×

জাতীয়

চূড়া থেকে এখনো বহু দূরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২০, ০৯:৩২ এএম

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের দুই মাস পূর্বাভাস দেয়ার মতো নেই পর্যাপ্ত তথ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হলে বোঝা যাবে ভয়াবহতা
দেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে দুই মাস। কিন্তু পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না রোগতত্ত্ববিদসহ বিশিষ্টজনরা। তবে প্রতিদিন সরকারের পক্ষ থেকে আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে তা ঊর্ধ্বমুখী। দেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। চলতি মে মাসের প্রথম দিন থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত এই আট দিনে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পহেলা মে ৫ হাজার ৫৭৩ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫৭১ জনের, ২রা মে ৫ হাজার ৮২৭টির মধ্যে ৫৫২, ৩ মে ৫ হাজার ৩৬৮টির মধ্যে ৬৬৫, ৪ মে ৬ হাজার ২৬০টির মধ্যে ৬৮৮, ৫ মে ৫ হাজার ৭১১টির মধ্যে ৭৮৬, ৬ মে ৬ হাজার ২৪১টির মধ্যে ৭৯০, ৭ মে ৫ হাজার ৮৬৭টির মধ্যে ৭০৬ এবং গতকাল ৮ মে ৫ হাজার ৯৪১টির মধ্যে ৭০৯টি নমুনায় ভাইরাসের উপস্থিতি মিলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা ওঠানামা করলেও গত চার দিনে সাত শ’র বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তার চেয়েও যে বিষয়টি তাদের ভাবিয়ে তুলছে বলে তারা উল্লেখ করেন তা হলো- প্রতিদিন সংক্রমণের যে চিত্র সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তা বাংলাদেশে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র নয়। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অনেকের শরীরে ভাইরাস থাকলেও উপসর্গ থাকছে না। পরীক্ষার পর তারা ভাইরাসে সংক্রমিত বলে জানা যাচ্ছে। দেশের ৩৫টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু এখনো অনেকে পরীক্ষা করাতে পারছে না। কারণ সেই সুযোগ তাদের নেই। এরই মধ্যে সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসেরে গার্মেন্টস, কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট এবং সর্বশেষ মার্কেটগুলো খোলারও অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু সরকারের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না কোথাও। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। সীমিত পরিসরের কথা বলে তারা পুরোপুরিই চালু করছে প্রতিষ্ঠান। ঢাকায় অবাধে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ প্রবেশ করছে। তবে মার্কেটগুলো এই সময়ে না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ধারণা করছেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন পুরোপুরি সচল হবে এবং পরিবহন ব্যবস্থা যখন চালু হবে, তখন বোঝা যাবে সংক্রমণের ব্যাপকতা কতটা। এর আগে বিশ্বের করোনা আক্রান্ত দেশগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, ওই সব দেশে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে ৬০ দিনের মধ্যে তারা পিক টাইমে (সংক্রমণের চূড়ান্ত সময়) পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশেও করোনা কালের ৬০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। তাই মানুষের মনে প্রশ্ন বাংলাদেশ কি করোনা সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছে গেছে? এখন কি করোনার পিক টাইমে চলছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো প্রজেকশন করা হয়নি। একটা দেশের মধ্যে ডেমোগ্রাফি, স্বাস্থ্য সুবিধা এবং এপিডেমিওলজিক্যাল তথ্যের ভিত্তিতে একটা কার্ভ তৈরি করা হয়। যার মাধ্যমে জানা যায়, রোগের বা সংক্রমণের পিক টাইম কখন। কিন্তু বাংলাদেশে তা করা হয়নি। ফলে কোন সময় চূড়ায় পৌঁছবে, তা ধারণা করা মুশকিল। তারা মনে করছেন, চলতি মে মাসে সংক্রমণ চূড়ায় যাবে না। এটা আরো প্রলম্বিত হবে। তবে চলতি মাসটি হবে বাংলাদেশের জন্য ‘ক্রিটিক্যাল’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে করোনা ভাইরাসের মহামারি শেষ হওয়ার এখনো অনেকটা সময় বাকি। আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, গত কয়েক দিন ধরে সংক্রমণের সংখ্যা উঠানামা করছে। তবে তা সাত শ’র বেশি। এটা আমাদের ধারণা দিচ্ছে, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। আর জেলা বা বিভাগভিত্তিক আক্রান্তের সংখ্যার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ৮০ ভাগেরও বেশি সংক্রমিত হয়েছে ঢাকায়। যা ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। লকডাউন পুরোপুরি মানা হয়নি বলেই আজ এই অবস্থা। ফলে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দেশব্যাপী না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ কখন সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছবে তা বলা যাবে না বলে মনে করেন পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের সংক্রমণ ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। আমরা এখনো সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছাইনি। এরপর দেখতে হবে আমাদের সংক্রমণ কমার হার ও গতি। এর ওপর নির্ভর করবে কখন আমরা সম্ভাব্য করোনা মুক্ত হবো। লকডাউন শিথিল করার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার যে ছয়টি শর্ত রয়েছে তার প্রথমটিই হলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে এরকম নজির থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে