×

মুক্তচিন্তা

সঙ্গনিরোধ প্রকৃত বাস্তবতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ মে ২০২০, ০৯:৩৯ পিএম

বাংলাদেশে করোনার সামাজিক সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভারতের একাধিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, সামাজিক সংক্রমণ প্রতিরোধ করা কার্যত সম্ভব নয়। এটি আরো উদ্বেগজনক একটি বার্তা। উদ্বেগজনক যে তা ভারত ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সরকার ঘোষিত তথ্যাবলিই প্রমাণ করে। তাহলে কি করা? আর কেনই বা এহেন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হলো কীভাবেই বা সমস্যাটির হাত থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। এ বিষয়গুলো মানুষ ও দেশ বাঁচানোর স্বার্থেই অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে গভীরভাবে ভাবতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সবচাইতে বেশি জোর দিয়েছেন সঙ্গনিরোধের, যাকে বলা হয় Social distancing বা দৈহিক দূরত্ব। এই দূরত্ব বজায় না রাখার জন্য একটি সস্তা অভিযোগ আমরা করছি তরুণদের বিরুদ্ধে। কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছি তরুণদেরই। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখছি ওই তরুণরা, যারা অতি অল্প সংখ্যায়ই নিয়মবিধি না মেনে বাইরে ঘোরাফেরা করছে তাদের দ্বারা কতটা সংক্রমিত হচ্ছে? এ যাবৎকালের সংক্রমণের ইতিহাস (আমাদের বাংলাদেশকে নিয়ে যদি ভাবি) বলে যে, ব্যাপক সমাবেশ, বিদেশ থেকে আসা মানুষজন, করোনাক্রান্ত রোগী, তার চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী বা তাদের পরিবারের আক্রান্ত লোকজন এই সামাজিক সংক্রমণের ভয়াবহ পর্যায়ে দেশটাকে ঠেলে দিয়েছে। ইতোমধ্যে করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ২ জন চিকিৎসক প্রাণ হারালেন যার ফলে চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে জনগণও নতুন করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এ কারণে তরুণদের নিয়ন্ত্রণ করা, ঘরে রাখার পরিবেশ তৈরি করা নতুন গুরুত্ব অর্জন করেছে। এ ব্যাপারে আমরা প্রধানত দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করতে পারি। প্রথমত টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দিবারাত্র বিশ্বজোড়া করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রচার করে চলেছেন এবং তাতে তারা সফলতা অর্জন করলেও ২৪ ঘণ্টা প্রতিদিন একই খবর সর্বদা সব চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ায় প্রচণ্ড একঘেয়েমির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দর্শকদের মনে টেলিভিশনের খবরগুলো দেখার প্রতি আগ্রহ কমে আসছে। আগ্রহ কমে আসছে ধৈর্যশীল বয়স্ক দর্শকদের কাছেও কিন্তু আকর্ষণীয় বিকল্প মাধ্যম হাতের কাছে না পাওয়াতে বাধ্য হয়ে তারা চ্যানেলগুলো দিনভর ভর করে চলেছেন। কিন্তু তরুণ-তরুণীদের কাছে কি আমরা তেমন প্রত্যাশা করতে পারি? এ ব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিকরা ভালো বলতে পারবেন। তবে সাধারণ জ্ঞানে আমার মনে হয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেশ-বিদেশের খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে খবরের বিশ্লেষণ, বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি, বাংলাদেশ গৌরব অর্জন করেছে অতীতের এমন খেলাগুলো, নাটক, নৃত্য, কৌতুক প্রভৃতি দেখাতে পারেন এবং আমি নিশ্চিত, অনাগ্রহী তরুণদের একটি বড় অংশ এতে ঘরমুখী হতে আগ্রহী হবেন। দ্বিতীয়ত ভালো ভালো উপন্যাস, ইতিহাস, জীবনী ও ভ্রমণ কাহিনী সংবলিত বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করা। এটা কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও এ পথে আকৃষ্ট করার এখনই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ময়। তরুণ-তরুণীরা একবার যদি পঠন-পাঠনে আকৃষ্ট হন দেশেরও বহুবিধ মঙ্গল। তবে একটি অংশ, সংখ্যায় তারা অত্যন্ত ক্ষুদ্র, আজ মাদকাসক্ত হয়ে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে তাদের ফেরানো, ঘরমুখী করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে। এরা দুঃসাহসীও কারণ এদের সঙ্গে সমাজের নানা প্রভাবশালী মহলের সম্পর্ক রয়েছে এবং এই প্রভাবশালীরা প্রধানত সরকারি দলের। আমলাদের একাংশও এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই তরুণদের ঘরমুখী করা অত্যন্ত কঠিন তাদের পেছনে শক্তিশালী নানা মহলের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য মদদ থাকার কারণে। তবু সর্বাত্মক চেষ্টা, নরম-গরম আচরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদেরও ঘরমুখী করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। এক মুহূর্তও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা এবং সমগ্র বিশ্ববাসী আজ এক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি করোনা ভাইরাস নামক এক ভয়াবহ শত্রু র বিরুদ্ধে। চলমান সামাজিক দূরত্ব বা দৈহিক দূরত্ব ও ঘরমুখীনতার ব্যাপারে আমাদের তরুণ-তরুণীদের বিরুদ্ধে সমাজের প্রায় সব অংশের অন্তহীন অভিযোগের কারণে বিষয়টি নিয়ে এত দীর্ঘ আলোচনা করতে হলো। এবারে বিষয়টির অপরাপর দিক আলোচনা করা যাক। সর্বাধিক সংকট এখনো তৈরি করে রেখেছেন গার্মেন্টস মালিকরা। লাখ লাখ গরিব শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন দেননি নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভেঙে এবং সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে। এই মালিকদের তাবৎ অন্যায় এবং আইন ভঙ্গ করার দীর্ঘকালের অভ্যাস নিরোধের ক্ষেত্রে সরকারের বড্ড বেশি নিস্পৃহতা। ফলে ওই মালিকরা বেপরোয়া। অভুক্ত লাখ লাখ শ্রমিক তাই বাধ্য হচ্ছেন দিনের পর দিন বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে। এতে সঙ্গনিরোধ প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। আর তার অমোঘ পরিণতি স্বরূপ ওই শ্রমিকদের দেহে করোনা আক্রমণের আশঙ্কা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেদিকে নজর না আছে শ্রমিকদের না আছে সরকারের। নিদেনপক্ষে মালিকরা বা সরকার যদি ওই বিক্ষুব্ধ ও বুভুক্ষু গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাড়িতে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিতেন তাতেও এই সংকটজনক পরিস্থিতি হয়তো কিছুটা এড়ানো যেত। সরকার গার্মেন্টস শিল্প যাতে করোনাজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, ওই শিল্পের রপ্তানি বাজার যাতে ব্যাহত না হয় সেই লক্ষ্যে মাত্র শতকরা দুই ভাগ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করায় শ্রমিক ও জনগণের মনে স্বভাবতই একটি আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রণোদনার মূল লক্ষ্য ছিল, শ্রমিকদের বেতন যেন নিয়মিত দেয়া হয়। কিন্তু এই প্রণোদনাই কাল হয়ে দাঁড়ালো। মালিকরা ওই টাকা বিনাসুদে ছাড় দেয়ার দাবি তুলেছে। প্রচ্ছন্ন কথা হলো বিনাসুদে ওই প্রণোদনার টাকা ছাড় পেলেই কেবল শ্রমিকদের এই অহেতুক জিদের কাছে আত্মসমর্পণ করায় বিষয়টি সংকটে পরিণত হচ্ছে। বিক্ষোভে বিক্ষোভে, না চাইলেও, শ্রমিকরা করোনা ভাইরাসের আক্রমণের বাড়তি ঝুঁকিতে পড়বেন। ফলে সারাদেশে তার বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। গতকাল পর্যন্ত খবর এলো ২৩৯ জন বাংলাদেশে মারা গেছেন। জেলা থেকে জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে রোগ অতি দ্রুত। প্রতিরোধ প্রচেষ্টা দৃশ্যতই মুখ থুবড়ে পড়ছে। টেস্টিং কিটস আজো প্রতি জেলায় বসানো হয়নি। উপযুক্ত বা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থাও নেই অন্তত ৮০ ভাগ সরকারি হাসপাতালে। নিম্নমানের পিপিই, মাস্ক প্রভৃতি দুর্নীতিবাজ কন্ট্রাক্টরদের মাধ্যমে কিনে বা গোপনে তৈরি করে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের সরবরাহ করার অভিযোগও ব্যাপক। ফলে বহু ডাক্তার সেগুলো প্রত্যাখ্যান করছেন আবার যারা ব্যবহার করছেন তাদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন কোনো কোনো ডাক্তার করোনা সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। অপরদিকে বাংলাদেশে হাসপাতালের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কম থাকায় এবং শয্যা সংখ্যা প্রতিটি হাসপাতালেই রোগীর সংখ্যার অনুপাতে অত্যন্ত কম থাকায় হাসপাতালগুলোর ভেতরে-বাইরে প্রচণ্ড ভিড় থাকার কারণে সঙ্গনিরোধ বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত দুরূহ। তদুপরি প্রতিটি রোগীর খবর জানার জন্য স্বজনরাও বিপুল সংখ্যায় ভিড় করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও সঙ্গনিরোধের আহ্বান অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দেশজোড়া অসংখ্য কাঁচাবাজারে মানুষ যেভাবে গিজগিজ করে গ্রাহক-বিক্রেতা নির্বিশেষে সেগুলোতেও মানুষে মানুষে পরস্পর দূরত্ব সামান্যতমও বজায় রাখা সম্ভব না। গ্রামীণ হাটবাজারগুলোতে অবস্থা আরো মারাত্মক। অথচ চিকিৎসা শাস্ত্রের নির্দেশনাটা যথাযথভবে না মানলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। হাট-বাজার ব্যাপকভাবে প্রশস্ত করে না তুললে বা অন্ততপক্ষে কাঁচাবাজারগুলোকে জরুরিভিত্তিতে বিকেন্দ্রীকরণ করতে না পারলে সঙ্গনিরোধ বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান কাগজে কলমেই লেখা থাকবে। কিন্তু সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা কার্যকরভাবে গড়ে তোলা না গেলেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কিন্তু ঠেকে থাকছে না। তাই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে সঙ্গনিরোধ বা সামাজিক দূরত্ব অধিকতর নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করার বিকল্প নেই। এক. সব সেক্টরের শ্রমিকের বেতনভাতাদি মাসের ৫ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে পরিশোধ করতে হবে যাতে শ্রমিকদের আর রাস্তায় নামতে না হয়। কারখানা বন্ধ কি খোলা সে কারণে বেতনভাতা প্রদান বন্ধ রাখা যাবে না; দুই. সব শহরের কাঁচাবাজার দ্রুততার সঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে; পরিচ্ছন্ন ঢাকনা দিয়ে ভ্যানে করে শাক-সবজি মাছ প্রভৃতি পাড়ায় পাড়ায় বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে; তিন. কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং সেজন্য হিমাগারের (Cold-Storage) সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ করতে হবে; চার. ২০২০ সালের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা অব্যাহত রেখে কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থাও করা প্রয়োজন; পাঁচ. সব মন্দির, মসজিদ, গির্জা ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয় বর্তমান বছরের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে নিজ নিজ বাড়িতে উপাসনার ব্যবস্থা করতে হবে; ছয়. গৃহহীন সবার বাড়ি নিশ্চিত করার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সাত. সবার বাড়িতে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App