×

জাতীয়

আপনার নরম মনটি সবাইকে স্পর্শ করেছিল...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২০, ১২:৩৫ এএম

আপনার নরম মনটি সবাইকে স্পর্শ করেছিল...

সাংবাদিক আসলাম রহমান

আপনার নরম মনটি সবাইকে স্পর্শ করেছিল...

আসলাম রহমান

সাংবাদিকরা এক একজন বিশেষ মানুষ। তাদের প্রত্যেকেরই বিশেষ গুণ থাকে। হয় কেউ ডানপিঠে মেধাবী, কেউ রাজপথ কাঁপিয়ে আসা নেতা, কেউ কবি বা লেখক, কেউ আবার সত্যানুসন্ধানী নিমগ্ন চিত্তের আত্মভোলা। আর এরাই একমঞ্চে এসে হয়ে উঠেন ‘পিপলস ভয়েস’। ‘আমি মানুষের কথা বলতে চাই’, ‘পুরাতন ভেঙে নতুন পৃথিবী গড়তে চাই’- এমনই নীরব স্লোগান বুকের ভেতরে তোলপাড় করে। এইসব বহুমুখী মেধাবীর সমন্বয়েই সাংবাদিকতার ক্ষেত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠে। যেদিন থেকে এমন মহৎ ধারণা নিয়ে সংবাদকর্মী হয়ে প্রতিক্ষণের সংবাদ-তথ্য-জ্ঞান বিপণন কার্যক্রমে (সাংবাদিকতার অনিশ্চিত জীবন!) যুক্ত হই সেদিন থেকেই মারাত্মক এক ‘বদঅভ্যাস’ আমাকে পেয়ে বসে। সুযোগ পেলেই কারো গোপন মেধার সন্ধান করার চেষ্টা করি। পরিচয় আর আলাপের ফাঁকে ফাঁকে পেশার বাইরে সাংবাদিকদের অন্যসব গুণাবলী উন্মোচন করে দেখি। জানি না, আমার এই ‘বদঅভ্যাসের’ কারণেই হোক কিংবা দু’জনেরই প্রবল অন্তর্মুখী স্বভাবের সমমাত্রার কারণেই হোক- খুব অল্প সময়েই গভীর উপলব্ধির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সহকর্মী আসলাম ভাইয়ের সঙ্গে। প্রথম আলাপেই তার ভেতরের অকৃত্রিম সৌন্দর্য আমাকে সিগনাল দেয়। সেই সঙ্গে মানুষটা যে অকৃত্রিম মন-মননের তাও বুঝে যাই। তার সঙ্গে বসে দুদণ্ড আলাপের সীমানা যে মানবিকতার চাদরে ঢেকে দেয়া যায় তা উপলব্ধি করেছি অনেকবার। ২. অতীতের সব কর্মক্ষেত্রের চেয়ে সর্বাধিক কৌতুহলের জায়গা আমার ভোরের কাগজ। বিশেষ করে দেশের অকুতোভয় জনপ্রিয় সাংবাদিক, সম্পাদক শ্যামল দা’র খুব কাছ থেকে কাজ করার প্রবল আগ্রহ ছিল। অবশেষে ভোরের কাগজ পরিবারের সদস্যও হয়ে যাই। তবে আমার সেই অন্তর্মুখী স্বভাব সব সময়ই আমাকে ঠেকিয়ে রাখে সবকিছুতে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ন্যায় আর আদর্শের জায়গাটায় সবচেয়ে কঠোর হওয়ার প্রয়োজনটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, তবে কোনো কিছুতে খুব বেশি কঠিন হওয়াটা আমার ধাতে নেই। মানুষের চেয়ে আইন আর নিয়মকে বড় করে দেখিনি কখনই। প্রতিটি মানুষই অপার সম্ভাবনাময়- শুধু পরিবেশ আর সুযোগের অভাবে কেউ কেউ চিরদিন অন্ধকারেই থেকে যায়। এই বিশ্বাসের কারণে মানুষের প্রতি ‘বাড়াবাড়ি’ রকমের ভদ্র আর বিনয়ী হয়ে উঠেছি হয়তো। কিন্তু কি আশ্চর্য! যেদিন আমার ক্ষুদ্র ঘেরা টপকে আসলাম ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডায় বসলাম সেদিনই সব অস্বস্তি কেটে গেল। মৃদুভাষী, বিনয়ী, অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষ আমাকে স্পর্শ করে গেল। তার আশ্চর্য নরম মনটি আমাকে মুহূর্তেই ছুঁয়ে গেল। এরপর ধীরে ধীরে তার অসাধারণ কিছু গুণবলী আমাকে অবাক করে দিলো। তিনি একজন কবি। তার ‘জ্যোস্নার শহরে একা’ কবিতার বইয়ের নামটি আমাকে চুম্বকের মতো টেনেছে।
