×

মুক্তচিন্তা

ত্রাণ-অব্যবস্থাপনা বন্ধ করা সম্ভব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২০, ১০:৪৫ পিএম

করোনা নিয়ে সারা বিশ্ব এক অভিনব মহাযুদ্ধে নেমেছে। করোনা ভাইরাস বিশ^বাসীকে গৃহবন্দি করে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও ইউরোপ আমেরিকায় (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) আক্রান্তের সংখ্যা যেমন ভয়াবহ, মৃত্যুর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই মাত্র এক নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি, একান্তই ঘনিষ্ঠজন তার কথা হলো কী আতঙ্কে ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছে। দিনগুলো রাতগুলো একাকার। অপেক্ষা কবে, তার ভাষায় ‘এই গজব শেষ হবে।’ ইউরোপের অবস্থা ভিন্ন নয়। পশ্চিমা অঞ্চলে এই লড়াইয়ে কিছুটা মানবিক বোধের প্রকাশ ঘটছে। বাংলাদেশও সবে এই গজবের অংশীদার। সে চাইছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত পথ ধরে চলতে সারা দেশে সাধারণ অবরোধ ঘোষণা করে, যাতে মানুষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যায়। কাঁচাবাজার, মুদি দোকান ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ। স্বভাবতই একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, বলতে হয় অপরিহার্য, বাধ্যতামূলক বদ্ধাবস্থা। উপায় নেই। মানতেই হবে। ফলে বেশকিছু অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি প্রাত্যহিক আয়-ব্যয়ের নিবর্গীয় লোকদের জন্য। তাদের ভুখা সমস্যা মেটাতে সরকার ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা নিয়েছে। এটা মানবিক ত্রাণ, মানবিক চেতনার অপরিহার্য প্রকাশ। কিন্তু প্রাধানমন্ত্রীর বারংবার হুঁশিয়ারি, সতর্কবাণী, শাস্তির ভয় সংবলিত নির্দেশনা সত্তে¡ও ত্রাণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা সূচনালগ্ন থেকেই শুরু। ত্রাণ আত্মসাৎ কারা করছে যারা বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিরা এবং দলীয় পাতিনেতারা। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের এই অপরাধে জেল-জরিমানা হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্তে¡ও তারা বেপরোয়া। ভাবছিলাম একাধিকবার লেখার পর এ বিষয় নিয়ে আর লিখবো না। কিন্তু দুটো কারণে আবার লেখা। প্রথমত, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ কাছকাছি যাওয়ার পরও এর সংহারি থাবা নখদন্ত বিস্তার করে এগিয়ে চলেছে, আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। নতুন নতুন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মানুষ নিয়ম মানায় শতভাগ আন্তরিক নয়। নিয়ম না মানাই যেন নিয়ম।কাজেই করোনার আক্রমণের চরিত্র যথারীতি এখন ‘ঊর্ধ্বমুখী’, ইউরোপীয় পরিসংখ্যান এখন যদিও ক্রমশ নিম্নমুখী। এ অবস্থায় সাধারণ ছুটি, অবরোধের সীমা আরো বাড়বে, সন্দেহ নেই। মানবিক সমস্যা, জীবনধারণ সমস্যা বাড়তে থাকবে। নিম্নবর্গীয়দের অনাহারে মৃত্যু ঠেকাতে চাল-ডাল বিতরণে একাধিকমুখী ত্রাণ ব্যবস্থা চালু রাখাই নয়, এর বিস্তার ঘটাতে হবে। এ অবস্থা যদি ত্রাণ বিতরণের অব্যবস্থা নিয়ে সরকার বিধিবিধান নির্ধারণ না করে তাহলে ত্রাণ আর ত্রাণের সঠিক জায়গায় পৌঁছাবে না। তা মধ্যস্বত্বভোগী তথা জনপ্রতিনিধি