×

জাতীয়

মাটির ঘরে মাটির মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২০, ১১:৪৩ এএম

ভোর রাত থেকেই আকাশটা যেন কাঁদছিল। আর কাঁদবেই না কেন? মাথার ওপরের ছায়াটা যে সরে গেছে। বটবৃক্ষতুল্য সেই মানুষটি যে আর নেই! আর তিনিও চেয়েছিলেন শান্তিতে ঘুমাতে। বলতেন, ‘আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, শান্তিতে ঘুমাতে চাই।’ মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) জোহরের পর ধানমন্ডি ঈদগাহ মসজিদে জানাজা শেষে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে মাটির ঘরে ঠাঁই নিলেন দেশের বরেণ্য প্রকৌশলী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন খ্যাতিমান এই প্রকৌশলীর ভাগ্নি শেনিন জিয়াউদ্দিন।

এর আগে সোমবার দিবাগত রাত ২টার পর ঘুমের মধ্যে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হলে ভোর ৪টার দিকে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মারা গেছেন। বর্ণাঢ্য জীবন বলতে যা বোঝায়, এর প্রতিকৃতি ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। ১৯৯৩ সালে যাদের হাত দিয়ে বাংলাদেশের ইমারত বিধি তৈরি হয়েছিল, তিনি তাদের একজন। দেশের প্রথম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে ৫ সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। আর এখন পদ্মার উপরে দেশের সবচেয়ে বড় যে সেতু তৈরি হচ্ছে, সেই প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান নানা উন্নয়ন প্রকল্পেও তিনি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। সব সময় জাতীয় স্বার্থে কথা বলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। সরকার বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হবে কি না, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি।

জামিলুর রেজা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে। প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী ও হায়াতুন নেছা চৌধুরীর এই সন্তান ১৯৬৩ সালে বুয়েটে শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবন শুরু করেন। এরপর ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষা শেষে আবার বুয়েটে ফিরে আসেন। ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচডি করেছেন বহুতল ভবন বিষয়ে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢাকায় শিল্প ব্যাংক ভবনের ডিজাইনে প্রথম যুক্ত হন। স্বাধীনতার পর দেশের প্রায় সব বড় অবকাঠামোর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।

এত বড় প্রকৌশলী হয়ে দেশে কেন রয়ে গেলেন? এ বিষয়ে তার স্পষ্ট উত্তর ছিল, ‘অনেকবার সুযোগ পেয়েছি, কখনো শিক্ষক হিসেবে, কখনো পরামর্শক হিসেবে। আমার সমসাময়িক প্রায় সবাই বিদেশে চলে গেছেন, সেই মানসিক চাপও অনুভব করতাম। কিন্তু সব সময় মনে হয়েছে, এই দেশকে কিছু দিতে হবে। অনেকটা বিনা পয়সায় পড়েছি। এ দেশেরও তো প্রাপ্য আছে।’

১৯৯৬ সালে প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। জীবনের শেষভাগে দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, পরে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালের দিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জন্মলগ্নে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব নেন। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে অবদান রাখা ছাড়াও গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে তার আগ্রহ ও ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি। সুবক্তা ছিলেন। নিরহঙ্কার ও সদালাপী মানুষের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। প্রকৌশলী সমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ছিলেন ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইবি) সভাপতি। ২০১৮ সালে জাপান সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সম্মানজনক ‘অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান, গোল্ড রেইস উইথ নেক রিবন’ খেতাবে ভূষিত করে। তার দীর্ঘ এই পথযাত্রায় সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী সেলিনা চৌধুরী। তাদের মেয়ে কারিশমা ফারহিন চৌধুরীও একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আর ছেলে কাশিফ রেজা চৌধুরী কম্পিউটার প্রকৌশলী।

সারাদেশে শোকের ছায়া : বরেণ্য এই অধ্যাপকের মৃত্যুতে করোনা সংকটেও দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। রাষ্ট্রপতি এক শোকবার্তায় প্রয়াতের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্বদানকারী এই গুণী ব্যক্তিত্বের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, প্রগতিশীল প্রকৌশলী, স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ফোরাম (প্রস্থপ) এর কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক স্থপতি সুব্রত সরকার প্রমুখ জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App