×

মুক্তচিন্তা

তুমি আওনা কেনে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২০, ০৯:০৪ পিএম

উথাল-পাথাল হয়ে আছে যখন নিখিল, তখনো নির্ঘুম কৃষক। আলুথালু যখন নাগরিক শঙ্কা, তখনো নির্ঘুম কৃষক। জমিনের ওপর যে আজন্ম বিশ্বাস তা কীভাবে চুরমার করে এই করোনার নিদান? যত নিদানই আসুক রক্তজলের শস্য তোলা চাই। শস্য বাঁচাতে না পারলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। এ এক আদি বয়ান। কত রোশনাই কত ফিরিস্তি আসে যায়। কিন্তু এ বয়ান যেন শত ঝঞ্ঝা কী নিদানেও জাগিয়ে রাখে ভাটিবাংলার মেহনতের ফুল। আর তাই করোনার কালে বজ্রঝড়ে অঙ্গার হয়েও ভাটির মজুর ধান বাঁচাতে রয়েছে নির্ঘুম। এ ধান যে বাঁচাতেই হবে। দেশের ৩ ভাগের ১ ভাগ ভাতের থালা তো সাজাতে হবে। ভাটির কৃষকের এই বিবেক আর শিক্ষা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে দেয়নি। গড়েছে হাওরভাটির এক অনন্ত জীবনের ডাক। এই ডাকে নেশা লাগে হাছনের মনে, রাধারমণ কালা কাজলের পাখি ধরতে জলে নামে, শিতালংয়ের পিঞ্জরা থেকে উড়ে যায় সুয়া, করিমের নাও ঝিলমিলায়। এই ডাকের মায়া আছে বলেই করোনার কালেও হাওরে নামে কৃষক। কেবল নিজের খোরাকের জন্য নয়, বোরো মৌসুমের ২৫ ভাগ শস্যদানা দেশের গোলায় তুলবে বলে। কিন্তু নিদারুণভাবে এই করোনাকালেও ধান বেচে চাষের খরচ উঠছে না কৃষকের। নিদানের কালে ধানের মর্ম ধানের দাম নিয়ে এই অন্যায় রাজনীতি আজকের নয়, কিন্তু এই নিদানের কালে জীবনের বিনিময়ে বাঁচানো ধানের দাম নিয়েও কেন কৃষককে ভাবতে হবে? দুনিয়া যেখানে করোনার দুশ্চিন্তায় সেখানে হাওরের কৃষক ধানের দর নিয়ে তড়পায়। অন্য সময় না হয় এর রাজনীতি-দুর্নীতি নিয়ে বাহাস তোলা যায়, কিন্তু এই করোনাকালে কি এই তর্কের সময় আছে? লকডাউনের দুনিয়ায় যে কৃষক যাবতীয় ঝুঁকি নিয়ে আমাদের মুখের গ্রাস জোগাল, সেই জোগানের কোনো মর্ম কী আমরা এই সময়ে বুঝব না? একবার এই লকডাউনে এই প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের কাছে করা জরুরি। রাষ্ট্র, বহুজাতিক বাজার আর নয়াউদারবাদী বাহাদুরি এখানে টানছি না। চালের দাম দুই টাকা বাড়লেই আমাদের শহুরে মুখ ফেনিয়ে ওঠে। অথচ শহরের এক একটি পরিবারে দিনে চালের পেছনে কত টাকাইবা খরচা হয়? যত না খরচ হয় মোবাইল, পরিবহন কী বাহারি খানাদানায়। এই আমাদের মুখে কেন ধানের দাম নিয়ে কোনো কথা নেই? ধানের দাম বাড়লে চালের দামও বাড়বে এই অতি ছোট্ট সমীকরণে? এমন নির্দয় পাষাণ কলিজা নিয়ে আমরা কতদূর যাব জানি না, তবে করোনাকাল দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের কার কত বাহাদুরি আর মস্তানি। এক কৃষকই নির্ঘুম থেকে এখনো জোগান দিয়ে চলেছে আমাদের গ্রাস, অন্য কোনো মহাজন নয়। এক মণ ধানে কয়টা সাবান? করোনাকালে বারবার হাত ধুতে হচ্ছে। স্যানিটাইজার কি হ্যান্ডওয়াশ বাদ দিলাম, গ্রামের কৃষক যদি বাংলা সাবান দিয়েও হাত ধোয় তাহলে ৬০০ টাকায় এক মণ ধান বেচে কয়টা সাবান হয়? কৃষককে তো ফসল বেচেই সাবান কী মাস্ক কিনতে হবে। আর এই এক মণ ধান ফলাতে কত মেহনত লাগে তার হদিস কী রাখে এই বাজার? কেবল মেহনত নয়, কৃষি তো এক ঐতিহাসিক চলমান বিজ্ঞান। তাহলে এই বিজ্ঞান আর হেনতের মর্যাদা নেই কেন? বছর বছর কেন কৃষক মেহনতের ফসল বেচতে পারে না। দুধ ঢালে রাস্তায়, টমেটো ছুড়ে ফেলে, ধানের স্ত‚পে বসে ফোঁপায়। রাষ্ট্র কেন কৃষকের শস্য ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে কঠোর হয় না। গেল বছরগুলোতে এ নিয়ে কত তর্ক হলো। আগ্রাসী ফড়িয়া, দালাল আর মিল মালিকরা কম দামে জবরদস্তিতে কিনে নেয় কৃষকের ফসল। এই নির্দয় বাণিজ্য চাঙ্গা হয় বোরো মৌসুম আর কিছুটা আমনেও। কৃষকের চারধারে তখন আর কিছুই করার থাকে না। ধারদেনা করে আবাদ করা ফসল যে কোনো একটা দামে তাকে বেচতে হয়। কৃষকেরও তো এই মুদ্রানির্ভর দুনিয়ায় চলতে নগদ টাকার দরকার। এই কথা এর চেয়ে টাটকা উদাহরণসমেত সবাই জানে। গ্রামের মাতবর, ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ, বাজার কমিটি, কৃষিবিভাগ, মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্র, গণমাধ্যম কী সংগঠন। তাহলে দেশের সব কৃষকের সব ধান মৌসুমভিত্তিক একটি নির্দিষ্ট দামে বেচাবিক্রি করা কী খুব কঠিন কিছু? বহু বছরের তর্ক এখানে টানছি না, এই নিদারুণ করোনাকালে কৃষকের ধানের দাম নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। সরকার চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ১০৪০ টাকা দরে প্রতি মণ ধান কিনছে। সরকারি দামেই দেশের সব কৃষক বোরো মৌসুমের ধান বেচবে এই নিশ্চয়তাটুকু দরকার। এর জন্য হাজারটা কমিটি, তদারকি আর বিশেষজ্ঞের দরকার কী? যারা ধান কিনছেন তারাই তো এটি চালু ও চর্চা করতে পারেন। কেবল মানসিকতাটা বদলাতে হবে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বহমান ঔপনিবেশিক বাহাদুরিটা এই করোনাকালে না হয় ‘ক্ষেতের চাষার’ কাছে নতজানুই হলো। ধান ক্রয়ের সীমা বাড়াতে হবে আমরা যারা হাওরের মায়ার ডাকে বান্ধা পড়া ভাটির কৃষকের দানা খেয়ে বাঁচি, আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দশাসই সব ডিগ্রি নেই আমরা তলব করি না এই মজ্জা আর মাটিতে কত নিদানের দাগ। বছর বছর তল হয় জমিন, কেউ দেখে না। বজ্রপাতে অঙ্গার হয়ে যায় জীর্ণ শরীর, কে শোনে চিৎকার? এ বছর বীজের দাম তো আর বছর সারের দোকানে লম্বা লাইন। কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে সাজানো ভাতের থালায় কৃষকের এসব অমীমাংসিত নিদানের ভাপ কী ওঠে? আমাদের ভাতের থালায় কোনো হরতাল নেই, লকডাউন নেই। আমাদের মগজ যেন নিশ্চিত হয়ে আছে, বাজারে যাব আর চাল কিনতে পারব। কিন্তু কত উৎপাদন হলো, সরকার কতটুকু কিনল, কতটুকু আমদানি-রপ্তানি হলো, চাষ করতে গিয়ে কৃষকের কি দুর্ভোগ হলো এসব হিসাব কেন আমরা করব না? এটি জরুরি, কারণ খাদ্যের জন্য আমরা সরাসরি কৃষকের ওপর নির্ভরশীল। তো চলতি বোরো মৌসুমে ৬ লাখ টন ধান, সাড়ে ১১ লাখ টন আতপ ও সেদ্ধ চাল এবং ৭৫ হাজার টন গম কিনবে সরকার। কিন্তু বোরোতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ কোটি ৪ লাখ টন। সরকার ১০৪০ টাকা মণ দরে ৬ লাখ টন ধান কিনলেও বাদবাকি ধান সরকারি দরে কৃষক বেচতে পারছে না। আর সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকার কিনেও কম, এর আগের বোরো মৌসুমে কিনেছিল ৪ লাখ টন ধান ও ১৪ লাখ টন চাল। রাষ্ট্রের ধান ক্রয়ের সীমা ও পরিধি বাড়াতে হবে। সরাসরি কৃষকের জমি থেকে ধান কিনে মজুতের সমস্যা থাকলে স্থানীয় বিদ্যালয় বা বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ীভাবে ধান মজুত করতে পারে সরকার। গ্রামের গৃহস্থ বাড়ি বা কৃষকের গোলাঘর ভাড়া নিয়েও মজুত করা সম্ভব। পাভেল পার্থ : লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App