তো তেমন পরিস্থিতি নেই। বরং সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছেই। সংক্রমণের হার না কমিয়েই সরকার লকডাউন শিথিল করতে চাইছে। এটি হলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। কেননা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি সচল হলে বোঝা যাবে সংক্রমণের ভয়াবহতা, যা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। এমনই উৎণ্ঠার সময়ে কিছুটা স্বস্তির খবর শুনিয়েছ সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এন্ড ডিজাইনের (এসইউটিডি) ডেটা প্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকরা। তারা আভাস দিয়েছেন, আগামী মে মাসের মধ্যে বাংলাদেশে এই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শেষ হবে। ১৯ মের মধ্যে ৯৭ শতাংশ এবং ৩০ মের মধ্যে ৯৯ শতাংশ বিলীন হয়ে যাবে এই ভাইরাস। তবে করোনা ভাইরাসের বিস্তারের ধরন, মানবদেহে এর ক্ষতিকর প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে ওই গবেষকরা বলছেন বাংলাদেশ থেকে ভাইরাসটির পুরোপুরি বিদায় নিতে সময় লাগতে পারে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। আর সারা বিশ্ব থেকে করোনা পুরোপুরি বিদায় নিতে পারে ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে। গবেষকরা এই গবেষণার কাজে সাসসিপটাবেল ইনফেক্টেপ রিকভারড (সার) মডেল ব্যবহার করেছেন। এ মডেল অনুযায়ী, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমার প্রমাণ মিলছে। গবেষকদের দাবি অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া তথ্যে ও করোনা ভাইরাসের জীবনচক্রের মেয়াদ সম্পর্কে প্রচুর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তারা। আমাদের দেশে এসইউটিডির এই গবেষণা কতটা কার্যকর এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ম্যাথমেটিকাল মডেলে করা। সফটওয়্যার নির্ভর। রিগ্রেসন মডেল। রিগ্রেশনের জন্য লিনিয়ার ডাটা বা কন্টিনিউয়াস রিপ্রেজেন্টেটিভ র‌্যান্ডম তথ্য লাগে। আমাদের তো তথ্যই নেই। প্রতিনিধিত্বশীল তথ্য-উপাত্ত ছাড়া এই ধরনের মডেলের ফলাফল খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোস্তাক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, রোগতত্ত্ববিদ্যায় তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পূর্বাভাস দেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এর জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত দরকার। অনুমান নির্ভর কোনো তথ্যের ভিত্তিতে মন্তব্য করা বা পূর্বাভাস দেবার সুযোগ নেই। এসইউটিডির গবেষণায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে সেটি করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত তারা কোথায় পেয়েছে তা আমার জানা নাই। তবে সত্য কথা হলো এই পূর্বাভাস দেয়ার মতো আমাদের এখানে এখনো যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত নেই। দেশে বর্তমান করোনা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে এ প্রসঙ্গে এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, আমাদের দেশে ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়ছে। সাধারণত চূড়া যেমন চৌকাকৃত হয় আমাদের দেশে তা অনেকটা গোলাকার। এক এলাকায় সংক্রমণের বিস্তার বেশি হচ্ছে না। সংক্রমণের ঢেউটা দ্রুতই অন্যত্র সরে যাচ্ছে। এতে হয়তো মহামারি বাড়বে না এবং এই সংক্রমণ থেকে মুক্ত হতে অনেকটা সময় লাগবে। তবে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়তো কম হবে। কিন্তু আমরা যদি গবেষণার পূর্বাভাসে আশান্বিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢিলেমি দেই তবে তা আমাদের জন্য বুমেরাং হবে। তখন হয়তো ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়ার পরিবর্তে আমেরিকরা ও ইটালির মতো হঠাৎ করে করোনা মহামারি বিস্ফোরিত হবে। তখন কিন্তু আমরা তা সামাল দিতে পারব না। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রোগত্ত্ববিদ ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় বলা হচ্ছে বিশ্বের অনান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি খুব ভালো। তারা কিসের ভিত্তিতে তা বলে আমার তা বোধ্যগম্য নয়। আমরা তো ভালো করে নমুনা পরীক্ষাই করতে পারলাম না। এই কয়েক হাজার নমুনা পরীক্ষা ও তার ফলাফল দিয়ে দেশের করোনা পরিস্থিতি কেমন তা বলা মুশকিল। প্রতিদিনই যখন সংক্রমণের ব্যাপকতা বাড়ছে তখন সরকার চাইছে লকডাউন শিথিল করতে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গিয়ে আত্মঘাতী এই সিদ্ধান্তে মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এই কর্মকর্তা আরো বলেন, এপ্রিল মাসে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, করোনা ভাইরাস সংকটে নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে ৬ এপ্রিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনীতিবিষয়ক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফএম গ্লোবাল ‘গ্লোবালরেজিলিয়েন্স ইনডেক্স-২০১৯’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার সামর্থ্যরে দিক থেকে ১৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৬তম। এছাড়া দেশে করোনা আক্রান্তদের সুস্থ হওয়ার হারও পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক কম। পরিস্থিতি যখন এমন তখন আমরা খুব শিগগিরই করোনা মুক্ত হবো- এমনটা কীভাবে ভাবছি? বরং সামনে আমাদের আরো কঠোর দিন অপেক্ষা করছে। সেই ভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App