×

মুক্তচিন্তা

নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ মে ২০২০, ১০:২৫ পিএম

গত ১ মে রাত ৮টায় বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ‘নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ’ শিরোনামেই জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য একটি ডিজিটাল স্মরণসভার আয়োজন করে। গত ২৮ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা যারা ১৯৯৬-৯৭ সালে এই সমিতির নেতৃত্বে ছিলাম তাদের মাঝে সভাপতি আমি, সহসভাপতি আব্দুল্লাহ এইচ কাফি, মহাসচিব মুনিম হোসেন রানা ও নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ আব্দুল আজিজ ছাড়াও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি সবুর খান, বর্তমান সভাপতি সাইদ মুনীর ও জালালাবাদ এসোসিয়েসনের সভাপতি ড. এ কে আব্দুল মুবিন ডিজিটালি এই স্মরণসভায় অংশগ্রহণ করি। যদিও সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি আমি তার মৃত্যুর পরপরই আনুষ্ঠানিক শোকবার্তা প্রদান করি তথাপি এই শোক সভাটির তাৎপর্য অনেক। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটিকে ঘিরে পুরো জাতির যে আগ্রহ আমাদের সমৃদ্ধির সোপান গড়তে পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামোসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা বা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় তার যে অবদান সেটি বহু মানুষ, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে স্মরণ করতে হবে। সারা বিশ্বের বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য আমরা শারীরিকভাবে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে না পারলেও বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল খাতের পক্ষ থেকে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটা অপরিহার্য একটি বিষয়। সেজন্যই এর পরের দিন শনিবার দুপুরে বেসিস তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি থেকে সেতু বা সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুতেই তার অবদানের বিষয়টি এত বেশি যে তার জীবনের যে কোনো একটি অধ্যায় বা বিষয় নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায় বা দিনের পর দিন কথা বলা যায়। ড. জাফর ইকবাল তার এক লেখায় এই মানুষটিকে ‘নিখুঁততম মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেজন্যই রাজনীতি বা পেশাজীবন থেকে শুরু করে তার ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত কোথাও কোনো বিতর্ক নেই। সবার কাছে বিনা প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য একজন মানুষ তিনি। কিন্তু আমরা যারা তথ্যপ্রযুক্তির মানুষ তাদের কাছে সত্যিকারের একটি নক্ষত্র তিনি। এই দেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে তার যে নেতৃত্ব সেটি অন্যরা যাই চিন্তা করুক আমরা এই খাতের মানুষরা এক সেকেন্ডের জন্যও সেটি ভুলে থাকতে পারব না। কম্পিউটার সমিতিতে যুক্ত ছিলাম বলে তার সঙ্গে নিয়মিত সেমিনারে, মিটিংয়ে, বিভিন্ন কমিটিতে প্রায়ই দেখা হতো। সিলেটে (এটি কাছাড় এখন) জন্ম নেয়া জামিলুর রেজা চৌধুরী অত্যন্ত সাদামাটা ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতেন। তার স্ত্রী সংসারের দেখাশোনার পুরোটাই করতেন বলে সংসারের দিকে তার নজর দেয়ার প্রয়োজন হতো না। সকালে হাঁটা, পত্রিকা পড়া এবং রাত ১২টা পর্যন্ত জেগে থেকে কাজ করা তার নিয়মিত বিষয় ছিল। তিনি নিজের দেশ ছাড়া সুইজারল্যান্ডকে পছন্দ করতেন। আইপ্যাড, কিন্ডেল থাকলেও সব সময়ের সঙ্গী ছিল ল্যাপটপ ও মুঠোফোন। আমার সৌভাগ্য ছিল যে আমি স্যারের পরিবারকে দুই বছর একান্তভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। জেআরসি কমিটির রিপোর্ট : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানিবিষয়ক টাস্কফোর্সের ১৮তম সভায় বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রপ্তানি তার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ বিষয়টি পর্যালোচনা করে সুপারিশ পেশ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১৯৯৭ সালের মে মাসে এই বিষয়ক পরিপত্র জারি করে ও কমিটি জুন মাসে তার কাজ শুরু করে। কমিটিটি ছিল নিম্নরূপ আহ্বায়ক : প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী, বুয়ে, সদস্যবৃন্দ : এ কে এম নুরুল আমি খান, মহাব্যবস্থাপক বিটিটিবি; শাহ মোহাম্মদ নাজমুল আলম, যুগ্ম সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়; ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী ভাইস চেয়ারম্যান, ইপিবি; প্রফেসর এম এ সোবহান, নির্বাহী পরিচালক বিসিসি; এ এস এম কাশেম, সভাপতি ডিসিসিআই; মোস্তাফা জব্বার, সভাপতি বিসিএস; এস এম কামাল পরিচালক, বেক্সিমকো; শেখ আব্দুল আজিজ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, লিডস করপোরেশন; জামিল আজহার, অনির্বাণ; আব্দুল মতিন পাটোয়ারী, সভাপতি বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি; মইন খান, কম্পিউটার সলিউসন্স; মমলুক সাব্বির আহমদ, কম্পিউটার সার্ভিসেস লিমিটেড। কমিটির সদস্য সচিবি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বি