×

রাজধানী

নমুনা সংগ্রহে ভুল রিপোর্ট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২০, ০৯:৩৭ এএম

নমুনা সংগ্রহে ভুল রিপোর্ট

করোনাভাইরাস।

জনবল সংকট ও অদক্ষ হাতে নমুনা সংগ্রহে সময়ও লাগছে বেশি দেড় লাখের মধ্যে আছে মাত্র ৫ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট

করোনা উপসর্গ থাকায় মিরপুরের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন কুর্মিটোলা হাসপাতালে নমুনা জমা দিয়েছিলেন গত শনিবার। গতকাল মঙ্গলবারও তিনি রিপোর্ট হাতে পাননি। বিল্লাল হোসেন জানান, বৃদ্ধ মা, দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে দুই রুমের ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। করোনা উপসর্গ দেখা দেয়ার পর থেকে তিনি এক রুমে নিজেকে বন্দি রেখেছেন। কিন্তু ছোট ফ্ল্যাট বাড়িতে দীর্ঘদিন এই অবস্থায় থাকা খুবই কষ্টের। তিনি বলেন, পরিবারের সবার সুরক্ষার বিষয়টি ভেবে চার দিন আগে নমুনা দিয়েছিলাম। কিন্তু রিপোর্টতো এখনো পেলাম না। বসবাসরত এলাকায় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর মানিকনগরের বাসিন্দা ইয়াসমিন বেগমের মধ্যে দেখা দেয় করোনার উপসর্গ। তাই ছেলেকে নিয়ে মুগদা হাসপাতালে এসে রবিবার নমুনা দিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু রিপোর্ট এখনো পর্যন্ত পাননি।

বিল্লাল হোসেন ও ইয়াসমিন বেগমের মতো এমন অভিযোগ অসংখ্য মানুষের। কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা দেয়া থেকে শুরু করে রিপোর্ট প্রাপ্তি এই প্রক্রিয়ায় মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ অপেক্ষা আর নানা ভোগান্তি। রিপোর্ট যদিও পাওয়া যায় তাতেও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ রিপোর্টের মধ্যেও রয়েছে ভুল। পজিটিভ রিপোর্ট নেগেটিভ, আবার নেগেটিভ রিপোর্ট পজিটিভ হচ্ছে। নমুনা প্রদানকারী ব্যক্তিকে ফোনে রিপোর্ট পজিটিভ জানানো হলেও কাগজে তা নেগেটিভ লেখা। আবার এমনো অভিযোগ আছে, রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে তা নাকি জানানোই হচ্ছে না। ফলে নমুনা দিয়ে বা রিপোর্ট পেয়ে স্বস্তি পাচ্ছেন না অনেকেই। আবার করোনা আক্রান্ত নন এমন সার্টিফিকেট ছাড়া সাধারণ রোগীদের সেবা মিলছে না সাধারণ হাসপাতালগুলোতে। পরপর দুই বারের নমুনা পরীক্ষায় করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি না পাওয়া গেলেও গত এপ্রিল মাসে এক ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যুর পর তার নমুনায় ওই ভাইরাসের উপস্থিতি মিলেছে। এরপর থেকেই সামনে আসে করোনার নমুনা পরীক্ষায় ভুল রিপোর্টের বিষয়টি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নমুনা পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল আসার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় জড়িত। যেমন নমুনাটি কখন, অর্থাৎ ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দুই দিন এবং সপ্তম দিনের পর নমুনা নিলে সেক্ষেত্রে ফলাফল অনেক ক্ষেত্রে ভুল আসতে পারে। এক্ষেত্রে শর্ত আছে, যাদের বয়স ৫০ বছর বা অন্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে তাদের দেহে ভাইরাসটি দীর্ঘদিন থাকতে পারে। কোথা থেকে অর্থাৎ ফুসফুসের পানি, লালা, কফ বা নাক থেকে যে নমুনা নেয়া হয় তার ওপরও ফলাফল নির্ভর করে। ফুসফুসের পানি থেকে নমুনা নেয়া হলে সেক্ষেত্রে ৯৪%, মুখের লালা থেকে নেয়া হলে ৪২%, কফ থেকে

নেয়া হলে ৬২%, নাক থেকে যে নমুনা নেয়া হয় সেখান থেকে নেয়া হলে ৭২% সঠিক ফলাফল আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া নমুনা সংগ্রহের পর তা সঠিক তাপমাত্রায় রাখা হয়েছিল কি না, পরীক্ষার ফলাফল সঠিকভাবে নিবন্ধন করা হয়েছে কি না সেই বিষয়টির উপরও নমুনা পরীক্ষার সঠিক ফলাফল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে রিপোর্ট প্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী করছে জনবল সংকটকে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আনতে হচ্ছে। যার জন্য ২৪ থেকে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগছে বলে বলা হচ্ছে। জানা যায়, হাইকোর্টের মামলা ও দ্বন্দ্বের কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১১ বছর ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে নিয়োগই বন্ধ। করোনা মোকাবেলায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ল্যাব স্থাপন করা হলেও সেখানে দেয়া সম্ভব হয়নি দক্ষ জনবল। কাজ চালানোর জন্য, মাত্র একদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাময়িক কিছু লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্তকর্তা জানান, অদক্ষ হাতে নমুনা সংগ্রহ করায় দেশের বিভিন্ন ল্যাবে করোনা পরীক্ষার রিপোট ভুল আসছে। এমনও ল্যাব আছে তাদের নমুনা পুনরায় পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে শুধু লক্ষাধিক টাকার কিট নষ্ট হয়েছে তাই নয়, নষ্ট হয়েছে অনেক কর্মঘণ্টা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নমুনা পরীক্ষার মানে প্রতিদিন কত নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, কতজন আক্রান্ত হয়েছে এই সংখ্যার হিসাব রাখাই নয়। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা, পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে। রিপোর্ট পেতে যদি এত দীর্ঘ সময় লেগে যায় তাহলে তা চিকিৎসা ও আইসোলেশনের কাজে লাগবে না। ২৪ থেকে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল না দিতে পারলে এর ফলাফল হবে ভয়াবহ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, যেখানে প্রতি চিকিৎসকের বিপরীতে ৫ জন করে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা উচিত। সেই হিসেবে দেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন। অথচ সর্বসাকুল্যে আছে মাত্র ৫ হাজার ১৬৫ জন। এরমধ্যে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) রয়েছেন ২ হাজার ১৮২টি। যা দিয়ে করোনা পরিস্থিতির মতো ভয়াবহ সময় পার করা প্রায় অসম্ভব।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন জানান, নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে ল্যাবে পরীক্ষা করা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। এর জন্য দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দরকার। তাদের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করালে ফল পাওয়া যাবে না। দেশে এমনিতেই টেকনোলজিস্টের সংকট রয়েছে। তারপর বর্তমান যে পরিস্থতি সেক্ষেত্রে এই সংকট আরো বেশি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মো সেলিম মোল্লা সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জনস্বার্থে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা প্রায় ১৫ হাজার বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্টকে (ল্যাবরেটরি) এ কাজে নিযুক্ত করলে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সহজ হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. বেলাল হোসেন জানান, বর্তমানে সারাদেশে ৩৩টি ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও টেকনিশিয়ান না থাকায় সেই নমুনা সংগ্রহে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও টেকনিশিয়ানের ৫ হাজার ৮২৪টি পদ সৃষ্টির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। এখন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App