×

জাতীয়

ঢাকা-লন্ডন টানাপোড়েন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২০, ০৯:৪৫ এএম

ঢাকা-লন্ডন টানাপোড়েন
কয়েকটি ইস্যুতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে বাংলাদেশের। দুদেশের সম্পর্কে এতই শীতল অবস্থায় রয়েছে, যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়নি ব্রিটিশ উড়োজাহাজ। পরে ঢাকা থেকে বিশেষ ফ্লাইটের মাধ্যমে সেখানে অবস্থানরত নিজ নাগরিকদের ফেরত আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। অবশ্য এই টানাপোড়েন সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকারকে সেখানকার জনসাধারণের জন্য সবজি, ওষুধ সামগ্রী, পিপিইসহ চিকিৎসা উপকরণ পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি রোহিঙ্গা নিয়ে মন্তব্য এবং রোহিঙ্গা নাগরিকদের চিকিৎসা দিতে ৬৩ জনের ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলকে বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়ায় সম্পর্কের এই অবনতি শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে ৬৩ জনের একটি তালিকা দিয়ে বলেছিল, এদের বাংলাদেশে আনতে হবে। এই ৬৩ জন বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সহায়তা দেবে। এর জবাবে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের কাছে সেই ৬৩ জনের তালিকা চেয়ে বলেছে, যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। যাচাই-বাছাই শেষে দেখা যায়, ওই দলে মাত্র ১৯ জন চিকিৎসক এবং তাদের সহকারী। এরপরই বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যকে বলে দেয়, ১৯ জন বাদে অন্য কাউকে আমরা বাংলাদেশে ঢুকতে দেব না। মূলত এখান থেকেই জটিলতা শুরু। এর আগে সাগরে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার জন্য যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড আহমেদ ফোনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে অনুরোধ করেন। এর জবাবে ড. মোমেন যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রীকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং সীমিত সম্পদ থাকা সত্তে¡ও মানবিকতার পরিচয় দিয়ে ইতোমধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সমুদ্রে নৌকায় ভাসমান ৫০০ রোহিঙ্গা সে তুলনায় অতি সামান্য। তারা এখন বাংলাদেশ সীমানায় নেই। মানবিক কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অনুরোধ করা হলেও এ এলাকার অন্যান্য দেশকে তাদের আশ্রয় দিতে বলা হয়নি। যুক্তরাজ্যের রয়েল জাহাজ এসেও তাদের উদ্ধার করে আশ্রয় দিতে পারে বলে যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রীকে বলেন ড. মোমেন। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা নিয়ে এভাবে এই প্রথম কোনো শক্ত জবাব দিলেন বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সাগরে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এখন কী করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে গত শনিবার রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ভোরের কাগজকে বলেন, কী করব মানে, ওদের একটি অংশ তো চুরি করে বাংলাদেশে ঢুকে গেছে। বাকিরাও হয়তো ঢুকে যাবে। কীভাবে ঢুকেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে একটা চালাকি হয়েছে। কোস্ট গার্ড বলেছে তারা রোহিঙ্গাদের দেখতে পায়নি। তারা জাহাজ থেকে পালিয়ে ছোট নৌকা দিয়ে পানিতে ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশে ঢুকে গেছে। কোস্ট গার্ড দেখতে পাবে না, এটা তো হয় না। পাবলিক দেখে আমাদের বলেছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ঢুকাতে ওখানে কিছু দালাল আছে। এই দালালরা পয়সা পায়। কিন্তু পয়সাটা কে দেয় সেটা নিয়েই বড় দুশ্চিন্তা। এত পয়সা না হলে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এত দামি গাড়ি চলে কীভাবে? কারা চালায় এসব গাড়ি? রোহিঙ্গাদের ঢুকাতে কারা পয়সা দেয় কোনো তদন্ত হয়েছে কিনা এর জবাবে তিনি বলেন, না, এখনও এ বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। তবে আমরা আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠনের দিকে সন্দেহ করছি। কারণ আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, তারাই দালালদের মাধ্যমে পয়সাটা দেয়। এখানে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশও জড়িত থাকতে পারে। যুক্তরাজ্য জড়িত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই যুক্তরাজ্যই তো আমাদের হাতে ৬৩ জনের তালিকা ধরিয়ে বলেছিল রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য তাদের বাংলাদেশে আনতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যাচাই করে দেখে মাত্র ১৯ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। বাকিরা এমনিতেই আসতে চান। এ কারণে বাংলাদেশ তাদের ঢুকতে দেয়নি। এদের বাংলাদেশে ঢুকানোর জন্য ব্রিটিশ হাইকমিশন ব্যাপক তদবির শুরু করেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য। আমরা যুক্তরাজ্যকে বললাম, তোমাদের যে ফ্লাইটগুলো বাংলাদেশ থেকে যাত্রী নিয়ে লন্ডন যাচ্ছে। আবার লন্ডন থেকে ফ্লাইটগুলো বাংলাদেশে ফিরে আসছে। ফিরে আসার সময় লন্ডন থেকে আমাদের কিছু যাত্রী আছে নিয়ে আসো। এর জবাবে তারা বলল, আমরা তোমাদের যাত্রী আনতে পারব, যদি আমাদের ৬৩ জনকে আনার অনুমতি দাও। