×

জাতীয়

সনদের ফাঁদে তুচ্ছ জীবন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২০, ০৯:৪১ এএম

নেগেটিভ ‘করোনা সনদ’ থাকলেও মিলছে না সেবা সনদ সংগ্রহে নমুনা পরীক্ষার হিড়িক নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না গুরুতর অসুস্থরা রোগী ফিরিয়ে দিলে লাইসেন্স বাতিল

করোনার সংক্রমণ ছাড়াও যে মানুষ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে এ কথা যেন ভুলতেই বসেছে মানুষ। বিশেষ করে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ, বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে ভর্তির জন্য করোনা সনদে পজিটিভ থাকা অপরিহার্য। অন্যথায় সেখানে চিকিৎসা পাবার কোনো সুযোগ নেই। আবার অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে সনদে থাকতে হবে নেগেটিভ। হাসপাতালগুলোতে সেবা পেতে রোগীকে আগে ‘করোনা সনদ’ দেখিয়ে প্রমাণ দিতে হয় তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ না নেগেটিভ। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। করোনা সনদে নেগেটিভ লেখা থাকার পরও হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে চিকিৎসার জন্য ঘুরতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। এদিকে আপদকালীন সময়ে চিকিৎসা পেতে যাতে অসুবিধা না হয় সেই ভাবনা থেকে উপসর্গ না থাকলেও ‘করোনা সনদ’ পেতে নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন অনেকেই। এতে নমুনা পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোতে দেখা দিয়েছে দীর্ঘ লাইন। পরীক্ষার ফল পেতে তৈরি হচ্ছে জট। আর এই অবস্থায় মুমূর্ষু রোগীরা নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না। এই ‘করোনা সনদ’ সংগ্রহের চক্করে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে মূল্যবান অনেক জীবন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগী নিয়ে ঠেলাঠেলি আসলেই অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। সরকারের পাশাপাশি যে হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরে যাবে সেই হাসপাতালকেও দায় নিতে হবে। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ওই সব হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের নামের তালিকাও চেয়েছিলেন। এই ঘটনাগুলো আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। আর এই করোনা পজিটিভ-নেগেটিভ সনদের যে চক্কর এখন দেশে চলছে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কারণ এই সনদের কোনো মূল্য নেই। কেননা, দেশে সীমিত পরিসরে হলেও দ্বিতীয়বারের মতো করোনায় সংক্রমণ শুরু হয়েছে। তাছাড়া নিয়ম মেনে ও উপসর্গ জেনে পরীক্ষা না করালে পরীক্ষার সঠিক ফলাফল আসবে না। অনেকক্ষেত্রে সেটিই হচ্ছে। ফলে সাধারণ রোগীরা যারা হাসপাতালে সেবা নিতে যাচ্ছেন তাদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। সেবা না পেয়ে অনেকে মারা যাচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক নির্দেশনা জারি করে। তাতে বলা হয়েছে, সব বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের জন্য চিকিৎসার আলাদা ব্যবস্থা থাকতে হবে। চিকিৎসা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কোনো রোগীকে ফেরত দেয়া যাবে না। রেফার করার আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে যেসব রোগী কিডনি ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে হবে। নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে, প্রচলিত বিধান অনুযায়ী হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এর আগে ৩০ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে আসা কোনো রোগীকে যদি কোভিড-১৯ আক্রান্ত বলে সন্দেহ হয় এবং যদি কোনো কারণে ওই রোগীকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব না হয়, তাহলে ওই রোগীকে ওই হাসপাতালেই অপেক্ষমাণ রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে ওই রোগীর ভর্তি ও চিকিৎসাসংক্রান্ত পরামর্শ নিতে যোগাযোগ করতে হবে। এর জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষের চারটি ফোন নাম্বারও দেয়া হয়। ওই নম্বরগুলো হলো- ০১৩১৩-৭৯১ ১৩০, ০১৩১৩-৭৯১ ১৩৮, ০১৩১৩-৭৯১ ১৩৯ ও ০১৩১৩-৭৯১ ১৪০। যা মানা হচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়নি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, কোভিড ও নন কোভিড এমন ভাগ না করে এখন থেকে সব হাসপাতালেই রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণ টেনে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমেরিকাতে একই হাসপাতালের কোভিড ও নন কোভিড রোগীদের জন্য জোন আলাদা করা হয়েছে। ফলে সেখানে রোগীরা হেনস্থার শিকার হয় না। সরকার কিছু হাসপাতালকে কোভিড-১৯ এর জন্য নির্ধারণ করেছেন। সাধারণ হাসপাতালগুলোতেও আমেরিকার মতো পদ্ধতি চালু করা উচিত। কারণ এতে করে সংক্রমণের ঝুঁকি কিছুটা থাকলেও মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। তিনি বলেন, আমরা এখনো জানি না আমাদের দেশের সংক্রমণ কোন পর্যায়ে রয়েছে। আরো কত মানুষ এতে সংক্রমিত হবেন? তাই যারা সেবা দেবেন তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে আমাদের একই হাসপাতালে দুই ধরনের রোগীর আলাদা জোন করে ব্যবস্থা রাখা উচিত।