ও নেতাদেরই ভোগে লাগবে। বেশকিছু সংবাদ তেমন আলামতেরই প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এত কঠোর সতর্কবাণী, এত কঠিন নির্দেশনা তারপরও ‘অসাধু না শোনে সাধুবচন’। বাংলাদেশের মানবিক প্রকৃতির পাশাপাশি ব্যবসায়ীকুলের এবং দুর্ভাগ্যজনকভবে জনপ্রতিনিধিদেরও মানববিরোধী দুর্নীতিবাজ চরিত্র কিছুতেই সংশোধনের পথ ধরছে না। দুই. ভাবা যায়, করোনা আক্রমণের প্রভাবে অভুক্ত মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বরাদ্দ ত্রাণের চাল প্রধানমন্ত্রীর এত হুঁশিয়ারির পরও আত্মসাৎ করতে বিবেকে বাধছে না জনপ্রতিনিধিদের, রাজনৈতিক নেতাদের। আমরা ইতোপূর্বে লিখেছিলাম কঠোর শাস্তি বিনা এরা শায়েস্তা হবে না, দরকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, যা দেখে অন্যরা তাদের কালো হাত গুটিয়ে নেবে। কিন্তু সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি সরকার। এ ক্ষেত্রে দরকার ছিল বিতরণ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, খোলনলচে বদল। দায়িত্ব বণ্টনে গঠন করা দরকার ছিল বহুদলীয় হিসাব-নিকাশে বাছাই করা কমিটি যারা স্বজনপ্রীতি, অনুরাগ-বিরাগে প্রভাবিত না হয়ে প্রকৃত অভাবী, ভুখা মানুষের হাতে ত্রাণ, বিশেষ করে চাল-ডাল তুলে দেবে। মুজতদারি কালোবাজারিতে সিদ্ধহস্ত জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতির প্রকাশ ঘটাতে দেবে না। তেমন কোনো সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা আমরা জানি না। তবে চাল বিতরণের আলামত ও পরিণাম দেখে মনে হয় একাধিক তেলামাথায় তেল ঢালা হচ্ছে, অন্যদিকে নিজের থলে বা গুদাম ভর্তি করা হচ্ছে বাকিটা ভুখাদের হাতে যাচ্ছে। আত্মসাৎ ও বিতরণের পরিসংখ্যান সম্ভবত কারোরই জানা নেই। যেমন জানা নেই স্বজন ও অস্বজনদের প্রাপ্তির অনুপাত। কিন্তু সংবাদপত্রের কিছু খবর আমাদের যা জানায় তাই অবস্থা বোঝার পক্ষে যথেষ্ট। এই কলাম-নিবন্ধটি যখন লিখছি, সেদিনের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথাম পাতায় মোটা হরফে লিড নিউজ : ‘ত্রাণ কেউ পায় বারবার/কেউ পায় না একবারও’। ‘ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা প্রকট/দলীয় বিবেচনা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ’। প্রতিবেদনটি বিশদ বিবরণে যে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে তা সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধির থেকে বেশ কিছুটা দূরে। এক কথায় ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য এমন অনেকেই ত্রাণ পাচ্ছেন না তালিকায় নাম নেই বলে। প্রশ্ন উঠবে তালিকা করছেন কারা, কিসের ভিত্তিতে। বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত মানুষের, নাকি কোনো এক সময়ের করা পুরনো তালিকা যা বাস্তবধর্মী নয়, তাতে বর্তমানের অর্থ ও খাদ্য সমস্যায় পীরিতদের অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত নেই। এমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। ত্রাণ বিতরণকারীদের দাবি, এলাকা বা ওয়ার্ডের দুস্থ বা গরিবরা ঠিকই ত্রাণ পাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ এ প্রতিবেদন তুলে ধরা সম্ভব নয় বলে আমরা এর কয়েকটি বাক্য তুলে ধরছি। তার আগে বলে নেই অনেক দুস্থ ত্রাণ পেয়েছে। কিন্তু