এম এম মজহারুল হক, মহাপরিচালক, ইপিবি। এই কমিটিটি জেআরসি কমিটি নামেই সমধিক পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষত সফটওয়্যার রপ্তানিবিষয়ক ধারণা, এই শিল্পের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ, সমস্যা ও তার সমাধান সেটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে এই কমিটির সুপারিশে ওঠে আসে। জামিলুর রেজা চৌধুরী আরো অসংখ্য কারণে আমাদের কাছে অমর হয়ে থাকবেন কিন্তু এটি সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় কাজ যাতে তিনি দেশটির ডিজিটাল যুগে যাত্রার দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। আমি নিজেকে, আমরা এই শিল্প খাতের মানুষরা একদিকে গর্বিত ও অন্যদিকে কৃতজ্ঞ যে একটি সফটওয়্যার শিল্প খাত গড়ে তোলার জন্য অভাবনীয় একটি দলিল প্রস্তুত করা হয় সেই সময়ে। যদি আমরা আজকের দিনেও সেই দলিলটির দিকে তাকাই তবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো তো পাবই সামনের পথ চলার নির্দেশিকাও পাব। এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুতের সময় বিশেষত ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং ভারতের অগ্রগতির রূপরেখা দেখে সেটি থেকে বাংলাদেশ কীভাবে শিক্ষা নিয়ে উপকৃত হতে পারে তার দিক নির্দশনাও দেয়া হয়। এজন্য স্যারের নেতৃত্বে একটি ছোট প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে। আমার যাওয়ার কথা থাকলেও ভ্রমণবিমুখ হয়ে পড়ায় আমি সেই দলে যাইনি। তবে কমিটির রিপোর্ট প্রতিনিধি দলটির ভারত ভ্রমণের অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে মোট ৪৫টি সুপারিশ ছিল। সেসব সুপারিশের মাঝে কম্পিউটার ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেয়া, ১০ বছরের কর রেয়াত দেয়া এবং একটি সফটওয়্যার সমিতি গঠন করার সুপারিশ করা হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ প্রতিবেদনটি তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রফেসর জামিলুর রেজা স্যারের নেতৃত্বে আমরা তোফায়েল আহমেদের অফিসে উপস্থিত থেকে প্রতিবেদনটি জমা দিই ও এর বিষয়বস্তু সংক্ষেপে উপস্থাপন করি। তোফায়েল ভাই সেটি নীতিগতভাবে গ্রহণ করেন এবং এরপর সেটি মন্ত্রিপরিষদে পাস হয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৪৫টি সুপারিশের ২৮টি বাস্তবায়িত হয়। আমরা বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহায়তায় ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ৫ জন মন্ত্রীকে যুক্ত করে একটি সেমিনারের আয়োজন করি, যাতে সভাপতিত্ব করি আমি। ভারতের সফটওয়্যার সমিতির নির্বাহী পরিচালক দেওয়াং মেহতা তাতে উপস্থিত ছিলেন। মেহতাকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাকে উপস্থিত করার ক্ষেত্রে স্যারের অবদান আমরা কোনো দিন ভুলতে পারব না। এলিফ্যান্ট রোডের বাসা, তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল শিক্ষার যাত্রা : স্যারের ঢাকা শহরের পৈতৃক বাড়িটি হচ্ছে ৬৮ এলিফ্যান্ট রোড। ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা ও ১৯৮৮ সালে বিজয় কিবোর্ড প্রবর্তন করার পাশাপাশি আমি তখন দেশজুড়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিই। ঢাকার নানা জায়গায় ভাড়া থাকতে থাকতে ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় থাকা শুরু করি। আমার প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল গ্রাফিক্স ও মাল্টিমিডিয়া। তখন আমাদের পারিবারিক বন্ধু ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বর্তমানে সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জমানের সঙ্গে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করার পরিকল্পনা করি। আমরা তখন জানতে পারি যে স্যারের বাসার দোতলাটা খালি। স্যারের কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিলাম যে স্যার আপনার দোতলাটায় একপাশে আমরা থাকব এবং আরেক পাশে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেব। স্যার ছাত্রছাত্রীদের অত্যাচারের বিষয়টি মাথায় রেখেই সম্মতি দিলেন। সেই অনুযায়ী আমরা সুবর্ণ বিজয় নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করলাম। সুবর্ণ ছিল আক্তারের ছেলের নাম আর বিজয় আমাদের ছেলের নাম। সেই সময়ে ১৯৯৯ সালে আমি স্যারকে জানালাম যে আমি একটি মাল্টিমিডিয়া স্কুল চালু করব। ঢাকার কাছে গাজীপুরের ছায়াবিথীতে ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সেই স্কুলটি চালু করার প্রস্তাব করে স্যারকেই উদ্বোধন করতে বলায় তিনি সস্ত্রীক সেটির উদ্বোধন করেন। বস্তুত বাংলাদেশের ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার সূচনাটি আমি তার হাত দিয়েই করতে পারি। এসবের বাইরেও তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়ন থেকে সব বিষয়ে আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ও ব্যবসায়ী বিধায় বিশেষ মহলের কাছে অপাঙ্ক্তেয় বিবেচিত হলেও তিনি ছিলেন আমার আশ্রয়দাতা ও অভিভাবক। আজ যখন তিনি নেই তখন তার কথা ভাবতেই মনটা ভারী হয়ে যায় আর চোখটা পানিতে ভরে আসে। মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App