তবে ভিন্ন মত পোষণ করেন পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। কোভিড-নন কোভিড সনদের ফাঁদে সাধারণ রোগীদের ভোগান্তি প্রসঙ্গে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, কোভিড সন্দেহভাজন রোগীর কোন হাসপাতালে যাবেন তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। এছাড়া নির্দিষ্ট কোভিড হাসপাতাল থাকা উচিত। না হলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। তবে কোনো হাসপাতাল কোনো রোগী ফিরিয়ে দিতে পারে না। প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে অন্য হাসপাতালে রেফার করতে পারে। সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে সনদের প্রয়োজন হবে কেন? এসব সনদ মূল্যহীন। সনদপ্রাপ্তরা আবারো করোনায় সংক্রমিত হতে পারেন। তাই ওই সনদের কোনো মেয়াদ নেই, প্রয়োজনও নেই।

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ মনে করেন, হাসপাতালগুলোকে মানবিক হতে হবে। আর চিকিৎসক-নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, রোগীদের দুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এমন অবস্থা আমাদের সবার জন্যই দুঃখজনক। এটা কাটানো উচিত। হাসপাতাল ও পরীক্ষার ব্যবস্থা যদি একই প্রতিষ্ঠানে করা যায় তাহলে হয়তো রোগী ফিরিয়ে দেয়া ও তাদের দুর্ভোগের ঘটনা কমবে বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে মনিটরিং আরো বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস মনে করেন, শুরুতেই দেশে কোভিড-নন কোভিড ও উপসর্গযুক্ত রোগীদের জন্য হাসপাতাল আলাদা করা উচিত ছিল। এছাড়া স্থানীয়ভাবে যখন করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তখনই কঠোর নিয়ন্ত্রণ হলে আজকে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, চিকিৎসা পেতে করোনা সনদকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তা মোটেও কাম্য নয়। সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু এই সনদের কথা বলা হয়নি। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মুমূর্ষু রোগীরা। পরীক্ষা করানোর আগেই অনেকের মৃত্যু হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগী অধ্যাপক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম রেজওয়ান ভোরের কাগজকে বলেন, যারা কোনো কারণে করোনা সংক্রমিত কারো সংস্পর্শে এসেছেন তারা তাড়াহুড়ো করে নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন। সংক্রমণ যে মাত্রায় গেলে পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হবে সেই সময়টুকু তারা দিচ্ছেন না। এতে করে পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ হতে পারে। আবার পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ হওয়ার সাতদিন পর তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যা ওই ব্যক্তি ও অন্যের বিপদ ডেকে আনবে। এক্ষেত্রে ডা. শামীম রেজওয়ানের পরামর্শ, উপসর্গ দেখা দেয়া পর্যন্ত ব্যক্তিকে অপেক্ষা করতে হবে, কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। নিয়ম মেনে উপসর্গ জেনে পরীক্ষা করালে পরীক্ষার ফলাফল এবং যৌক্তিকতা দুটোই সঠিকভাবে হবে। মনে রাখতে হবে স্ক্রিনিং আর ডায়াগনস্টিক টেস্টের ব্যবহার বা প্রয়োগ ভিন্ন। পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। তাই বলে শুধু শুধুই বা অসময়ে পরীক্ষা কোনো সুফল দিবে না। সময়, শ্রম আর অর্থের অপচয় করার বিলাসিতা এমন সীমিত সুযোগ ও সম্পদের দেশে না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App