×

বিনোদন

সত্যজিতের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ পল্টন ময়দান কাঁপিয়েছিল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ মে ২০২০, ০৮:৫৭ পিএম

সত্যজিতের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ পল্টন ময়দান কাঁপিয়েছিল

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সত্যজিৎ

সত্যজিৎ রায়ের শেকড়টা বাংলাদেশে। বাঙলার প্রতি সীমাহীন আবেগ ছিল তার। সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে ১৯৭২ সালে। তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। ঢাকার পল্টন ময়দানে ভাষাদিবসে প্রধান অতিথি ছিলেন সত্যজিৎ রায়। নিজ দেশের কথা বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে উঠেছিল।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আজকের যে সম্মান তার কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। তার বক্তব্যে ছিল শেকড়ের টান। সেদিন বলেছিলেন, গত বিশ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেক বার নানানভাবে সম্মানিত হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আমি জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে, এই শহিদ দিবসের পুণ্য তিথিতে আমি বলতে পারি যে, আজকের যে সম্মান সে সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনো পাই নি আর আমার মনে হয় না, আমি আর কখনো পাব। জয় বাংলা।’

সত্যজিৎ রায়ের এই ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মাঠ উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের রক্তরাঙা হৃদয়ের পরতে পরতে পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় মিশে আছে সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত কাজ। বাঙালি হিসেবে গর্ব করার মতো শিল্পের মহানান্দনিক অনুভব যে দেশকালের বেড়া মানে না, তার প্রমাণ স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।

সত্যজিতের সৃষ্টি নিয়ে বাংলাদেশের অগ্রগণ্য চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল লিখেছেন, “সেরা বাঙালি তাঁরাই হতে পেরেছেন যাঁরা পূর্ব ও পশ্চিমের সেরা দিকগুলি আত্মস্থ করেছেন – রামমোহন, মাইকেল, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ। যথার্থ রেনেসাঁম্যান এঁরা। সত্যজিৎই হয়তো বেঙ্গল রেণেসাঁর শেষ প্রতিভু।

চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘সত্যজিৎ চর্চা’র সম্পাদক আনোয়ার হোসেন পিন্টু ২০১৭ সালে প্রকাশিত সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে অকপটে জানান, ‘..সুস্থ ও নির্মল জীবনযাপনে এই মহাপৃথিবীর ব্যক্তিমানুষের মনের কন্দর থেকে যদি না তাড়ানো যায় ‘অন্ধকার’, তবে পৃথিবীর সবকিছুই মিছে বা অসার। জীবনযাপনের এমন সংকট ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ক্রান্তিলগ্নে সত্যজিতের ভাবনার কলম ও ক্যামেরা খুব সহজে সঠিক দিক নির্ণয়ের বাতিঘর হয়ে ওঠে বারবার।’’

যে মানুষটা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের এই অপার শ্রদ্ধাবোধ সেই সত্যজিৎ রায় স্বয়ং স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাই তো ’৭২-এ প্রথম সুযোগেই অনেক কাজ ফেলে ওখানে গিয়েছিলেন, অকপটে বলেছিলেন, “…আজ শহিদ দিবসে এসে, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরে এসে আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা সফল হল। এবার আমি অনেক জরুরি কাজ ফেলে রেখে চলে এসেছি, আমার আশা আছে যে অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এদেশে আসব। এদেশটাকে ভাল করে দেখব। এদেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব।

নিজে না এলেও বাংলাদেশের মানুষদের জন্য তাঁর দরজা ছিল অবারিত। চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত টেলিফোনে অনেক কষ্টে যোগাযোগ করে পাঁচ মিনিটের জন্য সাক্ষাতের অনুমতি আদায় করেছিলেন একবার। তবে সেই সময় হয়ে যেতে থাকে লম্বা। চিত্রালীতে সেই অভিজ্ঞতার কথা লেখেন সুভাষ দত্ত। শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘পাঁচ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা’।

বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আলোকচিত্রকর বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী আব্দুল আহাদের বোন সাঈদা খানম ১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নিতে কলকাতায় গিয়েছিলেন। কাজের সূত্র ধরে রায় পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়েন। সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে রায় পরিবারের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতার কথা জানিয়ে লিখেছেন...কান্নাভরা মন নিয়ে মানিকদার শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মংকুদি বললেন ‘দেখো বাদল এসেছে।’ আশ্চর্য! মানিকদা আমাকে চিনতে পারলেন। অন্য সময় ঘরে ঢুকলেই যেমন হেসে বলতেন, ভালো আছ ত? আজও তাই জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু সেই উজ্জল মধুর হাসি বড় ম্লান বড় করুণ। কণ্ঠস্বর অতি ক্ষীণ। ‘আপনি আবার ভালো হয়ে উঠবেন।’ বলেই মানিকদার হিমশীতল হাত স্পর্শ করতেই মনে হলো জীবনকে বড় ভালবাসতেন মানিকদা, সেই জীবনের সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে।

সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে মানিকদা সূর্যাস্ত দেখতে ভালবাসতেন। আমি দেখলাম মহাকালের অনন্ত স্রোতে সমগ্র পৃথিবীর আশীর্বাদ নিয়ে মহান সূর্য ডুবে যাচ্ছে। তার সঙ্গে আমার অশ্রুভেজা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশে গেল।

(সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App