শুধু কি তাই, তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং একজন সংগীতশিল্পীও। পরে ইউটিউবে খুঁজে তার গানের অ্যালবামের ‘যখনই আকাশ দেখবে, দেখবে তারারা ভাসছে’ গানটি কতবার যে শুনেছি তার হিসাব নেই। যতবারই শুনেছি ঘোরলাগা আবেশে মুগ্ধ হয়েছি।
আসলাম ভাই এক সময় বিনোদন সাংবাদিকতা করতেন। পরে অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথাই হতো। নিউজ লেখা নিয়ে যেমন আলাপ ভারী হতো তেমনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি তার বইপড়া কিংবা লেখালেখির কথাও বলতেন। আগামী বইমেলায় প্রকাশের জন্য স্ক্রিপ্টও লিখছিলেন। ৩. এত কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে থেকে আমি চুপসে যেতাম। তার ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করেছি অনেকবার। দেখতাম, তার চোখে মুখে কীসের যেন দ্বিধা-সংকোচের আবরণ। কখনও কখনও সেই আবরণের মাঝে দেখতাম হীনমন্যতার ছায়া। মনে হতো তিনি প্রতিনিয়ত নার্ভাসনেসে আক্রান্ত। ঠিক জানতাম না, কী কারণে তার চোখে-মুখে এই হীনমন্যতার ছায়া ভাসতো। তবে এটা জানতাম, মানুষের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সংশয়, সংকোচ সব সময়ই সৃজনশীলতার পরিপন্থী, যা একজন মানুষের সব শক্তিকে ধীরে ধীরে শুষে নিতে থাকে। এক সময়ের দারুণ মেধাবী কিংবা সম্ভাবনাময় মানুষ যখন পথ হারিয়ে কিংবা ভুল ট্র্যাকে এসে পড়ে তখনই এমনটা ঘটতে পারে। ভোরের কাগজ লাইভের কার্যক্রম শুরুর পর আমার রুটিনটাই বদলে গেল। গণমাধ্যমের নতুন এক ইতিহাসের পথে অগ্রযাত্রায় আমরাও থাকতে চাই। এমন স্বপ্ন নিয়ে দিনরাত ব্যস্ততায় ডুবে থাকতে হচ্ছিল। এর মধ্যে আসলাম ভাইয়ের সঙ্গে সেই টুকরো কবিতার মতো আড্ডাটা বন্ধই হয়ে গেল। একদিন খিলগাঁওয়ের পাশ থেকে স্পট লাইভে যুক্ত হয়েছিলেন আসলাম ভাই। আমি মুগ্ধ হলাম দারুণ। সেই সূত্রে বেশ আড্ডা হয়েছিল খানিকটা। তার মধ্যে দুর্দান্ত আগ্রহ দেখলাম। পরে সুন্দরবন থেকে ঘুরে এসে ভিডিও নিউজ। এরপর... ব্যস্ততার কারণে সেই আড্ডা আর হয়ে উঠেনি। আজ মনে হচ্ছে, কারো আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নেরা যখন মরে যেতে থাকে, তখন ব্যক্তি মানুষও নিঃশেষ হতে থাকে। আমাদের চারপাশের অনেক মেধা হয়তো এভাবেই ঝরে যায়। সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশায় এসে অন্যের জন্য রাতদিন আমাদের ভাবতে ভাবতে নিজের ভাবনার পরিধিই ক্ষুদ্র হতে থাকে। হয়তো, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনও তুচ্ছ, উপেক্ষিত হতে থাকে। আমাদের ভেতরে লালিত অপূর্ণ রঙিন ইচ্ছেরা বিবর্ণ হতে থাকে। আসলাম ভাইয়ের চোখে মুখে তাকালে ভীষণ কষ্ট হতো- কেন যেন মনে হতো নিজের ছবিটাই দেখছি। মনে মনে তাই আশা করতাম, সমস্ত দ্বিধা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তার আত্মবিশ্বাসের মাত্রাটা আরো বাড়ুক। ভাবতাম, সেই সুর আর ছন্দে তার জীবনটা আরো ভরে উঠুক। কিন্তু তার আগেই যে তিনি চলে যাবেন কে জানতো। লেখক: ইনচার্জ, ভোরের কাগজ লাইভ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App