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি কোনো শর্তে রাজি হব না। তোমাদের ফ্লাইটগুলো খালি আসছে, আমরা উপযুক্ত খরচ দেব। তোমরা আমাদের যাত্রীকে নিয়ে আসবে। আমরা তোমাদের সবজি, ওষুধ সামগ্রী, চিকিৎসা উপকরণ, পিপিই পাঠাব, তবু তারা রাজি হয়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা যুক্তরাজ্যে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফেরাতে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছি। তখন এসে ওরা বলছে, তোমাদের যাত্রী কারা আসতে চায় বলো, আমরা নিয়ে আসব। ড. মোমেন তখন যুক্তরাজ্যকে বললেন, এখন তো আর হবে না। আমরা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এই হচ্ছে যুক্তরাজ্য। আর তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক! রোহিঙ্গাদের একটি ছোট দলকে ভাসান চরে পাঠানো হয়েছে : নৌকায় করে কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ঢুকে যাওয়া ছোট একদল রোহিঙ্গাকে ভাসান চর পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে ভালো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিবিরগুলোতে থাকা কোনো রোহিঙ্গার এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়নি। ড. মোমেন জানান, স¤প্রতি মিয়ানমার থেকে ছোট নৌকায় করে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের খোঁজ পান স্থানীয়রা। পরে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড খবর পেয়ে ওই রোহিঙ্গাদের আটক করে। এভাবে আটক কমপক্ষে ৭০ রোহিঙ্গাকে জাহাজে করে ভাসান চরে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান ড. মোমেন। এই রোহিঙ্গারা দুটি নৌকা থেকে এসেছেন, যারা কয়েক সপ্তাহ ধরে গভীর সমুদ্রে ভাসছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আর জায়গা দেয়া সম্ভব নয়। এ কারণে যারা শনিবার এসেছে, তাদের ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে আর এটাই হবে রোহিঙ্গাদের প্রথম কোনো দল, যাদের ভাসানচরে পাঠানো হচ্ছে। নড়েচড়ে বসেছে ইইউ, ঢাকাকে ফলো করতে বললেন দূত : সাগরে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জনিয়েছে ইইউ। করোনা আতঙ্কে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্য রাখাইন ত্যাগী ওই রোহিঙ্গারা সাগরে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বোরেল এবং কমিশনার জানেস লেনারিচ স্বাক্ষরিত যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, অব্যাহতভাবে উদারতা ও মানবতা দেখিয়ে বাংলাদেশ ২৬ এপ্রিল চার শতাধিক রোহিঙ্গাকে নিরাপদে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা আশা করব, এ অঞ্চলের দেশগুলো এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। ভাসমান রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশলেতে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানান। পরে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড আহমদ টেলিফোনে একই অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। জবাবে মন্ত্রী মোমেন ভাসমান রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে ব্রিটিশ রয়েল নেভি শিপ পাঠানোর পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, রাখাইনে মিলিটারি অপারেশন চলছে অথচ ইইউ সেখানে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, ইইউর ওই সমালোচনার কারণেই টনক নড়েছে। ব্রাসেলস নড়েচড়ে বসেছে। সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই বলেন, দুটি নৌকায় থাকা ৫০০ রোহিঙ্গা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানে ভাসছে। এদের গ্রহণ করার কোনো দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের নেই। তাদের সাহায্যের জন্য অন্য দেশও এগিয়ে আসতে পারে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এ অঞ্চলে তো মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারতসহ আরো অনেক দেশ আছে। তাদের তো বলা হয় না। শুধু বাংলাদেশের কাছে এদের নেয়ার অনুরোধ আসে কেন? করোনায় যুক্তরাজ্যে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফেরাতে বিশেষ ফ্লাইট : বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) জনিত পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যে যেসব বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছে সরকার। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ বিমানের একটি চার্টার্ড ফ্লাইট আগামী ১০ মে ঢাকা থেকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছাবে। সেদিনই ফ্লাইটটি দেশে ফিরে আসবে। বিমানের এই ফ্লাইটের ভাড়া বহন ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে বাংলাদেশ এয়ারফোর্স ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট (বিএএফডব্লিউটি)। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আসন ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে অর্থাৎ আসন পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ক্রমানুযায়ী নিবন্ধিতরা এই সুযোগ পাবেন। ‘আগে এলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে ফ্লাইটটির আসন বরাদ্দ হবে। পরে হাইকমিশন থেকে ফ্লাইটের বিষয়ে যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App