×

মুক্তচিন্তা

স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি ও সঠিক ব্যবহার সময়ের দাবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ মে ২০২০, ০৮:১২ পিএম

স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি ও সঠিক ব্যবহার সময়ের দাবি

ড. রুমানা হক ও মো. কাউসার আলম

বিশ্বব্যপী চলমান কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সকল দেশ এক কঠিন সমস্যা মোকাবেলা করছে। অদ্যবধি বিশ্বব্যাপি ২১২টি দেশ বা অঞ্চল এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ লাখ পেরিয়েছে। মৃত্যু হয়েছে তিনলাখের কাছাকাছি। এ কথা ঠিক কোভিড-১৯ একটি নতুন ভাইরাস যেটা নিয়ে বিশ্বব্যাপি বিশেষজ্ঞদের কোন প্রকার ধারণা ছিল না। তাই প্রায় সবাই শুরুতে এই ভাইরাস সংক্রামণকে উপেক্ষা করেছিল। এমন কি উন্নত বিশ্ব, যারা অনেক বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করে এবং আগাম ব্যবস্থা নেয়, তারাও প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাইরাসকে একইভাবে উপেক্ষা করেছে। তাই বর্তমানে কোভিড-১৯ ভাইরাস একটি বৈশ্বিক মহামারী রুপে আবির্ভূত হয়েছে।

এখানে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয়েছে যে, কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সামর্থ্যে বা প্রস্তুতির বিচারে অনেক উন্নত দেশ পরাস্ত হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকার মত উন্নত দেশে বিপুল পরিমান মানুষের মৃত্যু থেকে এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে যেখানে সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক দুর্বল সেখানে কিভাবে এই মহামারী মোকাবেলা করা যায় এবং এর বিস্তার থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায়।

এ ব্যপারে আমাদের সরকার অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে অতিদ্রুত অনেকগুলা প্রণোদনা ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে। যে প্রণোদনাগুলো ব্যবসা, আর্থিকখাত, কর্মসংস্থান, কৃষি উৎপাদন, দরিদ্র মানুষের খাবার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িত ডাক্তার এবং সকল কর্মীদের জন্য প্রণোদনা এবং স্বাস্থ্যবীমা খাতে ব্যয় হবে। এযাবৎ ঘোষিত প্রণোদনা প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা যা বাংলাদেশের জিডিপির তিন শতাংশের উপরে। এছাড়া সরকার ১০ টাকা কেজি চাল, ১ লক্ষ রেশন কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা করেছে। এ সকল ব্যবস্থাই তাৎক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদী ক্ষতি মোকাবেলার জন্য করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক ঝুঁকি হলেও সারা বিশ্ব এটাকে একই সাথে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক বিপর্যয়ী মহামারী হিসাবে দেখছে। কেননা এটার কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা একটা মানবিক বিপর্যয়ের রূপ নিতে পারে। যেহেতু পুরো বিষয়টি একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা কেন্দ্রিক সর্বাত্ত্বক সমস্যা, এ ধরনের বাস্তবতায় বাংলাদেশে আমাদের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ এবং সামর্থ্য বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত।

একথা ঠিক, গত এক দশকে আমাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসুচকগুলো অনেকাংশে উর্ধ্বমূখী এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০১৯-২০২০ সালে বাজেটের পরিমান মোট জাতীয় বাজেটের মাত্র ৪.৯২%, যা দক্ষিণ এশিয়ার যে কোন দেশের তুলনায় কম। বিগত দশ বছরে এ বরাদ্দ মোট জাতীয় বাজেটের ৪%-৬% মধ্যে রয়েছে যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হলো আমাদের মত দেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের বরাদ্দ হওয়া উচিৎ জাতীয় বাজেটের ১৫% মতো। অন্যদিকে, আমাদের স্বাস্থ্যখাতে সরকারের বাষির্ক ব্যয় মোট জিডিপির শতকরা এক ভাগের নিচে (০.৯%)। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের বন্টন নিয়ে যথাযথ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন এবং আগামী বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতাও বিবেচনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.৫% থেকে ২% এবং পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে তা ক্রমন্বয়ে বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তবে শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি করলে হবে না, বাজেটের যথাযথ ব্যবহার এবং সরকারী অর্থ ব্যবস্থাপনায় সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারী ও সেচছাসেবী সংগঠণের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ট্রাস্কফোর্স গঠণ করে ও প্রনোদণাসহ অর্থ ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধন্ত গ্রহণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

এ ধরনের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গঠন করা প্রয়োজন যাতে ঢাকার হাসপাতালগুলোর উপর চাপ কমানো সম্ভব হয়। প্রয়োজন মোতাবকে বাজটে বরাদ্দরে জন্য জেলাভত্তিকি পরকিল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সদ্ধিান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিন্যাসকে মূল্যায়ন করে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তাদের যথাযথভাবে ক্ষমতায়ন করা প্রয়োজন। আইডিসিআরকে আরও শক্তিশালী করতে হবে যাতে আগামী দিনগুলোতে সংক্রমন রোগ মোকাবলোয় র্সাবক্ষণকি প্রস্তুতি গ্রহণ করা যায়। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং তাদের বাজেট সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দিতে হবে।

কোভিড-১৯ মোকাবলিায় সরকার কিছু স্বল্পময়োদী র্কমপরকিল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে এ ধরনের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সার্বিক উন্নয়নে কি প্রয়োজন তার একটি যথাযথ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, যেখানে চলমান এই মহামারী থেকে নেওয়া শিক্ষাগুলো সঠিকভাবে অর্ন্তভুক্ত করতে হব। সার্বিক মূল্যায়নরে ভিত্তিতে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় বাজেটে বরাদ্দ এবং অবকাঠামো গঠন করা প্রয়োজন ও সরকার উন্নয়ন অংশীদারীর নিকট হতে যথাযথ পরকিল্পনার ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা চাইতে পারে।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিগত দিনগুলোতে বেসরকারী হাসপাতাল ও পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো বিশেষ ভূমিকা রেখেছে; যেটা একদিকে ভাল, জনগণ অধিকমূল্যে হলেও স্বাস্থ্যসবো পাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক যে র্দুযোগের সময় ব্যক্তিখাতের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য অবকাঠামো জনগণের অতিপ্রয়োজনে স্বাস্থ্য সেবায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে নাই। একথা বলা বাহুল্য যে আমাদের মত উন্নয়নশীল এবং জনবহুল দেশে যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা বিবেচনায় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে বাজটে বরাদ্ধ বৃদ্ধি এবং বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।সেই সাথে বেসরকারী হাসপাতাল ও পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোকে বিশেষ প্রয়োজনে কিভাবে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে যথাযথভাবে সংযুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে পরকিল্পনা গ্রহণ এবং নীতিমালা প্রস্তুত করা প্রয়োজন।

লেখক: ড. রুমানা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, আর্ক ফাউন্ডেশন এবং মো. কাউসার আলম, এফ সি এস, এফ সি এম এ, এফ সি সি এ, এ সি এ, পরামর্শক, আর্ক ফাউন্ডেশন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App