×

মুক্তচিন্তা

করোনায় গুজব ও অপপ্রচার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২০, ০৫:৪৫ পিএম

ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম মহামারি আকারে বিস্তৃত করোনার বাংলাদেশে সংক্রমণকে সংখ্যার দিক থেকে এখনো অতি ভয়ঙ্কর হিসেবে দেখা যায় না। ১৬ কোটি মানুষের দেশে সুদীর্ঘ সময়জুড়ে এই পরিমাণ সংক্রমণ ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় বড় কিছু নয়। যদিও দিনে দিনে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে তবুও আক্রান্ত মানুষ বা মৃত্যুর হিসাব কোনোটাই আমেরিকা, ইতালি, স্পেন বা চীনের তুলনায় আতঙ্ক তৈরির মতো নয়। তবে করোনার বিস্তার বেড়েছে অনেক। দেশের প্রায় সব জেলাই এরই মাঝে আক্রান্ত। জেলা-উপজেলা, শহর, গ্রাম বা গলি এখন করোনায় আতঙ্কিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে পরিমাণ সতর্কতা গ্রহণ করা হয়েছে বা করোনাকে মোকাবিলা করার জন্য যত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাতে আতঙ্ক থাকার কোনো কারণ নেই। তবে সংক্রামক ব্যাধি বিধায় করোনার বিস্তার রোধে সতর্কতা বিধি মেনে চলা ও সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকা বা অন্যকে বাঁচানোর বিষয়টি কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মাঝে আছে। মানুষ সঙ্গনিরোধ ও সমাবেশ বন্ধ থাকা থেকে বিরত থাকছে না। বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে করোনাবিষয়ক সতর্কতা। দেশে দেশে সঙ্গনিরোধ, রুমবন্দি, সামাজিকতা বর্জন কেবল স্বেচ্ছাপ্রয়োগ নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী নিযুক্ত রয়েছে। বিশ্বটা যেহেতু ডিজিটাল সেহেতু সারা বিশ্বের মানুষই এখন দুনিয়ার এক প্রান্তের খবর অন্য প্রান্ত থেকে পাচ্ছে। যেমন করে ভালোটা ওরা জানতে পারছে তেমনি খারাপটাও তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এই ভালো-মন্দ তথ্যের মাঝে ভয়ঙ্করভাবে যুক্ত হচ্ছে ভুয়া তথ্য বা গুজব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাহন হয়ে ওঠেছে ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার মতো হওয়ায় এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তীব্রভাবে সতর্কও করতে হয়েছে। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই সত্য-মিথ্যা তথ্য জন্ম নিয়েছে এবং একদল মানুষ মিথ্যা তথ্য অপপ্রচার করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষ যখন গুহায় বা গুচ্ছভাবে গ্রামভিত্তিক বসবাস করত তখন সত্য বা মিথ্যা তথ্যের বিস্তারের পরিধিটাও সেই ভৌগোলিক সীমানাতেই সীমিত থাকতো। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটতে থাকায় এর বিস্তৃতি ব্যাপক হয়েছে। এখনকার দুনিয়াতে এই ভয়াবহ বিস্তৃতির নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই মাধ্যমগুলো যেমনি মানুষকে সহায়তা করে তেমনি এর অপূরণীয় ক্ষতি করার সক্ষমতা রয়েছে। দুনিয়ার অন্য কোথাও যাই থাকুক বাংলাদেশে এটি স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিরও হাতিয়ার। একে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস বা আতঙ্ক ছড়ানো ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জিং এজন্য যে কেবল দেশের ভেতরেই নয়, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমকে দেশের বাইরে থেকেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে মূল ধারার গণমাধ্যমের বাইরে ডিজিটাল প্লাটফরমকে ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক মিডিয়া লাইক ও বিজ্ঞাপন পাওয়ার আশায় গুজবের বাণিজ্য করছে। খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে এটি বোঝা যায় যে এসব গুজব বা অপপ্রচারের রাজনৈতিক চরিত্রও আছে। দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি শেখ হাসিনার সরকারকে হেয়-অক্ষম ও ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য করোনা ভাইরাস নিয়ে মিথ্যা-বানোয়াট ভিত্তিহীন ও মনগড়া তথ্য প্রচার করছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও এমপি থেকে মসজিদের ইমাম অবধি এসব গুজবের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। গুজবে তাদের মৃত বানানো হয়েছে। বিকৃত তথ্য, ছবি, কর্মকাণ্ডের ভুয়া তথ্য দেয়া হচ্ছে। এসব গুজব প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজে বারবার চেষ্টা করেও বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ার গুজব নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যার প্রভাব বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রবল তারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধকে মোটেই গ্রাহ্য করছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ফেসবুকের কাছে যত আবেদন করা হয় তার ১০-১৫ শতাংশও তারা রক্ষা করে না। করোনাবিষয়ক গুজব ও অপপ্রচার প্রতিরোধ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিটিআরসি যৌথভাবে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সম্পর্কিত গুজব ও অপপ্রচার রোধে গৃহীত কার্যক্রমের একটি সারসংক্ষেপ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো : করোনা ভাইরাস নিয়ে দুর্বৃত্তরা অনলাইনে বিভিন্ন ডোমেইনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক ও ইউটিউবে মিথ্যা তথ্যাদি, সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী গুজব ছড়িয়ে সাধারণ জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা হতে করোনা ভাইরাস সংক্রান্তে গুজব অপসারণের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে বিটিআরসি থেকে দ্রুততার সঙ্গে ফেসবুককে দাপ্তরিক ই-মেইল প্রেরণ করা হয় এবং মোবাইল ফোনেও সরাসরি ফেসবুককে অনুরোধ জানানো হয়। করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্যাদি ও গুজবের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট, পেইজ, লিংক এবং কন্টেন্টগুলো বন্ধ করার জন্য বিগত ২৩-০৩-২০২০ থেকে ০২-০৪-২০২০ তারিখ পর্যন্ত ১৩৪টি লিংক/কন্টেন্ট বন্ধকরণের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুককে ই-মেইলের মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হয়। ওই অনুরোধগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুক মাত্র ১৫টি লিংক/কন্টেন্ট অপসারণ করে। এরূপ জরুরি পরিস্থিতিতে ফেসবুককে বারবার অনুরোধ জানানো সত্তে¡ও ফেসবুক থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়ায় বিটিআরসি থেকে গত ০২-০৪-২০২০ তারিখে ফেসবুকের কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করে একটি ই-মেইল প্রদান করা হয় এবং প্রেরিত অনুরোধগুলো আমলে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। ই-মেইল প্রেরণের পরেও ফেসবুক হতে যথাযথ সহযোগিতা না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ০৯-০৪-২০২০ তারিখে ফেসবুককে আরেকটি ই-মেইল প্রেরণ করা হয়, যেখানে ফেসবুক থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়া গেলে বাংলাদেশে ফেসবুকের অপারেশনের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়। ওই ই-মেইলের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুক থেকে জানানো হয় যে, প্রাদুর্ভাবের ফলে সীমিত কর্মকর্তা কাজ করছে যা তাদের অফিস এবং পর্যালোচনামূলক কাজকে প্রভাবিত করেছে। তারা আরো জানায় যে, এ সংক্রান্তে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অতিসত্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রীকে অবহিত করবেন। পরবর্তীতে ফেসবুক থেকে গত ২০-০৪-২০২০ তারিখে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রীকে ই-মেইল প্রেরণ করা হয়, যেখানে বিটিআরসি থেকে ফেসবুকের কাছে প্রেরিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে কোনো প্রকার পর্যালোচনা করা হয়নি। ই-মেইলে তারা জানায় যে, ১৯-০৪-২০২০ তারিখ থেকে বাংলাদেশে ফেসবুকের তৃতীয় পক্ষের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ওই ই-মেইলের প্রত্যুত্তরে গত ০২-০৫-২০২০ তারিখে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী ফেসবুককে জানান যে, করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সম্পর্কিত গুজব ও অপপ্রচাররোধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসি থেকে গত ২৩-০৩-২০২০ তারিখ হতে ২০-০৪-২০২০ তারিখ পর্যন্ত ফেসবুককে ৪১৪টি লিংক অপসারণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়, তন্মধ্যে মাত্র ৬৮টি লিংক অপসারণ করা হয়। গত ০৯-০৪-২০২০ তারিখে বিটিআরসি থেকে ফেসবুককে পরিসংখ্যানগুলো জানানো হয় এবং এ সংক্রান্ত উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ফেসবুক বাংলাদেশে ‘ফ্যাক্ট-চেকিং’-এর জন্য এর কার্যক্রম শুরু করার পরেও দৃশ্যপট খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশে ফেসবুক কর্তৃক এর তৃতীয় পক্ষ পর্যালোচনা কার্যক্রম শুরু করার পর গত ১৯-০৪-২০২০ তারিখ থেকে ২৮-০৪-২০২০ তারিখ পর্যন্ত ৫১৩টি লিংক প্রেরণ করা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৮৮টি লিংক অপসারণ করা হয়েছে, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। বর্ণিত তথ্যানুযায়ী হতে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সরকারের অনুরোধ রক্ষার্থে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। সরকার থেকে প্রেরিত অভিযোগগুলো দ্রুততার সঙ্গে সমাধানের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যও ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩-০৩-২০২০ তারিখ হতে ৩০-০৪-২০২০ তারিখ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসসহ অন্যান্য গুজব ও অপপ্রচার প্রতিরোধে বিটিআরসি কর্তৃক ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর তথ্যাদি নিম্নরূপ : দৃশ্যত মনে হচ্ছে ফেসবুকের অনিচ্ছা ছাড়াও বাংলা বোঝা এবং রোমান হরফে বাংলা বোঝা নিয়ে তাদের সংকট আছে। বিষয়টি যা-ই হোক ক্ষতিটা যা হওয়ার তা আমাদের হচ্ছে। অবশ্য এমন গুজব নিয়ে সমস্যা এবারই প্রথম নয়। যতবারই আমরা কোনো সংকটের মুখোমুখি হই ততবারই ফেসবুকে গুজবের ডালপালা ছড়াতে থাকে। প্রশ্ন ফাঁস থেকে, নাসিরনগর, রুমা, সাইদী ও করোনা কোনটাকেই ওরা বাদ দেয়নি। ফেসবুকের ভাইস প্রেসিডেন্ট গ্যায় রোজেন নিজেই সিএনএনকে জানিয়েছেন যে, কেবল করোনা নিয়েই ফেসবুকে দুনিয়াজোড়া ৪ কোটি গুজব রয়েছে। এর পাশাপাশি ইউটিউবে ভুয়া ভিডিওর দাপটও রয়েছে। তবে টুইটারের কোনো প্রভাব এ দেশে নেই। তবে মানুষ যাকে তাকে করোনা আক্রান্ত বা যে কোনো মৃত্যুকে করোনার মৃত্যু বানানোর গুজব রটাচ্ছে। ফেসবুক ছাড়াও ইউটিউবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সেখানে কেবল করোনা নয় রাষ্ট্রবিরোধী ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে করা হচ্ছে। ওরা তো বিষয়টিকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App