অনেকে পায়নি। সাঈদ খোকনের যুক্তি, ত্রাণের তুলনায় দুস্থের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই তাদের কেউ হয়তো ত্রাণ পায়নি। প্রতিবেদকের মতে, ‘সমন্বয় করে ত্রাণ বিতরণ করা গেলে অনেক দুস্থ, অসহায় পরিবার কিছু হলেও ত্রাণ সহায়তা পেত। এ ওয়ার্ডে অনেক দুস্থ পরিবার একবারও সরকারি বা বেসরকারি ত্রাণ পায়নি। তবে সড়কের পাশে অনেকে চারবার থেকে পাঁচবার পর্যন্ত ত্রাণ পেয়েছে’। একে অব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কী বলা চলে। অনেকেই একাধিকবার লিখেছেন, ত্রাণ বিতরণে দল নির্বিচারে সমন্বিত প্রচেষ্টায় ত্রাণ বিতরণের কথা, যাতে ত্রাণ যথাসম্ভব সুষ্ঠুভাবে বিতরিত হয়। এসব সুপরামর্শ কারো কানে ওঠেনি। তিন. ত্রাণ যদি দাবি অনুযায়ী সুষ্ঠুভাবে বিতরণই করা হবে তাহলে প্রথমত প্রধানমন্ত্রীকে এতবার ত্রাণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে হতো না। দ্বিতীয়ত, এতজনকে ত্রাণে দুর্নীতির দায়ে জেল-জরিমানা ভোগ করতে হতো না। তবে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে করোনামারিতে নিম্নবর্গীয় দুর্ভোগের মুখেও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। কিছু কথিত ব্যবস্থা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে সমাজবিরোধীর যতসব অপকর্ম। প্রমাণ হাতের সামনেই। যেখানে দরকার সমন্বিত উদ্যোগে দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো, সেখানে জামালপুর-ইসলামপুরেও দেখা যাচ্ছে ত্রাণের চাল আত্মসাৎ : প্রশাসনের চেষ্টায় বিভিন্ন স্থান থেকে ‘ত্রাণ-ভিজিডির ৬১৯ বস্তা জব্দ’ (২১.০৪.২০২০)। একই দিনের অন্য একটি দৈনিকে আরো ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ : ‘তিন জেলায় ২ হাজার কেজি সরকারি চাল জব্দ, আটক দুই’। জেলাগুলো হচ্ছে পূর্বোক্ত জামালপুর এবং সিরাজগঞ্জ ও পটুয়াখালি। এসব জেলার বিভিন্ন স্থানে চলছে চাল নিয়ে চালবাজি, দুস্থ মানুষকে অনাহারে রেখে যে যেমন পারে নিজস্বার্থ উদ্ধার করে নিচ্ছে। এতে বিচিত্র চরিত্রের সমাহার সাংসদ, প্রান্তিক জনপ্রতিনিধি, মুনাফাবাজ ডিলার এবং অনুরূপ অনেকে। অনুরূপ একাধিক খবর বিভিন্ন পত্রিকায়। দুদিন আগে একটি দৈনিকের খবর ছিল ‘১৪১ বস্তা চাল উদ্ধার’। এতে বলা হয়েছে : ‘রাজশাহীতে চাল উদ্ধার করা ঘটনার মামলায় আওয়ামী লীগের নেতা কারাগারে’। এবারো আমরা বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না। শুধু লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছি, মর্মবেদনা অনুভব করছি এই ভেবে যে, যখন সারাদেশে করোনা আক্রমণে মানুষ চরম দুর্দশায় ভুগছে তখন এক শ্রেণির উঁচু পর্যায়ের লোকের কী অমানবিক কীর্তিকলাপ! অবশ্য প্রশাসন চেষ্টা চালাচ্ছে, এটাই কিছুটা সান্ত্বনা। কিন্তু মূল জায়গায় হাত পড়ছে না। তাই বন্ধ হচ্ছে না দুর্নীতির বিস্তার। ত্রাণ বিতরণে দরকার শক্তিশালী সর্বদলীয় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা একচেটিয়া, একপেশে, একদলীয় ব্যবস্থাপনা নয়। সর্বোপরি দরকার ত্রাণ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। না হলে কিছু সংখ্যক মানুষ ভুখাই থেকে যাবে, হয়তোবা মৃত্যুবরণও করবে উল্লিখিত দুর্নীতির পরিণামে, যা প্রতিরোধযোগ্য। আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App