসমেত কেটে সাবাড় করে দিতে পারি, পুকুরের মাছগুলোকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে দিতে পারি। বাদ পড়ছে না ধর্ষণের ঘটনাও। অবুঝ, শৈশবেই মেয়েশিশুটির সঙ্গে অমানুষিক বর্বরতা করে হত্যা করে দিতে পারি। অপরিপক্ব মানুষরা পরিপক্বতার ফানুশ উড়ায় এখানে। সমাজে অমানুষদের দিব্যি বেঁচে থাকার অধিকার থাকলেও প্রাণ দিতে হলো এই অবলা প্রাণিগুলোকে। বানরের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার খেয়ে নিচ্ছে কর্মকর্তারা, তাদের জন্য গুচ্ছগ্রাম তৈরি হলেও সেখানে পালন করা হচ্ছে গরু-ছাগল। অভয়ারণ্যের জন্য নির্দিষ্ট পার্কও এখন মানুষের দখলে। খাবারের অভাবে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। মরছে-ঘুরছে। ছড়াচ্ছে ভাইরাস। বাদবাকি কিছু পাড়ি দিচ্ছে দূর-দূরান্তর।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App