×

মুক্তচিন্তা

স্বচ্ছতা সুশাসনের প্রধান শর্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ মে ২০২০, ১০:২১ পিএম

করোনা ছাড়া এখন আর কোনো আলোচনা নেই। করোনাই এখন এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। অপরিচিত এই জীবাণু মানব জাতির এতদিনের অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সংহার করে চলেছে একের পর এক প্রাণ। কোনো দৈব-দুর্বিপাক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলেকয়ে আসে না। বিশেষ করে করোনার মতো প্যানডোমিক তো নয়ই। পৃথিবীর কারোই কল্পনাতেও ছিল না যে, এমন এক অসহনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তবে এটাই সত্য যে করোনার মতো মহামারি কামড় বসিয়েছে সারা পৃথিবীতে। আর এই করোনার কারণেই জানা গেল দেশে দেশে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা, দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা। আস্তে আস্তে জানা যাবে অন্যান্য খাতের অবস্থাও। পৃথিবীর সব মানুষ এখন একই সমস্যায় আক্রান্ত, একই আতঙ্কে দিশাহারা, একই অনিশ্চয়তায় বিষণ্ণ। বিপর্যয় হিসেবে কোভিড-১৯ নতুন। আমরা এখনো এই বিপর্যয়কে বুঝে উঠতে পারিনি। পুরোপুরি বুঝে উঠতে সময় লাগবে এর শেষ হওয়া, নিদেনপক্ষে লাগাম টেনে ধরা পর্যন্ত। তারপর নিরীক্ষার মাধ্যমে হয়তো জানা যাবে যে আর্থিক খাতগুলোতে কতটা ক্ষতি হয়েছে। এর কোনো চিকিৎসা নেই, নেই কোনো প্রতিষেধক। বেশ কিছু দেশে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে নিমগ্ন রয়েছেন প্রতিষেধকের সন্ধানে। আশা করা হচ্ছে মাস ছয়েকের মধ্যে হয়তো পাওয়া যাবে কোনো সুসংবাদ। কিন্তু ততদিনে মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আমাদের জানা নেই। এই বিপর্যয় সামলে উঠতে আমাদেরও ভাবতে হবে। যতদূর সম্ভব অর্থনীতি এগিয়ে নিতে হবে। দেখতে হবে সাধারণ মানুষ যেন অনাবশ্যক কষ্ট না পায়। জাতীয় অর্থনীতি কোন পথে যেতে চলেছে, তার প্রাথমিক আভাসকে ভিত্তি ধরে অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করতে হবে। তবে যে সর্বগ্রাসী সংকট ধেয়ে আসছে সরকারের একক চেষ্টায় তা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। নাগরিক শক্তিকেও এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের সমালোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে নাগরিক সমাজকেও যথাযথ দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিক শক্তির সহযোগিতার একটি নতুন ধারা গড়ে ওঠার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অবস্থা তৈরি হতে পারে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের ব্যবস্থা করা এবং অর্থনীতিকে চালু রাখার মধ্যে একটা ভারসাম্য তৈরি করা। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বোঝা কিছুতেই দেশের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত তথা সাধারণ জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যাবে না। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের পর অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে এসে দাঁড়ানোও কোনো কাজের কথা নয়। জীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যেমন আবশ্যক, তেমনি অর্থনীতির চাকা সচল না রাখলেও জীবন চলবে না। জীবন ও জীবিকার একটি সুসমন্বয় ঘটাতে হবে। কাজটি সহজ নয়। আমাদের অনেকের মধ্যেই নিয়ম-বিধি না মানার এক ধরনের উগ্র মানসিকতা রয়েছে। একজন নিয়মের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখালে, বিধি ভঙ্গ করলে তা যে অনেকের জীবন বিপন্নের কারণ হতে পারে সেটা আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। স্বেচ্ছায় নিয়ম না মানলে সব সময় ভয় দেখিয়ে সেটা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে কাগজে-কলমে অনেক দিন ধরে লকডাউন চললেও বাস্তবে খুব কড়াকড়ি আরোপ করা যায়নি। মানুষের চলাচল এবং ঘোরাফেরা একেবারে বন্ধ হয়নি। বাজারে উপচে পড়া ভিড় সব সময় দেখা গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, বন্ধ সরকারি-বেসরকারি অফিস-প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন। কিন্তু জরুরি সেবা চালু থাকায় সুযোগ নিয়েছে অন্যরাও। এখন সীমিত পরিসরে লকডাউন তুলে নেয়ার কথা ভাবতে হবে, ব্যবসা চালু করতে দিতে হবে। বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ হতে দিতে হবে, বিশেষত অসংগঠিত এবং ক্ষুদ্র শিল্পে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, মাস্ক ব্যবহার করা, হাত ধোয়ার মতো নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হবে, কিন্তু শ্রমিকরা যাতে কাজের জায়গায় যেতে পারেন, কৃষিক্ষেত্রে এবং ছোট ছোট কারখানায় যাতে নির্বিঘেœ কাজ চলতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সব মনোযোগ যেন পোশাক শিল্প বা সংগঠিত খাতের দিকে না থাকে। যাদের কথা বলার সুযোগ নেই, যাদের হয়ে কথা বলার কেউ নেইÑ তাদের হয়ে তো সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। দুনিয়াভর যে ওলটপালট চলছে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা যদি কোনো ভুল পদক্ষেপ নেই সেটা সাধারণ ভুল হবে না। সেই ভুল শুধরে নেয়ার সুযোগ মিলবে না। আজকের একটা ভুল পদক্ষেপ স্থির করে দেবে, আগামী কয়েক দশক দেশের অর্থনীতি কোন কক্ষপথে চলবে। করোনার বিপর্যয় আবারো আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এই সময়টা আসলে সহানুভ‚তির, সহৃদয়তার, ভালোবাসার, বিবেকের। কুসংস্কার বিসর্জন দিয়ে বিজ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতাকে জায়গা করে দেয়ার। জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানবিক সাম্যের নীতির পথে আবারো এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমরা সব ক্ষেত্রে সমান মানবিকতার পরিচয় দিতে যেমন পারছি না, তেমনি অন্ধ বিশ্বাসও পরিহার করতে পারছি না। নানামুখী দ্ব›দ্ব আমাদের সামনে যে বৃত্ত এঁকে দিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এই বৃত্ত ভাঙার মতো সাহসী আমরা হতে পারব বলেও মনে হয় না। তবে এটা ঠিক যে, করোনা-পরবর্তী পৃথিবী আর আজকের পৃথিবী এক থাকবে না। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতে নানা বাঁকবদল ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। পুঁজিবাদ তার ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে দুনিয়াজোড়া আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হয়তো পারবে না। বাজার অর্থনীতির রমরমা অবস্থাও হয়তো বহাল থাকবে না। রাষ্ট্রই যে নিদানলাকে বড় ভরসা সেটা বোঝা গেছে। তাই বিশ্ব রাজনীতি আবার এক বিকল্প শক্তিকেন্দ্রের সন্ধান করবে বলেই মনে হয়। আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশেও নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা লক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। চিরাচরিত পন্থায় প্রচলিত কাঠামোর ওপর অল্পবিস্তর প্রসাধনী লেপন করে উত্তরণের পথ খুঁজলে সুফল পাওয়া যাবে না। একই ভুল পথে দুবার হাঁটলে সেটা হবে গুরুতর ভ্রান্তি। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে তেমন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব আছে কি? নেতৃত্ব আকাশ থেকে পড়ে না। এই সংকটকালেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম দেউলিয়াপনাই প্রকট হয়ে দেখা গেল। এত এত দল, এত এত নেতাÑ সবাই কোথায় লাপাত্তা। এই দুঃসময়ে শীতঘুমে যাওয়া দল ও নেতাদের খারিজ করতে হবে। বিপদমুক্ত দেশে এরা মানুষের সামনে দাঁড়ালে তাদের বর্জন করার প্রশ্ন আসবে। বিপদ দেখলে যারা শামুকের মতো নিজেদের খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নেন তাদের নির্বাসনে পাঠাতে হবে। এখন পর্যন্ত দেশের রাজনীতির হাল ধরে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বেই সব কিছু চলছে। মানুষের আশা-ভরসা শুধু তার ওপরই। দেশে কার্যকর বিরোধী দল নেই। একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি সম্ভবত সরকারও চায় না। তবে গণতন্ত্রের জন্য এটা খুব স্বাস্থ্যকর অবস্থা নয়। প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বের শাসন সরকারের জন্য স্বস্তিকর হলেও এটা প্রকৃত গণতন্ত্রকামীদের শিরপীড়ার কারণ। এটা মজবুত কাঠামো নয়। প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয়ই সেটা বোঝেন। আবার নিজের অসহায়ত্বও তিনি বোঝেন। তার দল এবং সহযোগী নেতৃত্বের দুর্বলতাও তার অজানা নয়। তিনি ছাড়া আর সবাইকে কেনা যায় এমন খেদোক্তি তার নিজের। তার চার পাশে কাজের লোক কম। নানা ধান্ধার লোক বেশি। ‘আমি কি পাব’, ‘ও পেয়েছে আমি কেন পাব না’ এই মনোভাব যাদের তাদের দূর না করলে ‘পাওয়া’ এবং ‘খাওয়া’র প্রতিযোগিতায় সব বরবাদ হয়ে যাবে। হয়তো এর মধ্যে তা অনেকাংশে তা গেছেও। যেসব সুবিধাভোগী মন্ত্রী, এমপি, নেতা এখন মানুষের পাশে নেই তাদের সবাইকে পরবর্তী রাজনীতিতেও নিরাপদ দূরত্বেই রাখতে হবে। বিশাল দল আওয়ামী লীগের দাপুটে সব নেতা কোথায়? এতবড় দলে এত এত নেতা থাকতে সচিবদের কেন জেলার সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে হলো? এখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। এই ক্রান্তিকালে যদি প্রধানমন্ত্রীর হাতকে তারা শক্তিশালী করতে না পারেন তাহলে এই সুবিধাভোগীরা দেশের বা দলের কী কাজে লাগবে? প্রধানমন্ত্রীকে ভেবে দেখতে হবে মুখোশে ঢাকা মুখ নিয়ে তিনি কতদিন চলবেন? বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App